জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কথা নিয়ে যেভাবে সমালোচনা হচ্ছে, আসলে তিনি কথাগুলো ‘ওভাবে’ বলেননি। কথাগুলোর পূর্বাপর কিছু উল্লেখ না করে কেবল অংশ বিশেষ তুলে ধরায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
১১ জুন দুপুরে এক সংবাদদাতার সঙ্গে ফোনে উপাচার্য বলেন, ‘যা প্রচার করা হচ্ছে এটা আমার কোনো বক্তব্য নয়। ব্যক্তিগত আলোচনা। আমি কথাগুলো ওভাবে বলিনি। কাউকে আঘাত করার জন্য বলিনি। প্রসঙ্গক্রমে বলেছি।’
মীজানুর রহমান বলেন, ‘যখন তারা (ছাত্ররা) বলছে ১৬ হাজার ছাত্র টিউশনি করে চলে। বাড়িতে টাকা পাঠায়। তাই তাদের দুই হাজার টাকা করে মোট ২৯ কোটি টাকা মেস ভাড়ার জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। এটা কি বাস্তব কোনো দাবি? যারা মেসে থাকেন তারা কি সবাই গরিব? তখন আমি বলেছি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই কি গরিব? এখানে কি কেবল গরিবদের ভর্তি করা হয়েছে? আমরা কি বিজ্ঞপ্তিতে বলেছি এখানে গরিব-অসহায়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? এখানে সবাই মেধার ভিত্তিতে ভর্তি হয়েছে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছাত্ররা ভর্তি হয়, এখানেও তেমন।’
ভিসি বলেন, ‘যখন আমরা নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আমাদের অনেক ছাত্র আক্রান্ত, তাদের ফোন করে করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করাতে হচ্ছে। কয়েকজন শিক্ষক বাসায় বসে অক্সিজেন নিচ্ছেন। তাদেরও ভর্তি নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। তখন সারাক্ষণই তারা গণমাধ্যমের কাছে মেস ভাড়ার দাবিতে কথা বলছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও দরিদ্র শিক্ষার্থী আসে, বুয়েটেও আসে। এখন যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে গরিব এটা যদি তুলে ধরা হয় তাহলে ছাত্রদের অবস্থান কোথায় থাকে?’
মেসভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে উপাচার্য বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, এটা গরিবদের বিশ্ববিদ্যালয়, এই বিষয়টি ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ এটা মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়। মেধার ভিত্তিতে এখানে ছাত্র ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসে, এখানে আসে।’
মীজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ক্লাসের ৮০ থেকে ৯০ জন ছাত্র থাকলে ২০ জন হয়তো দরিদ্র পরিবারের হতে পারে। আর ১০ জন হয়তো খুবই নিঃস্ব। বাকিরা তো আমরা ভালো আছি। তাহলে সবার মেস ভাড়া বরাদ্দের তো কোনো কারণ নেই। মেস ভাড়া যাদের সামর্থ্য আছে তারা দিবে। এখন তো মেসভাড়া কেউ চাচ্ছেও না। এখন তো মেসেও কেউ নেই। অনেকেই তো বাড়িতে চলে গেছেন। তারা যখন আসবেন তখন এটা নিয়ে সুরাহা করা যাবে। দেখা যাবে কী করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘যারা টিউশনি করে মেস ভাড়া দিয়ে থাকত, তাদের নিয়ে তো সমস্যাটা আরও গভীর হবে। এখন তো মেস ভাড়া দিতে পারছে না, তখন তো খাওয়ারও টাকা থাকবে না। তাদের টিউশনি তো থাকবে না। সেটা নিয়ে আমাদের সবাইকে চিন্তা করতে হবে। আমরা সবাই গরিব তা তো না। আমরা যদি সারাক্ষণ বলি আমরা খুব দরিদ্র-গরিব, সবাই মেসে থাকি, তাহলে তো আমাদের নিজেদেরই আত্মমর্যাদা নষ্ট হবে। এটা বলেছিলাম কথা প্রসঙ্গে।
করোনাকালেও অসহায় শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে সাধ্যমতো সহায়তা করা হচ্ছে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমি তাদের (শিক্ষার্থীদের) বললাম, আমাদের শিক্ষার্থীদের তো অনেকভাবেই আমরা সহযোগিতা করছি। উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত যেখানে যে সমস্যায় পড়ছে তাকেই সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। ইউএনওকে ফোন করে, চেয়ারম্যানকে ফোন করে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছানোর কাজ করছি। বিকাশের মাধ্যমে নগদ টাকা পৌঁছানোর কাজও চলছে।’
ভিসি বলেন, ‘আমাদের প্রচুর ছাত্র আছে অনেক দরিদ্র। এদের তালিকাও আমাদের কাছে আছে। কারণ আমাদের জাকাত ফান্ড আছে। দরিদ্রদের সাহায্য-সহযোগিতা করার বিভিন্ন টিম আছে। সেই হিসাবেই আমাদের ধারণা আছে ৩৬০-৩৬৫ জনের মতো ছাত্র একেবারেই নিঃস্ব। যাদের টিউশনির টাকায় চলতে হয়। তারা এ থেকে বাড়িতেও টাকা পাঠায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় যখন খুলবে এই ছাত্ররা যখন ফিরে আসবে তখন তো টিউশনি অনেকের থাকবে না। স্বাভাবিকভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কারণে অনেক ছাত্রের টিউশনিও থাকবে না। কারণ কেউ তো ঝুঁকি নিয়ে প্রাইভেট শিক্ষক রাখবে না। ঘরে যেতে দিবে না এই পরিস্থিতিতে। এই ছাত্ররা কীভাবে তাদের জীবন-জীবিকা চালাবে? এটা হচ্ছে আমাদের চিন্তার বিষয়। তাদের অনেকেই দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। আমাদের সবাইকে মিলেই এটি মোকাবিলা করতে হবে। সরকারের থেকে যদি সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে ভালো। যারা ধনী আছে, আমাদের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে, তারাও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। একদিনের বেতনও দিয়ে রাখছে শিক্ষকরা।’
ছাত্রদের যারা মেসে থাকে সবাই গরিব না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের একেক মেসে পাঁচজন, সাতজন, দশজন করে দরিদ্র ছাত্র আছে। তাকে সবাই মিলে সহযোগিতা করলে আমি মনে করি এই সমস্যার উত্তরণ ঘটবে। আমরা সবাই মেস ভাড়া দিতে পারছি না, সবাই গরিব-এটা যদি আমরা মানুষের কাছে প্রকাশ করি তার মানে কী? আমি এটা বলেছি, আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতে তো বলি নাই যে দরিদ্র এবং অসহায়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এরকম কি বলেছি? আমরা তো ছাত্র ভর্তি করেছি মেধার ভিত্তিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ক্যাটাগরি বা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্ররা ভর্তি হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও তো একই যোগ্যতা, একই ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের।’
মীজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অনেক ছাত্র মোটরসাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পাসে আসে। তাদের তো মেস ভাড়া নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এটাই আমি বলেছি। আমাদের এখানে মোট ছাত্র ধরা যাক ১৮ হাজার। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হচ্ছে ৪০ হাজার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে ডাবলিং, গণরুম মিলিয়ে ২০ হাজার ছাত্র থাকে। বাকি ২০ হাজার ছাত্র কোথাও থাকে, মেসেই তো থাকে। আমাদের যে পরিমাণ ছাত্র মেসে থাকে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যত ছাত্র মেসে থাকে সংখ্যাটা ধরলাম সমান। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ কি মেস ভাড়া নিয়ে এসব কথাবার্তা বলছে? আমি সেটাই বলছি, আমরা যদি এটাই নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাহলে কী করে হয়?’
তিনি বলেন, ‘এই সমস্যা তো কেবল তো আমাদের সমস্যা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী ট্রেনে করে ক্যাম্পাসে আসে, তাদেরও সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান হয় রাষ্ট্রকে করতে হবে, অথবা আমাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান আছে প্রত্যেক ক্লাসে প্রচুর ছাত্র আছে, যারা একজন দশজনকে দেখতে পারবে, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এটাই বলেছিলাম যে আমরা তো সবাই গরিব না ‘
সবাই মিলে সংকট মোকাবিলা করতে হবে উল্লেখ করে মীজানুর রহমান বলেন, ‘সরকার তো সহযোগিতা করছে, আমাদের যাদের সামর্থ্য আছে, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’