স্টাফ রিপোর্টার
কাপ্তাই থেকে ইন্দিরা তঞ্চঙ্গ্যা এবং রাঙ্গামাটির বিলাইছরি থেকে আদর ও লালপেক জানিয়েছেন করোনার কারণে লকডাউনের কবলে পড়ে পাহাড়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্য সংকটে পড়েছেন।যারা কৃষি উৎপাদন বিক্রি করে জীবন চালান তারা সেসব দ্রব্যসামগ্রী বাজারে নিয়ে বিক্রয় করতে পারছেন না। ফলে চরম খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে।অন্যদিকে গতবছর জুম চাষে ফলন ভাল না হওয়ার কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
জানা গেছে, বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুই হাজার জুমিয়া পরিবার খাদ্য সংকটে পড়েছে। ভাতের চালের সংকট দেখা দেওয়ায় রেমাক্রি ও তিন্দুতে অভাবি মানুষরা এখন বুনো আলু, ফলমূল, কলার মোচা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।করোনার আগে অতিবৃষ্টির কারণে জুম চাষ করতে না পারায় এবং করলেও ফলন ভালো না হওয়ায় দুর্গম ইউনিয়ন রেমাক্রি ও তিন্দুতে বসবাসরত পাহাড়িরা চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। খাদ্য সংকট দূর করার লক্ষ্যে এখনই জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ বিতরণ প্রয়োজন বলে
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, দুর্গম পাহাড়ে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় জুম চাষ। ২০১৯ সালে অতিবৃষ্টির কারণে অনেকেই জুম চাষ করতে পারেননি। যারা করেছেন ভালো ফসল হয়নি।আর যা কিছু ফলন
হয়েছে তা করোনার কারণে লকডাউন চলায় বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। এজন্য দেখা দিয়েছে এ খাদ্য সংকট। এদের সাহায্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে না এলে চলতি এপ্রিল মাস থেকে
আগামী বর্ষায় খাদ্য সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। রেমাক্রি ইউনিয়নে বড়মদক থেকে দেড়ঘণ্টা পায়ে হাঁটার দুরত্ব য়ংনং কারবারি পাড়া। সেখানে ১৭ ম্রো পরিবারে বাস। ওই পাড়ার বাসিন্দা ৮০ বছরে রুইমন ম্রো জানিয়েছেন, “আমরা বড় দুঃখে পড়েছি। ঘরে ভাত নাই। বন্য আলু সংগ্রহ করে খাই। কেউ খোঁজ-খবর না নিলে আমরা না খেয়ে মরে যাব।”
একই পাড়ার আদুই ম্রো (৬০) ও য়ুংওয়াই ম্রো (৫৬) জানান, গত বছর বৃষ্টি হওয়ায় জুম চাষ তেমন হয়নি। কারবারি পাড়ার পাশে ১৮টি পরিবারের মারমা পাড়ায় ঘুরলে দেখা যাবে, তিন-চার পরিবারে লোকজন ছাড়া কেউ নেই। সবাই জুমে কাজ করতে গেছেন। বাড়িতে রয়েছে ছোট ছেলে-মেয়েরা। কারবারি (পাড়াপ্রধান) ক্রাহ্লাঅং মারমা জানান, পাড়ায় পাঁচ পরিবার ছাড়া কারও ঘরে চাল নেই। দুই-তিন দিন পর এক বেলা ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়। তুলনামূলক স্বচ্ছল ওই পাঁচ পরিবার থেকে পাড়ার অভাবগ্রস্ত লোকজন ধান-চাল ধার নিতে নিতে তাদেরও খাদ্যের জোগান শেষ হওয়ার পথে। রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাংচং ম্রো বলেন, “এ বছর খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে।”
তার ওয়ার্ডে সীমান্ত এলাকায় পাড়া পাতোয়া, লিক্রি, ঞোয়েতং এবং বুলু পাড়ায় সংকট সবচেয়ে বেশি বলে জানান তিনি। ৫৫ ত্রিপুরা পরিবারের জাপারাং পাড়ার সাজানো-গোছানো ঘরগুলোতে সৌর বিদ্যুৎ থাকলেও খাদ্য সংকট সেখানেও। ওই পাড়ায় মাত্র ১০ পরিবারের ঘরে খাবার আছে বলে জানা গেছে।
রেমাক্রি ইউনিয়নে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা বলেন, তার ইউনিয়নে ১৩২০ পরিবার আছে। ১ হাজার পরিবার জুমিয়া। এর মধ্যে প্রায় ৯০০ পরিবারে খাদ্য সংকটে রয়েছে।কেবল ত্রাণ দিয়ে নয়, বরং দুর্গম এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান তিনি।
তিন্দু ইউনিয়নে চেয়ারম্যান মংপ্রুঅং মারমা বলেন, তার ইউনিয়নেও ১২০০ পরিবারের মধ্যে ৭০০ পরিবারে অভাব চলছে।
দুর্গম পাহাড়ি এই এলাকা চলতি বর্ষায় খাল ও ঝিরিতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কেউ কেউ না খেয়ে মারা যেতে পারেন বলে শঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।এই সংকট তিন পাহাড়ি জেলার ক্ষেত্রে একইরকম।
বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির গ্রামের দুর্গম এলাকাগুলোতে করোনাভাইরাসের লকডাউনকালীন সেখানকার প্রশাসন দিয়ে দ্রুত খাদ্যদ্রব্য কিংবা চাল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ অক্টোবর পর্যন্ত পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে খাদ্য সংকট থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য তালিকা দোকানে দোকানে টাঙিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ এসেছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে। বিশেষত পণ্যের দাম কঠোর নজরদারির মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করলে ওই জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকা আরো কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।