– রেজওয়ান আহমেদ, ২৬ মার্চ ২০২০, পটুয়াখালী।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২০ উপলক্ষে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। IDLC group এর করা। দেখা যায় একটা ছেলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র হচ্ছে। পাত্রের দোষ আঞ্চলিক ভাষা। ভিডিওটার মধ্যে একটা মেসেজ আছে খুব সুন্দর- কষ্ট পাওয়ার কী আচে? ও কতা হেকচে মোর দাইর্দ্যা, আর মুই কতা হিকচি মোর মায়র দাইর্দ্যা।
মেসেজ নিয়ে কিছু লিখবো না, কারণ ঐ ভিডিওর রিভিউ করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কথা হচ্ছে, এরকম সস্তা হাসাহাসি শুধু তথাকথিত স্মার্ট বন্ধুবান্ধবরাই শুধু করে এমন নয়। কোনো কর্পোরেট নিয়োগের ভাইভা বোর্ডেও এমনটা করা হয় এবং সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় ‘আঞ্চলিকতা দোষ’ শব্দবন্ধ। বলা হয় ‘আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট’। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রার্থীকে অযোগ্য বলে চিহ্নিত করা হয়। সংশ্লিষ্টকাজে প্রার্থীর দক্ষতা বিচার না করে এরূপ লজ্জা দেয়ার সংস্কৃতি সেই প্রার্থীকে বোধকরি ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করতে পারে না। বরং এতে সে নিজের যোগ্যতার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেও ফেলতে পারে।
আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষাকে প্রান্তিক জনগণ মাতৃভাষা হিসেবে জানে। ব্যবহারিক অর্থেও ব্যাপারটি তা-ই। প্রশ্ন হচ্ছে, মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতার কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে? বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণে এই ভূখণ্ডের অবাঙালিদের রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। একটু গভীরভাবে ভাবলে তাদের মাতৃভাষার রক্ষাও এক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয়। অথচ এদেশের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক অধিবাসীর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ আশঙ্কাজনকভাবে সীমিত। কোনো কোনো এলাকায় যাদের সে সুযোগটুকুও নেই, তাদের নেই নিজস্ব বর্ণমালার সাথে পরিচিতি পর্যন্ত! ভাবা যায়?! লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা (রাখাইন ভাষার ক্ষেত্রে) এমন অদ্ভুত তথ্যই দিচ্ছে।
যারাই এদেশে আঞ্চলিকতা নিয়ে ঠাট্টা করেন, তাদের যুক্তি- এগুলো রসিকতার খাতিরেই করা। এ রসিক জনসমষ্টির ভাব দেখে মনে হয় আমাদের চিত্তবিনোদনের সুযোগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে হয়তো।
গ্রামে বেড়ে ওঠা কোনো কিশোর বা কিশোরী যখন হঠাৎই শহরে গিয়ে সেখানকার ভাষাগত প্রমিতি আত্মীকরণ করে ফেলে, সেটা তার বিশেষ গুণ হতে পারে, গর্ব নয়। তার গর্ব তার আঞ্চলিক টানের সুললিত বাচনভঙ্গিই। অতুলপ্রসাদ বলে গেছেন- মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা। এ গানের কবিতায় মা-মাটি-মমতা মিশে একাকার। কংক্রিট-কঠিন কর্পোরেট বাস্তবতা এক্ষেত্রে অবাস্তব।
শিক্ষার মাপকাঠিতে মোটাদাগে দুই দলের লোক পাওয়া যায়- শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত। যারা শিক্ষা পায় তারা শিখে নেয় চার উপায়ে- শোনা, বলা, পড়া আর লেখা। অশিক্ষিতরা শুধু শুনে আর বলেই ক্ষান্ত। এরা পড়তে-লিখতে জানেনা শিক্ষিতদের মতো। প্রমিত বাঙলা বিকৃত। কারণ, দেশভাগের আগেই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ তথা নদীয়া আর বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের অবিকৃত কথ্য ভাষাকে সামান্য ঘষামাজা করেই মানভাষা তথা প্রমিত ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এই প্রমিতি বিকৃত হলেও স্বীকৃত। তাই বলে অবিকৃত ভাষাভাষীকে অস্বীকৃতি জানানোর কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষিত যারা, তাদের মূলেও কিন্তু কোনো না কোনো আঞ্চলিক ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হয়তো তারা সমাজরক্ষার খাতিরে প্রমিতি বজায় রেখেই কথা বলেন।
আমার নিজের কথাই যদি বলি, আমি সবসময় আঞ্চলিক ভাষা এবং প্রমিত ভাষার ঐক্য রক্ষা করে চলতে পারি বললে ভুল হবে। যারা আমার লেখা পড়েন, তারা প্রমিত ভাষাটাই দেখতে পান আমার লেখায়। কিন্তু কথ্যভাষায় সম্পূর্ণভাবে প্রমিতি রক্ষা করতে পারিনা এবং এতে আমার তিলপরিমাণও হীনম্মন্যতা নেই। যেমন হীনম্মন্যতা নেই বাবার সাথে কোড মিক্সিং করে ফেলার ক্ষেত্রেও। বাবার সাথে আমি একটা সময় পর্যন্ত শুধু প্রমিত রীতিতেই কথা বলতাম, বরিশালী টান আসতো না বললেই চলে। ইদানিং আসে প্রায়ই। বাবা কোড মিক্সিং করেন হরহামেশাই- প্রমিত বলতে বলতে হঠাৎই বরিশালী শব্দ বা বাক্যভঙ্গি চলে আসে তার, আমার সাথে, অন্যত্র নয়। সভা-সেমিনারে কথ্যরীতি বাবাকে এড়িয়ে চলতেই দেখেছি। মায়ের ক্ষেত্রে দেখেছি ধ্বনিতত্ত্বীয় বিবেচনায় জেনে না জেনে প্রচুর কোড মিক্সিং করে কথা বলতে। আমি যখন ঢাকায় আসি তখন রাস্তাঘাটে বরিশাল অঞ্চলের কাউকে দেখলে চিনতাম ভাষা দিয়েই। সবাই তা-ই চেনে। অনেকে বলে রেজওয়ানের মধ্যে -ইজম আছে। বরিশালিজম। আমি বলি, যদি থেকে থাকে কোনো প্রকারের -ইজম, সেটা একমাত্র ভাষার টানেই।
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান বলছে- মাতৃভাষা স্বজাতীয় ভাষা, মায়ের মুখ থেকে বাল্যকাল হতে যে ভাষা শিক্ষা করা হয়। আবার Longman Dictionary of Contemporary English অনুসারে ব্রিটিশ ইংরেজিতে mother tongue এর ব্যাপারে বলা হচ্ছে – your mother tongue is the first and main language that you learnt when you were a child. ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত Cambridge Advanced Learners’ Dictionary দিচ্ছে আরেকটু বিস্তারিত তথ্য – the first language that you learn when you are a baby, rather than a language learned at school or as an adult.
ওপরের ব্যাখ্যাগুলোতে এটা পরিষ্কার যে মাতৃভাষা হচ্ছে আমাদের শেখা প্রথম ভাষাটি। গুরুমুখী বিদ্যারও গুরু হচ্ছে আমাদের মা-বাবা-পরিজন-পরিবেশ-প্রতিবেশমুখী বিদ্যা। ভাষা যেহেতু যোগাযোগের মাধ্যম, মাতৃভাষাই সে বিদ্যার মূলে। শিশু পৃথিবীতে এসে প্রথম শোয় কিন্তু মায়ের হাতবালিশে। পাশ ফিরলেই মায়ের মুখ। সেই মুখনিঃসৃত ভাষাই তার প্রথম শ্রুত ভাষা। অনুকরণপ্রিয় বাঙালি শিশু প্রথম প-বর্গীয় ধ্বনি উচ্চারণ করতে চেষ্টা করতে করতে একপর্যায়ে ডেকে ফেলে – মা! পৃথিবীর বেশিরভাগ ভাষায় মা বোঝাতে ম অক্ষরের ব্যবহারে কোনো শব্দই গৃহীত। বাঙলা মা হয়ে যায় ইংরেজি মম, আরবি উম্মি, হিন্দিতে অবশ্য মা ডাকা হয়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলার পর থেকে সারা বিশ্বের মানুষ বাঙালি সংগ্রামী ৮ ফাল্গুনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেই পালন করছে। যে প্রাণের ভাষায় কোনো প্রমিতির বালাই নেই, নেই আঞ্চলিকতা দোষের অপবাদে চাকরি যাবার ভয়। অথচ এদেশে সে ভয়ের জুজুতেই অনেকের ক্যারিয়ার খেয়ে ফেলতে চাইছে কেউ কেউ। তারা মাতৃভাষা দিবসে হয়তো কর্মসূচিও রেখেছে, পালনও করেছে। কিন্তু অবশ্যই মনে রাখেনি, ভাষার জন্য প্রাণ যাঁদের গেছে তাঁদের হাতের প্ল্যাকার্ড ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বললেও মুখ বলছিলো “রাশ্টোভাশা বাংলা ছাই” অথবা “রাশ্টোবাশা বাংলা চাই” নয়তো “আশ্টোভাশা বাংলা চাই”।
“… এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” – মূলত আপামর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রশ্নেই কিন্তু এ সুদৃঢ় আহ্বান।