রেজওয়ান আহমেদ
ক্রয়সূত্রে জমির মালিক জেছমিন খাতুন। বাড়ির নেমপ্লেটের ওপর লেখা।
জেছমিন খাতুন আমার মায়ের নাম। তুর্কি বংশোদ্ভূত মহিয়সী নারীর কেন মিরপুরে জমি কিনতে হবে? নিচে একটা ফোন নাম্বারও দেয়া। ফোন করে কী বলব বুঝতে পারছি না। যদি এই জেছমিন খাতুন সেই জেছমিন খাতুন না হয়? আর যদিও বা হয়, মা কি চিনবে আমাকে? চিনবে কেন? আমি কথা বলতে শেখার আগেই মা আমাকে, বাবাকে রেখে চলে যায় তার তুর্কি খানদানের কাছে। শুনেছি তারা নাকি খুবই সাংঘাতিক ধরণের। মাকে আমার কখনো ফিরিয়ে দেবে সে আশা করি নাই যেদিন শুনেছি সেদিন থেকেই।
ইউসুফের চায়ের দোকানে আমি সকাল-সন্ধ্যা চা খাই। ১৩ নাম্বারের নার্সারির সস্তা ফুলগাছ বেচতে আসে ভ্যান নিয়ে এদিকেই। ডিপিডিসির অফিসের উল্টোদিকের ক্যাফে দস্তরখানা থেকে মুক্তিযোদ্ধা বাতেন সড়ক এমনকি ড. আজমল হসপিটাল- কোথায় যাই না? সারাদিনে না হলেও সপ্তাহে দুবার বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করি জায়গাটা, অথবা জায়গাটা আমাকে – সৌরজগতের নিয়মে। তবু আমি সূর্য নই। সূর্যের কোনো পক্ষপাত নেই। আমার আছে, অথবা সেই বাসাটার। বি ব্লকের পেস্ট কালার গেটের বাসাটা আমাকে চুম্বকের মতো টানে। আমি সাততলার ব্যাচেলর মানুষ হয়েও গাছতলার এই টিনশেড মায়ার দর্শন তাই ভুলে থাকতে পারি না।
বাংলাদেশে দুটো জায়গায় সমাজতত্ত্ববিদের আনাগোনা – চায়ের দোকান আর সেলুন। আল্লাহর অশেষ রহমতে দুটো জায়গায়ই আমার আসা যাওয়া হয়। সেলুনে মাসে একবার যাই – তাই আমার জন্য কাজের রেটও ১০ টাকা এমনি এমনি বেড়ে যায়। না কাঁদলে মা যেমন খাবার দেয় না, তেমনি সেলুনে না গেলে খাতির খাবারের ব্যস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়ে বিলটা খাতিরের সমানুপাতে বেড়ে যেতে পারে।
আবদুস সাত্তার বিহারি। থাকে এদিকটায়ই। দেদারসে বকবক করে আর মেশিন টানে গাল বরাবর। আমি ওর বকবকানির সিকিভাগও বুঝলে বেঁচেবর্তে যেতাম – তা হয়ে ওঠে না। তাই ক্লান্তশ্রবণে শুনে যাই। সেলুনে মাসিক হাজিরা দেয়ার বোধকরি এটা একটা কারণ। এসব সাত্তাররা বোঝে না। ক্যানভাসার আর হেয়ারড্রেসারদের এসব বুঝলে চলবে কেন? কিন্তু সেদিনের বকবকানিতে আমার জন্য বিশেষ কিছু ছিল। গোঁফটা ফেলে দিতে গেছিলাম। এমনিতে দশ টাকা দিলেই হয়। কিন্তু কী মনে করে পঞ্চাশ টাকার নোটটা ওর হাতে ধরিয়ে থাইগ্লাসটা খুলেই দে দৌড়। যেতে যেতে ওর গলার ক্ষীণ আওয়াজ কানে আসছিল – আরে আপ ইসে বান্দ কিউ নাহি কার রাহে হ্যায়?! পাত্তা দিলাম না। পাত্তা দেয়ার সময় নেই।
ইউসুফের দোকান খুলেছে সবে। অন্য দিন হলে অপেক্ষা করতাম, আজ তর সইছে না। এক কাপ অর্জুন চা চাইতেই বান্দা হাজির। এইবার আমাকে যত ওয়েট করতে হোক, করব। প্রতিদিন এই লোকের জন্যই সিরিয়াল পড়ে যায় আধা ঘণ্টার। এর ওপর তাই এতদিন দারুণ বিরক্তি পুষতাম। বিরক্তিটা এক ঝটকায় কেটে গেল সেলুনে বসেই। বিপরীত পাশের চেয়ারে বুড়োর তখন ফোনকল এসেছে। সেলুনের সারিবাঁধা আয়নায় চাইলেই আমি উনাকে দেখতে পারতাম। কিন্তু খেয়াল করিনি। হঠাৎ কারো ভাঙা গলা শুনলাম – হাঁ বোলো বেটি… লাগতা হায় তেরি খোয়া বেটা হামেশা কে লিয়ে খো গ্যায়া হো, তো চালিয়ে তুর্কি ভাপাস চালাতে হায়!
এখন ফোন করার সাহস হয়েছে। বিশ্বাসও হয়েছে। মাতৃত্বের কাছে ৫৪১৩ কিলোমিটার নস্যি। আর পিতৃত্বের কাছে নস্যি ভাষা পরিবার।
(গল্পকার – শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়)