স্টাফ রিপোর্টার
বিলাইছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা খুশি। তিনি অনেকদিনের পরিশ্রমে নিজের বাগানে পেঁপে ও কলা উৎপাদন করেছেন। কিন্তু নদী ও বিলের পথ অতিক্রম করে নৌকায় পাকা-কাঁচা ফল ও শবজি কাপ্তাইবাজারে এনে লকডাউনের কারণে বিক্রি করতে পারেননি। তার নৌকা ভাড়া এবং অবিক্রিত দ্রব্যগুলো শেষে জলের দামে দিয়ে দিতে হয়েছে স্থানীয় জনগণকে। অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের প্রভাবে পার্বত্য ফলচাষীরা বিপদে পড়েছেন। এপ্রিল-মে সময়টি পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌসুমী ফলচাষীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। বছরের এই সময়টাতে অনেক জুম্ম পরিবারে দেখা দেয় একদিকে খাদ্যাভাব ও নানা অভাব-অনটন, অপরদিকে নানা অসুখ-বিসুখের প্রাদুর্ভাব। আর এই সময়েই আসে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনপদের সবচেয়ে বৃহৎ ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু। ফলে সামাজিক উৎসবের আগে শহরে বা বাজারে যদি মৌসুমী ফলমূলসহ নানা প্রাকৃতিক শাকশবজি বা দ্রব্য বাজারে নেয়া যায় তাহলে কিছু উপার্জন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আবার মৌসুমী ফলচাষীরা যারা টাকা খরচ করে ও পরিশ্রম করে ফল উৎপাদন করেন তারা বেশ লাভেরও মুখ দেখেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সময়টাতে ভরপুর হয়ে উঠে আনারস ও তরমুজের মৌসুম। যেহেতু এসময় আবার গরম পড়তে শুরু করে তাই এইসব রসালো ফলগুলোর চাহিদাও বেড়ে যায় অনেক। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় প্রচুর আনারস আর তরমুজ উৎপাদিত হয়। রাঙ্গামাটির জেলা শহরের বিভিন্ন বাজারসহ উপজেলার বেশ কিছু বাজার এসময় ভরে উঠে আনারস আর তরমুজে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফলব্যবসায়ীরা এইসব বাজারে এসে এই ফল কিনে নিয়ে যান।
জানা গেছে, এই বছর আনারস আর তরমুজের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। চাষীরা বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও লকডাউনের কারণে, দেশে এনিয়ে উদ্বেগ ও আতঙ্ক এবং সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপের কারণে আনারস ও তরমুজের এই ফলন মাঠে মারা যাচ্ছে। ফলচাষীদের পরিশ্রম ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে দেশব্যাপী গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন শহরের ব্যবসায়ী ক্রেতারা ফলমূল কিনতে আসতে পারছেন না। স্থানীয়ভাবেও মানুষের চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় দোকানপাট ছাড়া সকল দোকান বন্ধ রয়েছে। তাই স্থানীয় ক্রেতা জনগণ বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও এইসব ফল কিনতে যেতে পারছেন না। ফলে এই মৌসুমী ফলচাষীরা পড়েছেন মহাবিপাকে। বাজারে কোন ক্রেতা ও ব্যবসায়ীর দেখা নেই।
রাঙ্গামাটি শহরে সাপ্তাহিক বাজার বসে শনি ও বুধবারে। এইসব মৌসুমী ফলের সবচেয়ে বড় বাজার বসে শহরের বনরূপার সমতাঘাটে। রাঙ্গামাটির পার্শ্ববর্তী এলাকার ফলচাষীরা ছাড়াও এখানে ট্রলার ভর্তি ফল নিয়ে আসেন নানিয়ারচর, লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি উপজেলার ফলচাষীরা বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি কাপ্তাই হ্রদের তীরবর্তী সমতাঘাট বাজার ঘাটে ফলভর্তি বোট নিয়ে ক্রেতাবিহীন অবস্থায় বসে থাকতে দেখা গেছে অনেক ফলচাষী বা ফলবিক্রেতাকে। ফলে তারা কেবল খুচরাভাবে অত্যন্ত সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন এসব ফল। সপ্তাহ দুয়েক আগেও যেখানে তারা প্রতি জোড়া আনারস বিক্রি করেছেন ৩০-৪০ টাকায়, এখন তাদের তা বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১০-১৫ টাকায়।
জানা গেছে, অধিকাংশ ফলচাষী লাভের আশায় নিজের জমানো সব অর্থ বিনিয়োগ করে কিংবা কারো কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে এইসব ফলের চাষ করেছেন। অনেক ফলচাষী এই ফল বিক্রি করে ঐতিহ্যবাহী উৎসব পালন করে থাকেন, দেনা পরিশোধ করেন, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ যোগার করেন। কিন্তু এই বছর যেন আশার গুড়ে বালি।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতনমহল ও ফল উৎপাদনকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও এখানে সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এখনও কোন কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা হয়নি। তাই পচনশীল, অথচ অত্যন্ত চাহিদা সম্পন্ন ও উপকারী এইসব টাটকা ফল ও শাক-শবজি সংরক্ষণেরও কোন ব্যবস্থা নেই এই অঞ্চলে। ফলে অনিবার্যভাবে ফলচাষীরা পড়েছেন বিপদে। এইসকল ফল পঁচে যাবে। ইতোমধ্যে পঁচে যাওয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাজারে আসা কয়েকজন আদিবাসী জুম্ম ফল বিক্রেতার সাথে আলাপ করলে তারা তাদের হতাশার কথা জানান। তারা বলেন, ‘আমরা এখন কী করব বুঝতে পারছি না। কিভাবে ধার পরিশোধ করব, কিভাবে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাব বুঝতে পারছি না।’
বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও অনেকেই এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন। তারা ফলচাষীদের এই করুণ অবস্থার কথা বিবেচনা করে উদ্বেগ এবং সহানুভুতি প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ এই ফলচাষী ও উৎপাদনের সামগ্রিক স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি তুলে ধরেছেন। আবার কেউ কেউ এমন প্রস্তাবও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কার্যক্রমের সাথে সঙ্গতি রেখে এমন কোন ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে অন্তত রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই শহরে হলেও এলাকায় এলাকায় এইসব ফলমূল একটা সঙ্গতিপূর্ণ মূল্যে বিক্রি নিশ্চিত করা যায়। এতে কিছুটা হলেও বিক্রেতারা ক্ষতি পোষণ করতে পারবেন এবং জনগণ সুলভ মূল্যে এইসব ফল ক্রয়ের সুযোগ পাবেন।