১২ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, ভোর ৫:৪৯
শিরোনাম :
শিরোনাম :
অমর একুশে বইমেলায় মনোয়ার মোকাররমের “আগামী বসন্তে” আজ বঙ্গবন্ধু গবেষক মিল্টন বিশ্বাসের জন্মদিন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এপার-ওপার বাংলার লেখকগণ জবিতে ‘মধুসূদন ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ, বাংলার লোককৃষ্টির যুক্ত সাধনার ঐতিহ্য আলোচনা সভার প্রধান আলোচক মিল্টন বিশ্বাস স্বর্ণপদক পাচ্ছেন কথাসাহিত্যিক নাসরীন জেবিন যারা কবিতা ভালোবাসে তারা স্বচ্ছ মানসিকতার হয় : কবি কামাল চৌধুরী ফাঁসিতলা ক্লাব ও পাঠাগারের কার্যনির্বাহী কমিটির সাথে সাংসদ মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর শুভেচ্ছা বিনিময় ফাঁসিতলা ক্লাব ও পাঠাগারের প্রথম কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত ‘‘সাহিত্যে দুই মহামানব : গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু’’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রটি অনুষ্ঠিত
নোটিশ :
Wellcome to our website...

জীবনবাদী ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান

মো. উজ্জ্বল হোসেন
শুক্রবার, ১২ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৯ পূর্বাহ্ন

বাংলা সাহিত্যে শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮) একটি অবিস্মরণীয় নাম। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবদান রয়েছে, তবে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে সুপরিচিত। শওকত ওসমানের জীবনে ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশ এই তিন সময় বা কালকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই ত্রিকালের বাস্তব জীবনচিত্র ও ঘটনা তাঁর উপন্যাস-সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এ কারণে শওকত ওসমানকে জীবনবাদী উপন্যাস-সাহিত্যে হিসেবে অভিহিত করা যায়। শওকত ওসমানের সাহিত্য সাধনার হাতে-খড়ি হয় কবিতা রচনার মাধ্যমে। তখন শেখ আজিজুর রহমান নামে কিছু কবিতা মাসিক মোহাম্মদী, আজাদ ও বুলবুল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। আবুল কালাম শামসুদ্দিন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “শওকত ওসমান প্রথম দিকে কবিতা লিখতেন এবং সেই সব প্রধানত বাহার সাহেবের ত্রৈমাসিক ‘বুলবুল’-এ প্রকাশিত হত। মাসিক ‘মোহাম্মদী’-এতে আজিজুর রহমান নাম দিয়ে তাঁর কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়।”

কবিতার মাধ্যমে শওকত ওসমানের সাহিত্যচর্চা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে দেখা যায়- গল্প লেখার প্রতি তিনি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। এই গল্প লেখার ঝোঁক থেকে তিনি কবিতা লেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তবে শেষ জীবনে ১৯৮২ সালে তাঁর ‘নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত’ এবং দুই খÐে প্রকাশিত ‘শেখের সম্বরা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গল্প লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে ১৯৪৬ সালে ‘ছাব্বিশ-সাতাশ’ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস রচিত হয়। ‘ঈদ সংখ্যা আজাদ’-এ “বণী আদম” উপন্যাস ছাপা হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। উপন্যাসের কলেবর ছিল দেড়শ’ পৃষ্ঠা। বই রচিত হয় ব্রিটিশ আমলের তিন দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে। উপন্যাস ছাপা হলে পারিশ্রমিক হিসেবে আড়াই শ’ টাকা পেয়েছিলেন।’ এরপর থেকে শওকত ওসমান মানবজীবনের বাস্তব ঘটনা নিয়ে তাঁর কথাসাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন জীবন কাহিনির আলোকে সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর উপন্যাস-সাহিত্যে আমরা মানবজীবনের সামগ্রিক বিষয় তথা বাস্তব ও স্বতন্ত্র জীবন আদর্শের সন্ধান পাই। এজন্য শওকত ওসমানকে আমরা জীবনবাদী ঔপন্যাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। এ প্রসঙ্গে শওকত ওসমান গবেষক অনীক মাহমুদ মন্তব্য করেছেন, “জীবনের রাজপথ থেকে কানাগলি পর্যন্ত শওকত ওসমান সদম্ভে তাঁর লেখনী সঞ্চারিত করেছেন। মানুষের সুখ ও দুঃখের নানা অভিনিবেশেই গড়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যের ভুবন। মানুষ আর মানবতার লড়াইয়ে আজীবন শিল্পী শওকত ওসমান নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসের প্রতি অবিচল থেকে সাহিত্যচর্চা করেছেন।” শওকত ওসমানের ‘বণী আদম’ ও ‘জননী’ উপন্যাসে গ্রাম ও শহরের পটভূমিতে জীবনবোধের ঘটনা  পরিস্ফুটিত হয়েছে । ‘বণী আদম’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হারেসের জীবন কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই, জন্মের পর থেকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও সমস্যার মধ্যদিয়ে তার জীবন অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় নি। প্রথমে নিজ গ্রামের জোতদার সলিম মুনশীর বাড়িতে হারেস চাকরের কাজ করে অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছে। একপর্যায়ে সলিম মুনশীকে প্রতিবাদ করে হারেস নিজ গ্রাম ত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে শহরের বস্তিতে একটু থাকার জায়গা করে নেয়। শহরের প্রতিকুল পরিবেশে কিছুদিন থাকার পর অন্য গ্রামে (সমাগড়)  বন্ধুর সাহায্যে বিয়ে করে একটু শান্তির আশায় বসতি স্থাপন করে। কিন্তু শান্তি তো দূরের কথা, জীবন-সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পায় না হারেস। অবশেষে নিজ গ্রামে ফিরে আসে। ‘জননী’ উপন্যাসে লেখক দরিয়াবিবি, আজহার, চন্দ্রকোটাল ও ইয়াকুব চরিত্রের মাধ্যমে ‘ত্রিশের দশকের’ তৎকালীন দরিদ্র মানুষের নির্মম, নিষ্ঠুর ও বাস্তব জীবনচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। দরিয়াবিবিকে দেখা যায়-অভাবের তাড়নায় পুরুষ-শাসিত সমাজব্যবস্থায় সন্তান মানুষ করতে গিয়ে নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে। আজহারকে দেখি দরিদ্র সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য পাগলের মতো হয়ে অন্য গ্রামে বা শহরে কাজ করতে যায়। শহরের এখানে-সেখানে কাজ করতে করতে একসময় অসুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরে দরিয়াবিবির সেবা-যতেœ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। রূপক-প্রতীকের মাধ্যমে মানবজীবনের পরিচয় ফুটে উঠেছে তাঁর সাহিত্যে। ‘ক্রীতদাসের হাসি’ (১৯৬২) উপন্যাসে বাদশা হারুন-অর-রশীদ, গোলাম তাতারী, বাঁদী মেহেরজানের জীবনচিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এ উপন্যাসে দেখা যায়, অসীম ক্ষমতাধর বাদশা হরুনর রশীদ, গোলাম তাতারীর স্বাধীনতা হরণ করে তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যা করে। লেখক রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে ষাট দশকের আইয়ুব শাসনের জীবন-চিত্র বর্ণনা করেছেন ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসে। ‘চৌরসন্ধি’ (১৯৬৬) উপন্যাসটি চোরদের নিয়ে লেখা। এ উপন্যাসে একজন সাধারণ রিক্সাচালক কাল্লু। কাল্লু তার উস্তাদের কাছ থেকে চুরি-ডাকাতি ও মস্তানি শিখে আস্তে আস্তে সমাজে সুপরিচিত হয়ে কাল্লু সরদারে পরিণত হয়। এখানে প্রধানত দুই চোর কাল্লু সরদার ও বেচু সরদার। একসময় বেচু সরদার ও কাল্লু সরদারের মধ্যে সম্পর্কের চিড় ধরে। এ উপন্যাসে লেখক রূপকার্থে বুঝিয়েছেন যে, কাল্লু সরদার ও বেচু সরদারের মধ্যে যেমন সম্পর্কের ভাঙন ধরে, তেমনি পাকিস্তানের দুই রাজ্যের মোনেম খাঁ ও আইয়ুব খানের মধ্যে সন্ধিও ভেঙে যায় এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়। ‘সমাগম’ (১৯৬৮) উপন্যাসে জুহা আলীর জীবনচিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। জুহা একজন সাংবাদিক আর তার বাসার কাজের ছেলে আলী। আলী একদিন বাগান পরিষ্কার করার সময় একটি তিন’শ বছরের তুলট কাগজ কুড়িয়ে পায়। এই কাগজ বা চিঠির মাধ্যমে জুহা জানতে পেরেছে যে, তাঁর বাড়িতে আলাওল আসবেন আর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাওয়াত দিতে বলেছেন। তাই জুহা আলাওলের কথামত নিমন্ত্রণ করেছেন এবং যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা হলো- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বার্নার্ড শ’, রমাঁ-রলাঁ, হাজী মুহাম্মদ মোহসীন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লিও টলস্টয় প্রমুখ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। জুহার বাড়িতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে সমাগমের আয়োজন করা হয়। মূলত লেখক এ উপন্যাসে রূপকার্থে তৎকালীন পাকিস্তানের সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য, বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠায়, মানব-জাতির কল্যাণ কামনায় বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে সমাগমের আয়োজন করেছেন। ‘রাজা উপাখ্যান’ (১৯৭০) উপন্যাসে রাজা জাহুক ও হরমুজের জীবনচিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এ উপন্যাসে দেখা যায়- ইরানের প্রজাপীড়ক, অত্যাচারী জাহুক রাজার অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ দৈববাণীতে দেখা যায় দুটি গোখরা সাপ তার গলায় বেষ্টন করে থাকে। সাপ দুটির খাদ্য হলো প্রতিদিন ২০/৩০ জন তরুণ-তরুণীর মগজ। এই খাদ্য যতদিন সংস্থান করতে পারবে, ততোদিন রাজা বেঁচে থাকবে। একপর্যায়ে রাজার মেয়ের সাথে হরমুজের পরিচয় হয় এবং রাজার এ কাহিনি জানতে পারে। তাই হরমুজের পরামর্শে দুই সাপের মধ্যে একটা সাপের কম অন্যটির বেশি খাদ্য  দিয়ে সাপ দুটির মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে রাজাকে মুক্ত করেন। এটিও একটি রূপক-প্রতীকী উপন্যাস। ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ (১৯৮৩) উপন্যাসে এক অখ্যাত পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনচিত্র বর্ণনা করেছেন লেখক। গ্রামে পোকার আক্রমণে মানুষ মারা গেলে, ক্ষেতের ফসল নষ্ট হলে ধর্মীয় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন কবি ও মসজিদের ইমাম এই পোকাকে না মারার জন্য ফতোয়া দেয়। কিন্তু গ্রামের সচেতন ব্যক্তি গফুর, মাদবর সবাইকে একত্র করে এই পোকা মারার জন্য মশাল বের করে। অবশেষে পোকারূপী পঙ্গপাল গ্রাম থেকে দূর হয়। এখানে কাহিনি সমাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে মানুষের এক ভিন্ন জীবন-যাপনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ (১৯৭১) উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গাজী রহমানের জীবনচিত্র পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-হানাদারের আক্রমণে ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হলে গাজী রহমান প্রাণ ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে মাতৃভূমি থেকে বিদায় নেয়। বিদায়কালে গাজী রহমান তাঁর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বাস্তব দৃশ্য বর্ণনা করে চলেছেন এ উপন্যাসে। ‘দুই সৈনিক’ (১৯৭৩) উপন্যাসে দুই সৈনিক মেজর হাকিম ও ক্যাপ্টেন ফৈয়াজ এবং মখদুম মৃধার জীবনচিত্র পাওয়া যায়। এ উপন্যাসে দেখা যায়Ñ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি দালাল মখদুম মৃধা পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেও রেহাই পায় নি তাদের হাত থেকে। একদিন মখদুম মৃধা বেশি দালালী করতে গিয়ে দুই সৈনিককে বাসায় এনে খাওয়ায়। রাতে খাওয়ার শেষে মৃধার সুন্দরী দুই মেয়ে সাহেলী ও চামেলীকে দুই সৈনিক  টেনে-হিঁচড়ে কাঁধে করে নিয়ে চলে যায় এবং এ ঘটনার একপর্যায়ে মৃধা গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করে। কাহিনি এখাইে শেষ। ‘নেকড়ে অরণ্য’ (১৯৭৩) উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-সেনাবাহিনীর অত্যাচারের চিত্র। পাক-সেনারা চাল রাখার গুদামঘরে একশ মেয়েকে ধরে এনে বন্দী করে রেখেছিল। এই গুদামঘরে পাক-সেনারা মেয়েদেরকে উলঙ্গ করে রাখত। পাক-সেনারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এই গুদাম ঘরে ঢুকে অত্যাচার-নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করত। ‘জলাংগী’ (১৯৭৪) উপন্যাসে জামিরালীর জীবনের বর্ণনা পাওয়া যায়। জামিরালী একজন কলেজ পড়–য়া ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলেজ বন্ধ হলে, সে বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসে বাবা-মায়ের অনুমতি না পেয়েও সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধ করতে করতে জানতে পারে তার গ্রামের বাড়ি বাঁকাজোলে পাক-সেনারা ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই জামিরালী গ্রামে ফিরে আসে এবং তার মা-বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনতে পায়। তারপর রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে জামিরালী। পাক-সেনারা জামিরালীকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে এবং মেঘনা নদীতে গলায় পাথর বেঁধে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। পতিতাবৃত্তির কাহিনির বর্ণনায়  ‘রাজসাক্ষী’ (১৯৮৩) উপন্যাসে সবুরন ও আলামিনের জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। এ উপন্যাসটি পতিতাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে রচিত। সবুরন গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের মেয়ে। এগার বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু স্বামী কিছুদিনের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। তাই সবুরন বাপের বাড়িতে থাকে। একদিন তার চাচার সাথে শহরে আসে। শহরে এসে এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজ করতে করতে নারী ব্যবসায়ী আলামিনের সাথে পরিচয় হয়। অবশেষে আলামিনের সাথে নারী ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ে। একসময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়। আলামিন ও সবুরন জেলখানায় বন্দী। বিচার শেষ না হতেই আলামিন জেলখানায় মারা গেলে সবুরন মুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু তার পরে সবুরনকে আর কেউ কোথাও দেখে নি। ‘পিতৃপুরুষের পাপ’ (১৯৮৬) উপন্যাসে লালবানু ও জব্বার হাওলাদারের জীবনচিত্র পাওয়া যায়। এ উপন্যাসটিও পতিতাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে রচিত। জব্বার হাওলাদার তার মেয়েকে দিয়ে এই পতিতাবৃত্তির ব্যবসা করেছেন। জব্বার হাওলাদার গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষক। কিন্তু তার শরীরে একসময় টিউমার ধরা পড়লে অনেক জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হয়। ফলে সে দরিদ্র কৃষকে পরিণত হয়। তারপর অভাবের তাড়নায় জব্বার হাওলাদার অন্যপথ বেছে নেয়। তা হল মেয়েকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি ব্যবসা। তবে অন্যভাবে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কিছু দিনের মধ্যে জামাইয়ের কাছ থেকে জোর করে তালাকনামা লিখিয়ে স্বর্ণ ও কাবিনবাবদ নগদ টাকা আদায় করে তাড়িয়ে দেয়। এভাবে একের পর এক বিয়ের মাধ্যমে টাকা রোজগার করে জব্বার হাওলাদার। অবশেষে লালবানুর তৃতীয় স্বামী তার শ্বশুর জব্বার হাওলাদারের এই ধান্দা ধরতে পেরে বিচারালয়ে বিচার দেয়। লালবানু তার বাবার এই কৌশল থেকে মুক্ত হয়। ‘আর্তনাদ’ (১৯৮৫) উপন্যাসটি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত। এ উপন্যাসে আলী জাফর ও তার পিতার করুণ জীবনের বর্ণনা পাওয়া যায়। আলী জাফর গ্রামের গরীব চাষীর ছেলে। উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে। একসময় পাকিস্তানিদের বৈষম্যনীতি তার চোখে পড়ে। তাই পাকিস্তানি সরকারের বিপক্ষে ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং একসময় পাকিস্তানী পুলিশের গুলিতে আলী জাফর নিহত হয়। পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বৃদ্ধ পিতা ঢাকায় আসে কিন্তু পুত্রের লাশ না পেয়ে  আর্তনাদ করতে করতে বাসে উঠে গ্রামে ফিরে যায়। এভাবে শওকত ওসমানের উপন্যাস-সাহিত্যে ত্রিকালের (ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে) ঘটে যাওয়া মানবজীবনের সমস্ত বিষয় বিশেষ করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকের বর্ণনা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তাই এই ত্রিকালদর্শী লেখক শওকত ওসমানকে বাংলা সাহিত্যের একজন সমাজসচেতন জীবনবাদী ঔপন্যাসিক বলা যায়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, উত্তরা

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর