২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ১১:৪৪
নোটিশ :
Wellcome to our website...

হেফাজত : জামাতের ট্রিপল মিউট্যান্ট ভেরিয়েন্ট

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।।

  প্রায়ই রাজনৈতিক বক্তৃতায় একটা বিষয় শোনা যায়, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। যদি ধর্মভীরু লোক অশিক্ষিত বা কেবলমাত্র তাঁর ধর্ম শিক্ষায় একমুখী শিক্ষিত হয়, সে ধর্মান্ধ হতে বাধ্য। ধর্মভীরু এবং ধার্মিক এই দুইটি গোষ্ঠীর বাইরে ইদানিংকালের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপ হচ্ছে ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠী। ধার্মিক নয়, ধর্মের কিছুই মানে না,  কিন্তু ধর্মকে সমর্থন করে। অনেকটা যেমন জীবনে কোন একদিন ফুটবল না খেলেও বাংলাদেশের মানুষ ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে। বিশ্বকাপের সময় পাড়ায় পাড়ায় পতাকা (ঝান্ডা) উড়িয়ে সমর্থন ঘোষণা করে এবং সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর মারামারি হতেও দেখা যায়; অনেকটা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের মত। পুরনো ঢাকায় অনেক যুবক আছে যারা আশুরার (১০ মহরম) দিন ধারালো লোহার পাত বা তলোয়ার দিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করে নিজেই রক্তাক্ত হয়। জীবনে একদিনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েনি, এমন রাজনৈতিক ধার্মিককে জুম্মার নামাজের হাজিরা দিয়ে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে দেখেছি। রাজনৈতিক মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। (অনেকটাই কায়েদ-এ-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মত। ফারসি শব্দ কয়াইদ মানে নেতা,  আরবি আযম অর্থ বড় বা মহান। খাঁটি ধার্মিক না হওয়া সত্বেও উর্দু ভাষার কবি ও কলাম লেখক এবং দিল্লির ‘আল আমিন’ পত্রিকার সম্পাদক  মাওলানা মাযহার- উদ-দীন তাঁকে ১৯৩৮ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের  নেতৃত্বের জন্য এই উপাধি দেন।)

ব্যক্তিজীবনে অসৎ, ঘুষখোর, সুদখোর, ভূমিদস্যু ও দুর্নীতিবাজকে চেহারা এবং লেবাস মরুকরণ করে মসজিদ মাদ্রাসায় অকাতরে দান করে দানবীর, দ্বীনের  খিদমতগার এবং এক পর্যায়ে মসজিদ মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি হতে দেখেছি। ধার্মিক না, ধর্মভীরুও না ; ধর্মের সমর্থকদের নিয়ে এ জাতি কি করবে? ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসের ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করে এটা নিশ্চিত বলা যায়, যারা ধর্মকে বাদ দিয়েও ধর্মীয় একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে ‘হেফাজতে ইসলাম’।  দুই মাসের দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ভিডিও ফুটেজগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে জঙ্গী-জানোয়ারদের (ঘোড়ার পিঠে তলোয়ার হাতে) সাথে প্রচুর সংখ্যক ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠীও ছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্ট  কাণ্ডের পর সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকার কঠিন অবস্থানে গিয়েছে। কয়েকজন রাজনৈতিক হেফাজতিকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক হেফাজতিকে গ্রেফতার বা শাস্তি দিয়ে (যদিও শেষ পর্যন্ত এসব কিছু না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলেই কেউ কেউ মনে করেন) অথবা গণমাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে এইসব রাজনৈতিক ইসলামাবাদীদের দমন করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। যেমনটা মাদকবিরোধী (নেশা বিরোধী) কম্বিং অপারেশন করে পৃথিবীর কোথাও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। অপারেশন করে আসক্তি দূর করা যাবে না। আশক্তির মূল উৎস  বন্ধ না করে কম্বিং অপারেশন অনেকটা জিও ব্যাগ দিয়ে সাময়িকভাবে নদীর ভাঙন বিলম্বিত করার মত। আসলে এই দিয়ে প্রকৃত ভাঙন রোধ করা যায় না। ভাঙন রোধের জন্য স্থায়ী বাঁধ তৈরির কোন বিকল্প নেই।

বাহ্মণবাড়িয়ায় বড় হুজুরের নির্দেশে ছোট ছোট শিশুদের (তালেবে এলেম) সহিংসতায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। এদের অধিকাংশই এতিমখানা থেকে আগত। এতিমদের হাফেজ খানা থেকেই এরা এসেছে‌। এতিমদের মা-বাবা নেই, হুজুর  যা বলবে তারা তাই করবে। প্রশ্ন হচ্ছে এত এতিম হুজুরদের জিম্বায় গেল কেন? অন্য কোন উপায় কী ছিল না? দেশের জন্য ৫ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। এরমধ্যে অতি ক্ষুদ্র একটি অংশও কী আমরা এতিমদের জন্য রেখেছি? ঐতিহাসিক ভাবেই এতিমদের ঠিকানা কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট এতিমখানা। এত ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বড় বড় সেতু সবই করলাম কিন্তু প্রত্যেক উপজেলায় একটা মডেল এতিমখানা তৈরি করতে পারলাম না, যেখানে আধুনিক হোস্টেল থাকবে, ভালো মানের স্কুল, কারিগরি স্কুল থাকবে। এতিমদের সকলকে মাদ্রাসায় পড়তে হবে কেন? ৪৬০টি মডেল মসজিদ তৈরি করছি, ভাল উদ্যোগ। একই সাথে যদি ৪৬০টি মডেল শিশু পল্লি তৈরি করতে পারতাম। এতিম এবং অতি দরিদ্র পরিবারের শিশুরা যেখানে থাকবে এবং ভালো স্কুলে পড়বে। (বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অধীনে এ ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠান চললেও এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এক শতাংশও না। এছাড়া ও অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আকর এ সকল প্রতিষ্ঠান)। প্রবাসী এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের কল্যাণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চেয়ে গ্রামের মাদ্রাসাগুলোর চাকচিক্য অনেক বেশি। অনেক গ্রামেই প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। কিন্তু কওমি বা নূরানী মাদ্রাসা ছাড়া কোন গ্রাম অবশিষ্ট আছে কিনা আমার জানা নেই। কিছু কিছু অঞ্চলে গ্রামের ৫০ শতাংশ শিশু মাদ্রাসার দিকে ঝুঁকছে।

  মধ্যপ্রাচ্যে যারা থাকেন তাদের সন্তানদের জন্য পছন্দ হচ্ছে মাদ্রাসা,  স্কুল নয় । একটানা তিন চার বছর সৌদি আরবে  থাকা অবস্থায় তাদের স্ত্রীদের ইসলামী লেবাসে ঢেকে পরপুরুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখা এবং সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠানো হচ্ছে গ্রাম অঞ্চলের বাস্তবতা। মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিটেন্সে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে (এর থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার অতিসম্প্রতি শ্রীলঙ্কাকে ঋণ হিসাবে দিয়ে প্রথমবারের মতো আমরা বিশ্বে ঋণদাতার খাতায় নাম লিখিয়েছি)। রেমিটেন্সের সাথে আসা মরুভূমির বালুতে বাঙালি সংস্কৃতি ঢেকে গেছে। সংস্কৃতির মরুকরণের আর কিছুই বাকি নেই।

    আমাদের একটা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আছে। এ খাতে সরকারের বিনিয়োগ কত? এ খাতে যা বরাদ্দ তা দিয়ে শিল্পকলা একাডেমির কর্মচারীদের বেতন দিতেই শেষ হয়। সঙ্গীত, নাট্যকলা, ক্রীড়া ও সুকুমার কলায় বিনিয়োগ কত? শিশু সংগঠন কি এখন বাংলাদেশে আছে? খেলাঘর, শাপলা কুড়ির আসর, ফুলকুঁড়ি আসর, মুকুল ফৌজ এগুলোর অস্তিত্ব কি টের পাওয়া যাচ্ছে? কোথাও কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এত দূরবস্থা পাকিস্তানি আমলেও ছিল না। সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা, কোন অনুষ্ঠান নেই। যেটা নিয়মিত হচ্ছে সেটা হচ্ছে ‘ওয়াজ’ । অনেক জৌলুষপূর্ণ ওয়াজ মাহফিল। ব্যয়বহুল প্যান্ডেল, আলোক ঝলমল মঞ্চ,  এলইডি লাইট,  ফেসবুক লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) ইউটিউব সবই আছে। ওয়াজের হুজুর হেলিকপ্টারে আসছেন,  বিভিন্ন গান শোনাচ্ছেন, জিকির করছেন। জিকিরের তালে তালে ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠীও নাচছেন । জিন্সের প্যান্ট ও কেডস পরিহিত ধর্মের সমর্থকরা এটাকে এখন তাদের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষ্ঠান হিসেবে দেখছে। হুজুরের সম্মোহনী বক্তৃতার ( বেশিরভাগই কোরআন হাদিস বর্জিত কল্পকাহিনি ও রাজনীতি) কারণে ধর্মের সমর্থক গোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্তত ফেসবুক কমেন্ট এর সাথে প্রোফাইল পিকচার দেখে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। অবশ্য এর বিপরীতে কিছু কিছু হাক্কানি আলেম ঈমানের কথা, ভালো কাজের কথা মানুষদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলছেন এবং তাঁদের কথামতো অনেকে আমলও করছে।

  আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত,  এমন কি বলা যায় ২০০৭ সাল পর্যন্ত জামাত ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে একসময় এটাকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছিলেন। যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় জামাত এখন ম্রিয়মাণ। এত জামাত-শিবির গেল কোথায়? আমি তো মনে করি আজকের হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে জামাতের ট্রিপল মিউট্যান্ট ভেরিয়েন্ট।  ১৯৪০-এর দশকে ইসলামপন্থী রাজনীতির যেসব তাত্ত্বিক সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাঁরা হলেন আবুল আ’লা মওদুদী(১৯০৩-১৯৭৯), সাঈয়িদ কুতুব(১৯০৬-১৯৬৬), হাসান আল বান্না(১৯০৬-১৯৪৯)। কুতুব ও বান্না মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিকাশের সাথে যুক্ত। কৌশল বদলালেও জামাতের আদর্শ থেকে সরে আসেনি। তিউনিসিয়ার রাশিদ ঘানুশি জামাতের বিপরীতে নতুন তথ্য উপস্থাপন করেছে যা মওদুদীর  সাথে আকাশ পাতাল পার্থক্য। কুতুব, বান্না ও মওদুদী ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। আইন প্রণয়নের অধিকার শুধু আল্লাহর। মানুষ হচ্ছে তাঁর প্রতিনিধি (যেমনটি পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটির প্রথম সংবিধানের প্রথম লাইনে লেখা ছিল) । তার বিপরীতে ইজতিহাদের (যুক্তিক আলোচনা) আলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ইসলাম মানুষের উপর অর্পণ করেছে, এই যুক্তিতে রাশিদ ঘানুশি ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যাকে নাকচ করে দেন। ঘানুশি শরিয়া ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে সেকুলারিজমের পক্ষে অবস্থান নেন। বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলামের সাথে মওদুদীর বাদের শতভাগ মিল থাকায় এটা যে সম্পূর্ণভাবে জামাত ইসলামের নতুন সংস্করণ এতে কোন সন্দেহ নেই। এরা লিংকনের গণতন্ত্র মানে না, রাষ্ট্রপতি মানেনা, প্রধানমন্ত্রী মানে না, তারা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভেঙে মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চায়।

কওমি মাদ্রাসাকে বিরাজনীতিকরণের কথা কেউ কেউ বলছেন। কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামি’আতিল কওমিয়া, বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান, কওমি মাদ্রাসাগুলোকে রাজনীতি মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি মনে করি এটা আরেকটা মিউট্যান্ট। এটা কোনদিন সম্ভব হবে না। রাজনীতির মধ্য দিয়েই কওমীদের জন্ম।  গণভবনে মাওলানা আহমদ শফীর নেতৃত্বে ওলামাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসকে কওমীদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী (জিয়া-এরশাদ এবং খালেদা যে দাবী পূরণ করেনি) মাস্টার্সের সমমান এর সনদ প্রদানের ঘোষণা করার সময় দারুল উলুম দেওবন্দের আদলেই এই ডিগ্রি প্রদানের ঘোষণা দেন। দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল কাশেমের ছাত্র মাহমুদ আল হাসান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১৯২০ সালে আল হাসান গ্রেপ্তার হন এবং মাল্টায়  নির্বাসিত হন । মাহমুদ আল হাসানের ছাত্র হাসান আহমদ মাদানী ভারত বিভাগে মুসলিম লীগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ১৯২৯ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল মজলিস-ই-আহরার-উল- ইসলাম কংগ্রেসের সাথে জোট বদ্ধ হয়ে জিন্নাহর দেশবিভাগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। হাসান মাদানী ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেওবন্দের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত অগ্রণী। ১৯৬৯ সালে ভারতে বেড়াতে এসে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান দেওবন্দে এসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন এখানে বসেই মাহমুদুল হাসানকে নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী অনেক পরিকল্পনা করেছেন।

  অতএব জন্মই যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান রাজনীতি ছাড়বে এটা বিশ্বাস করা যায় না। বিগত দিনের  অভিজ্ঞতায় এটা নিশ্চিত বলা যায় হেফাজতিরা রাজনীতি করবেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ তাদের যত ছাড় দিক না কেন হেফাজতীরা কখনো নৌকায় উঠবে না। হেফাজতের সাথে জামাত যুক্ত  হওয়ায় আদর্শিক কারণেই বিএনপি’র সাথে থাকবে। জামাতের সাথে আলাদা করে যাওয়ার দরকার নেই, হেফাজত নিজেই জামাতের মিউট্যান্ট ভার্সন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে দেশ চললেও সরকার কিন্তু সকল জনগণের নিকট দায়ী। জামাত-বিএনপি’র লোকেরা কী করোনার টিকা, চিকিৎসা বিনামূল্যে পাচ্ছে না? সরকারের বিনামূল্যের বই কেবল আওয়ামী লীগের সন্তানরাই পাচ্ছে? এটা নিশ্চিত হেফাজতীরা নৌকায় কোনদিন ভোট দিবে না। তাহলে কী সরকার তাঁদের জন্য কিছু করবে না? প্রায় এগার হাজার মাদ্রাসার, প্রায় পনের  লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য সরকার কী কিছুই করবে না? মনে রাখতে হবে কওমী মাদ্রাসায় যারা পড়ে বা পড়ান তাঁদের কেউ কেউ মানসিকভাবে ‘পাকিস্তানি ছিটমহলের’ বাসিন্দা হলেও সবাই এদেশের সন্তান। সন্তান বিপথগামী হলে অভিভাবক দায় এড়াতে পারে না। বিশেষ করে রাষ্ট্রকে এর দায় নিতেই হয়। অতএব কওমিদেরকে হেফাজতের জঙ্গি নেতা বা নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না।  বাস্তবতার নিরিখে কওমি শিক্ষা বন্ধ করাও যাবে না।

  বাংলায় সুলতানি আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘মাদ্রাসা’ নামে খ্যাত ছিল। শহরে অবস্থিত মাদ্রাসাগুলোতে আরবি ও ফারসি শেখানো হতো। মোগল আমলে মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন করা হয়। গণিত, জ্যামিতি, হিসাব, কৃষি, ভূমি জরিপ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, প্রকৃতি বিজ্ঞান, শরীর বিদ্যা, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় মাদ্রাসা শিক্ষায় যুক্ত হয়। হিন্দুরাও সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হতো এবং রাজভাষা ফারসি পড়ে সরকারি বড় পদগুলোতে নিয়োগ পেত। শিক্ষার এই ধারা ব্রিটিশ আমলেও অব্যাহত ছিল। মাদ্রাসায় আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক প্রায়োগিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মাদ্রাসায় ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ানো হতো। মাদ্রাসা থেকেই বহু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ সৃষ্টি হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে:  কমরেড মুজাফফর আহমদ, দিদারুল আলম, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, শওকত ওসমান, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শেখ লুৎফর রহমান, কামরুল হাসান, শহীদুল্লাহ কায়সার,আনোয়ার পাশা, রশিদুল হাসান উল্লেখযোগ্য। কওমি শিক্ষাকে যদি বাস্তবমুখী প্রায়োগিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত না করা যায় তাহলে সমস্যাটি বাড়তেই থাকবে। কওমি মাদ্রাসা থেকে পাস করা ছাত্রদের কর্মসংস্থানের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। যার কারণে বেকারত্ব তাদের নিত্য সঙ্গী। কওমি মাদ্রাসা থেকে পাস করার পর ভালো কোনো পেশায় যেতে না পেরে কয়েকজন মিলে তাদের নিজেদের আত্মকর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যেই পাশের গ্রামে গিয়ে আরেকটি কওমি মাদ্রাসা তৈরি করে এবং সেই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে দান-খয়রাতের টাকায় জীবিকা নির্বাহ করে। এটা হচ্ছে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অতএব কওমি মাদ্রাসার কারিকুলামে তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় বিষয়াদি প্রাধান্য দিয়ে হলেও কিছু জাগতিক ও কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে কওমি ছাত্রদের কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত হবে। তাহলেই বেকার হুজুরদের একটার পর একটা কওমি মাদ্রাসা স্থাপনের আগ্রহ কমে যাবে। এটা না করা গেলে পুরো দেশ কওমি মাদ্রাসায় ভরে যাবে। এটার জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

(ড. মীজানুর রহমান , অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর