২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, রাত ১:৫৭
নোটিশ :
Wellcome to our website...

যেভাবে কাটছে করোনার সময়টা

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পূর্বাহ্ন

     ড. আলো ডি’রোজারিও

১। আগে কখনো ভেবে দেখেনি, আমার জীবনে কয়টি ক্রিয়াপদ কীভাবে ক্রিয়াশীল। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, সময় আছে বলে, এই করোনাকালে। প্রায় আড়াই দশক আগে অষ্ট্রেলিয়ার সিডনীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে জেজুইট যাজক মার্ক র‌্যাপার বলেছিলেন, থেমে আমরা অগ্রগতি ঘটাই। (We make progress by stopping). তিনি তার এই উক্তির ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমাদের দাঁড়াতে হয়, আমরা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, আমাদের কোন না কোন সময় বসতে হয়, প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়পরতা আমাদের ৬-৮ ঘণ্টা বিছানায় শায়িত থাকতে হয়। কোন কারণে যদি হাঁটবার বা দৌঁড়াবার পর দাঁড়াতে না পারতাম, দাঁড়াবার পর বসতে না পারতাম, এরপর দিনের এক সময়ে বিছানায় দেহ এলাতে না পারতাম, তবে কেমন হতো আমাদের অবস্থা, আমরা কি স্বাভাবিক থাকতে পারতাম? পারতাম না। কী এক অদ্ভূত করোনা ভাইরাস হঠাৎ করে এসে শুধু আমার না, সারা বিশ্বের প্রায় সকল মানুষের থামবার সুযোগ বাড়িয়ে দিল, তা কী ভবিষত কোন অগ্রগতির জন্য, জেজুইট যাজক মার্ক র‌্যাপারের উক্তি অনুসারে? এখন আমার বেশি সুযোগ থামবার, ভাববার, পেছনে তাকাবার, এমনকি বিছানায় শুয়ে থাকবারও। আগে দুপুরে বিশ্রাম নিতাম না, এখন নিচ্ছি। যাজক মার্ক তার বক্তব্যের শেষ দিকে অবশ্য বলেছিলেন, কোন কাজ, প্রকল্প বা সংস্থা শুরু করলে মাঝে মাঝে থামতে হয়। থেমে দেখতে হয়, কি কি ভালো করলাম, আরো ভালো কি কি করতে পারতাম? কিছু ভুল করলাম কি? কি কি শিক্ষা নিতে পারি অতীত কাজ বা অভিজ্ঞতা থেকে? কিছুদিন থেমে এই অনুশীলন গভীরভাবে করলে, তার মতে, অগ্রগতির হার পরবর্তীতে অনেকটাই বেড়ে যায়।

২। শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গ, আপনারা অবশ্যই ইতোমধ্যে বুঝে নিয়েছেন, বর্তমান করোনাকালে কোন ক্রিয়াপদটি আমার জীবনে বেশি ক্রিয়াশীল। তা অবশ্যই শুয়ে থাকা, রাত ও দুপুর মিলে। চব্বিশ ঘণ্টায় এই ক্রিয়াপদের জন্যে বরাদ্দ আগের চেয়ে গড়ে কম করে হলেও দু’ঘণ্টা বেড়েছে। দ্বিতীয় যে ক্রিয়াপদ, যাতে আমার মনোনিবেশ বেশি, তা কেন জানি এককভাবে চলতে পারছে না, বা এমনও হতে পারে আমিই অন্তরায় এর একলা চলার পথে। পড়া নামের ক্রিয়াপদটি লেখা ক্রিয়াপদটির সাথে মিশে যাচ্ছে, আবার লেখা ক্রিয়াপদ হারিয়ে যাচ্ছে পড়া ক্রিয়াপদের মাঝে। আমি পড়তে পড়তে লিখছি, আবার লিখতে লিখতে পড়ছি, দু’টোই যেন চলছে সমান তালে। তাই, বোধ করি বলা যায়, পড়ালেখায় বেশ সময় দিতে পারছি এই করোনাকালে। লেখাপড়া না লিখে পড়ালেখা লিখলাম, কারণ, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, অল্পসময় ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থনা করে, পড়া দিয়েই দিন হয় শুরু।  প্রথমে পড়ি, বাংলা দৈনিক সমকাল, দেশের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে; এরপর পড়ি, The Washington Post, দুই মেয়ে পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে থাকে, তাই সেখানকার প্রধান প্রধান খবর তো জানতে হয়। একে একে এরপর পড়ি, Bd Christian News, UCA News, La Croix International, etc.  তাছাড়া, ব্যাংককে কারিতাস এশিয়ার অফিসে আমার সহকর্মীরা পালাক্রমে অফিস করছে বলে Bangkok Post আমাকে পড়তেই হয়। আমি ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের শেষে ব্যাংকক অফিস থেকে ঢাকা ফিরে আসার পর ব্যাংককে বা দেশের বাইরে আর যাই নি। কারিতাসের সভাতে যোগ দিতে এক মাস পর পর ভাটিকানে  যাই, সেজন্যে ভাটিকানের ও রোমের কিছু সংবাদ জানা তো আমার জন্যে ভালো, তাই সেখানকার ইংরেজি সংবাদ পড়ি কিছু না কিছু। এসব পত্রিকার বাইরে আরো যা পড়ছি, তন্মধ্যে অন্যতম হলো, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও অবদানের ওপর লেখা প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। আজোবধি, কম করে হলেও ৫০ জনের লেখা পড়েছি, যারা বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে লিখেছেন। বর্তমানে মুজিব বর্ষ চলছে, তাঁর ওপর কিছু লিখতে চাই, লিখতে হলে পড়তে তো হবেই।

৩। প্রতিদিন ফোনে যে কত সময় কাটছে তা প্রকৃত অর্থেই হিসেব করা সম্ভব না। দুই মেয়ে অন্তরা ও শ্রেয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে দিনে দু’বার করে ফোন করে দিচ্ছে নির্দেশনা ও শুনাচ্ছে সাবধান বাণী, পরে আবার ফোন করে নিশ্চিন্ত হচ্ছে তাদের দেয়া নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকছি কী না। আমরা ভাবছি তাদের নিয়ে, তারা ভাবছে আমাদের নিয়ে। জানি না, এই ভাবনার শেষ কোথায়। দুই মাসেরও বেশি সময় একটানা ব্যাংকক অফিসে আমি সশরীরে উপস্থিত নেই, ফোনে ফোনে সব জরুরি কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। অবশ্য, অনেক কার্যক্রম, বিশেষ করে যেসব সভা ও সেমিনার মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের পরিকল্পনায় ছিল সেসব বাতিল বা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। ভাবতে হচ্ছে এখন, জুন মাসের পরিকল্পনায় রাখা সভা ও সেমিনার নিয়ে কী করা যায়। ব্যাংকক শহর কখনো পুরোপুরি লকডাউন করা হয় নি, রাত ১০টা হতে ভোর পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা সব কিছু বন্ধ থাকে, বাকী সময়ে করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেক কিছুই খোলা, বেশি লোক জমায়েত হয় এমনসব জায়গা অবশ্যই বন্ধ আছে। রোম বা ভাটিকানে মার্চ ও এপ্রিলে যে যে সভা হবার কথা ছিল, সব কয়টি হয়েছে অনলাইনে। আসছে মে মাসের সভাগুলোও হবে অনলাইনে। অনলাইন বা ভার্চুয়াল সভাগুলোতে সুবিধা, সভা তাড়াতাড়ি শেষ হয়, আর অসুবিধা, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় না বিভিন্ন টাইমজোনের কারণে, এমনকি পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না আলোচনার জন্যে। এই অস্বাভাবিক সময়ের একটি ভালো দিক, অনেকে ফোন করে জানতে চায়, আমরা সব কেমন আছি, আমি দেশে আছি কী না, আমাদের মা কেমন আছেন, আমাদের মায়ের বয়স তিরাশি চলছে, তাই তাকে নিয়ে চিন্তা সবার, করোনাকালে বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে আছেন যে। আমিও ফোনে প্রতিদিন খোঁজ নিচ্ছি কারো কারো, পালাক্রমে।    

৪। তখন সবেমাত্র আমাদের দেশে লকডাউন বা ছুটি শুরু হয়েছে। একদিন এক পরিচিতজন ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নিলেন। তিনি মনিপুরীপাড়াতে আমার খুব কাছাকাছি থাকেন। কথায় কথায় আমি জানতে চাইলাম, তাদের সারাদিন কীভাবে কাটে। তার সারাদিনের কর্মতালিকার বর্ণনায় একাধিকবার প্রার্থনা করার বিষয় ছিল, শুনে খুবই ভালো লাগলো যে তারা প্রতিরাতে ঘুমাতে যাবার আগে দ্বিতীয়বার প্রার্থনা করেন। তার কাছ হতে দ্বিতীয়বার প্রার্থনা করার কথা শুনে এতটাই উৎসাহিত হলাম যে ঐদিন রাত হতেই আমার স্ত্রী শিউলী ও আমি শুরু করলাম রাতে ঘুমুতে যাবার আগে দ্বিতীয়বার প্রার্থনা করা । আমাদের পারিবারিক প্রার্থনা করার সময় কিছুটা এই করোনাকালে বেড়েছে। কিন্তু আমি জানি অনেকের বেড়েছে বহুগুণ। রাজাবাজারে থাকে আমার গ্রামের এক পরিবার তারা দিনে তিন বারে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা প্রার্থনা করেন। অতি পরিচিত বা কম পরিচিত যাকেই ফোন দেই, আমি শুনি, তারা বলেন, একমাত্র ঈশ্বরই জানেন সামনে কী আছে, প্রার্থনা ছাড়া গতি নেই। আমার ধারণা, করোনা-পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ মানুষ আগের চেয়ে বেশি বেশি প্রার্থনা করবেন, যেমন শুরু করেছেন এখনটায়। সেসাথে তারা জীবনযাপন ও জীবনাচরণেও পরিবর্তন আনবেন- ভোগবিলাসের ব্যাপারে অনেকে সাবধান হবেন, কেউ কেউ পরোপকার বেশি বেশি করবেন, বহুসংখ্যক মানুষ সহমর্মী হবেন, নিঃস্বার্থপরভাবে আবার কেউ কেউ সম্পদ দরিদ্রসেবায় ব্যয় করবেন। 

৫। এই সময়ে কত কী নিয়ে যে ভাবছি! মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস একটার পর একটা আহবান জানিয়েই যাচ্ছেন। তিনি আহবান জানিয়েছেন: যুদ্ধ বন্ধ করতে, অস্ত্র তৈরি না করতে, অস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ করতে, ঋণ মওকুফ করতে, রাজনীতিক নেতাদের কথা ও কাজে মিল রাখতে, প্রান্তিক মানুষ- বিশেষ করে অতি-দরিদ্র, শরণার্থী, অভিবাসী, শিশু, নারী, রাস্তায় বসবাসরত মানুষ, কয়েদী ও প্রবীণদের আরো বেশি ভালোবাসাসহ যত্ন দিতে, ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করতে, সেবাদাতাদের সেবাদানে আরো উদার, বিনয়ী, নমনীয় ও সৃজনশীল হতে। তাঁর বিরামহীন অনুপ্রেরণা, প্রচেষ্টা ও প্রার্থনায় অনেকে ইতোমধ্যে বিভিন্নমুখী সেবা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, ভবিষতে আরো অনেকে এগিয়ে আসবেন, সেরকম প্রত্যাশা নিয়ে ভাবি। সেসাথে ভাবি, দেশের মানুষের কথা- বিশেষ করে যারা নাকি দৈনিক আয়-রোজগার করতে পারছেন না, বেতন পাচ্ছেন না, বিদেশে বা দেশে ঘটনাচক্রে নানা কারণে আটকে গেছেন এবং পরিবার হতে দূরে আছেন, উৎপাদিত কৃষিজ ও অন্যান্য দ্রব্য বাজারজাত করতে পারছেন না, যাদের ছোট-খাটো ব্যবসা বন্ধ আছে, বিদেশে যারা অবৈধ অভিবাসী, এই অস্বাভাবিক পরিবেশে যারা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না, ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী যারা সাহসিকতার সাথে সেবা দিতে গিয়ে অসুস্থ হচ্ছেন, অতি আপনজনের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যারা উপস্থিত থাকতে পারছের না তাদেরসহ আরো অনেকের কথা। সবচেয়ে বড় ভাবনা, আমাদের দেশ ও সমাজ নিয়ে, আমরা সবাই কবে নৈতিক হবো, অন্যেরটা কাইড়া খাবো না, কইরা খাবো; বিপদে পরা মানুষের ত্রাণ চুরি করবো না, নিজের লোভী মনটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবো; নিজের ভালো-মন্দের ও অন্যের ভালো-মন্দের বিষয়ে আরো অধিক সিরিয়াস হয়ে এই করোনাকালে সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো; সামনের খাদ্যাভাব এড়াতে খুব হিসেব করে খাবো, খাদ্যের অপচয় একদমই করবো না, প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনবো (এটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবান); সর্বোপরি, আমরা সকলে আরো বেশি মানবিক হবো।

৬। আরো একটি ভাবনা, কবে আমরা এই অবস্থা হতে মুক্তি পাবো- বায়ু কতটা নির্মল হলে? নদী ও সমুদ্রের পানি কী পরিমাণে স্বচ্ছ হলে? পাখি স্বাধীনভাবে আকাশে উড়বার কতটুকু বিশ্বাস ফিরে পেলে? আর মানুষ, কতটা পাল্টালে বা মানবিক হলে? পড়ি বা লিখি, ফোন ধরি বা প্রার্থনা করি, ঘুমাই বা জেগে থাকি, সারাক্ষণই চিন্তা পৃথিবীর মানুষ কী পারবে করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে? অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তির ধারণা, সেটা আর সম্ভব হবে না। তবে, মানুষের সামর্থে আমার অগাধ বিশ্বাস। আরো বেশি বিশ্বাস, ঈশ্বরের দয়া ও করুণার ওপর। মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এবং ঈশ্বরের দয়া ও করুণায়, শুধু করোনাভয় নয়, যেকোন ভয়, যেকোন সময়, মানুষ করবে জয়। পরিবর্তিত সুন্দর, সতেজ ও সবুজ পৃথিবীতে প্রতিজন মানুষ হয়ে যাবে আরো বেশি নৈতিক, মানবিক ও সাদা মনের মানুষ, এটাই প্রত্যাশা।

(ড. আলো ডি’রোজারিও, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কারিতাস বাংলাদেশ, প্রেসিডেন্ট, কারিতাস এশিয়া)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর