রেজওয়ান আহমেদ
তন্তু বয়ন করা পেশা যার = তন্তুবায়/তাঁতি, বহুব্রীহি সমাস।
ব্যাসবাক্যের পূর্বপদ তন্তু থেকে তাঁত শব্দটা এসেছে। আর তাতে চন্দ্রবিন্দু চড়ে তাঁত হয়ে যাওয়ার ইতিহাস হলো নাসিক্য ন্ধ্বনির চন্দ্রবিন্দুতে বিবর্তনের ইতিহাস। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখন বরং মূল প্রসঙ্গে ঢুকে যাই সরাসরি।
ঢাকা নিউমার্কেটের এক কোণে আলীগড় লাইব্রেরিতে প্রায়ই ঢুঁ মারি আমি। রাজশাহীর এক মুরুব্বি। উনিই সম্ভবত লাইব্রেরিটা চালান। উনার সাথে আমার মুখচেনা পরিচয়। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন একজন প্রফেসরের ছেলে হিসেবে উনার সাথে পরিচয় করে রেখেছি। কারণ ছোটবেলায় কোনো একবার আব্বার সাথে ঢাকা এসে দেখেছি ঐ লাইব্রেরি থেকে আব্বা বেশ কিছু বই নিয়েছিল। আর তখনকার সমাজ বইতে আলীগড় আন্দোলন, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ- এসবের নাম দেখেছি। তাই হয়তো আলীগড় শব্দটার প্রতি আমার একটা টান আছে আলাদা। বড়বেলায় এখানে এসে মুরুব্বিকে আব্বার পরিচয় দেয়ার পর ওনার চেহারার ঝলকে বুঝলাম হয়তো আব্বাকেও উনি মুখচেনার মতো করে চেনেন।
যাইহোক সেদিন উনার কাছে যখন দ্বিতীয়বারের মতো মুনতাসীর মামুন স্যারের ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইটা দেখতে চাইলাম, উনি বের করে দিলেন। প্রাসঙ্গিক আলাপে উনার কিছু আক্ষেপের ভাগীদার হলাম। উনি বললেন- জানো বাবা… তুমি যখন স্পেনে যাবা, ওরা তোমাকে কী দিবে? মাদ্রিদের ক্যাপ বা টিশার্ট। আবার নিউইয়র্কে যাও- বুকের ওপর আই লাভ NYC ছাপানো একটা উন্নতমানের টিশার্ট দেবে। এরকম পৃথিবীর মোটামুটি সব শহরই তাদের ব্র্যান্ডিংটা ভালো বোঝে। কিন্তু বাবা, আমরা বুঝি না। আমরা বুঝি একটা বিদেশি আসছে- তো তারে দাও বোমা মেরে খতরনাক করে। ছিনতাইকারীর পাওয়ার দিখা দো! অথচ দ্যাখো- এই শহরটা- ৪০০ বছরেরও বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। কত্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস। কিন্তু কোথায় সেই মসলিন (এককালে রোমেও রপ্তানি হতো এই বস্তু)? আমরা কি পারতাম না নিজেদের আদিটাকে অন্তত এই বর্তমানের তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের দেখানোর জন্য সংরক্ষণ করতে? তুমি শাহবাগ জাদুঘরে গেলে রেপ্লিকা পেতে পারো- কিন্তু তোমার আইন তোমাকে বলবে তুমি একটা সম্ভাবনাময় চোর, সুতরাং তোমাকে ধরে দেখতে দেয়া বোকামি। অথচ আমাদের উচিত ছিল- নাও বাবা, নিয়ে যাও তোমার মা-বোনদের এই শাড়ি পরাও। তারাও ঐতিহ্য চিনুক। …
সেই ঐতিহ্যের পিতামাতারাই এই বাংলার আদি তন্তুবায় বা তাঁতি। ১৯২০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে দলবেঁধে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন বলে জানা যায়। অবশ্য আরও পুরনো সূত্রেও তাঁতিদের অস্তিত্ব স্বীকৃত। ১৫১৮ সালের কথা। তখন ডোয়ার্টবারবোসা নামের এক পর্তুগিজ ভদ্রলোক তার বাংলাভ্রমণের কাহিনিতে মেমোনা, চওলারি, বালিহা, চিনিবাপা- এসব নাম উল্লেখ করেন। এগুলো তাঁত কাপড়েরই নাম। আবার ১৬৭০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের রিপোর্টে ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ এবং বাজিতপুরের তাঁতশিল্পের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন। এ রিপোর্ট মতে সিংহাম, কাস, মলমল, রেশমি, নীলা এবং টফেটা ছিল স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত কাপড়ের প্রধান উদাহরণ। এছাড়াও সারবন্দ, বাদান, তূর্য, চারখানা, মলমল, আদ্দি, তানজেব, এলেবেলে, নয়নসুখ, কুমিশ, তারান্দম ও জামদানি উল্লেখযোগ্য।
জামদানি শাড়ি আম্মা প্রায়ই পরতো। এখনো হয়তো শুধু জামদানিই টিকে আছে ধুঁকে ধুঁকে।
তাঁতিরা মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দু (যোগী বলা হতো) ছিল। মিথলজি থেকে জানা যায় এরা শূদ্রপিতা ও ক্ষত্রিয়মাতার সন্তান। মোগল শাসনামলের আগপর্যন্ত এই হিন্দুরাই বেশি ছিল এ পেশায়। এরপর আস্তেআস্তে মুসলমান তাঁতির (জোলা) সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকার তাঁতিরা বারাম, বসাক, প্রামাণিক, সরকার, শীল, নন্দী, পাল, সাধু ইত্যাদি পদবী পান। তবে পরে এদের বসাক নামেই চেনা হয় বেশি। এ প্রসঙ্গে বলা যায় পটুয়াখালীতে বসাকবাজার নামে একটা জায়গা আছে। ধারণা করা যায় এরাও তাঁতপেশায় জড়িত। তাছাড়া পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় রাখাইন পল্লি ঘুরলে দেখা যেত প্রত্যেকটা দেড়তলা বাড়ির নিচতলায় তাঁতযন্ত্রে ব্যস্ত রাখাইন তরুণী এবং নারীরা। এভাবে তৈরি কাপড়গুলো স্থানীয় রাখাইনমার্কেটে বিক্রি করে এরা সংসার চালায়। পটুয়াখালীর একজন গবেষক ড. ফজলুর রহমানের লেখা একটা বই ‘পটুয়াখালীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। বইটাতে এসব বিস্তারিত লেখা আছে। ওখান থেকে একটা ছড়ার অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি- “রাঙ্গাবালীর রাঙ্গা ভিডা রাঙ্গা তরমুজ/মগের মাইয়া নাদুসনুদুস কাফুর বোনে সবুজ।” রাঙ্গাবালী নবগঠিত উপজেলা। ওখানে প্রচুর তরমুজ চাষ হয়। আপনি গেলে আস্ত তরমুজ ক্ষেত থেকে তুলে খাইয়ে দেবে বিনা পয়সায়, টাকা সাধলেও নেবে না। যাইহোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ওখানকার মগ তথা রাখাইন মেয়েদের তাঁত বুননের বর্ণনা আছে ছড়ার এ অংশে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, কুচবিহারের স্থানীয় আদিবাসীরা তাঁতে হাতপাকানো। তাই তাঁতকে এখন মূলত একটা উপমহাদেশীয় সার্বজনীন প্রাচীন পেশা বলা যেতেই পারে। বাংলার ছেলেবুড়োর ঘুমপাড়ানি গল্পগানের বড় অনুষঙ্গ তাঁত। প্রকাশ্য কিংবা গোপনে। না হলে চাঁদের বুড়ি কেন শুধু শুধু চরকা কাটতে যাবেন চাঁদের বুকে হাঁটু তুলে বসে? জানা যায়, Oil your own machine অর্থাৎ ‘নিজের চরকায় তেল দাও’ প্রবাদটির পত্তন এতদাঞ্চলের তাঁতশিল্পের ইতিহাসের সাথে মিশে আছে।
এখন খুব বেশি তাঁতি টিকে নেই। কারণ, কোনো বাবা-মা এখন আর সন্তানকে ঐতিহ্য বজায় রাখার তাগিদে তাঁতি বানাতে চান না। প্রতিষ্ঠার প্রধান উপায় এখন চাকরি। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-পাবনা-সিরাজগঞ্জসহ যমুনার উপকূলঘেঁষে অল্প কিছু পরিবার তাঁতপেশায় জড়িত। রাখাইন, মারমারাও কেউ কেউ এখনও তাঁতে কাপড় বোনে- সেগুলো আঞ্চলিক বাজার এবং বিভিন্ন মেলায় বিক্রি হয়।
ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহ্য বহন করে এতদাঞ্চলের তাঁতশিল্প। এর শিল্পীরা এদেশে এখন বড় অবহেলিত। বংশীয় ঐতিহ্যের পেশা ছেড়ে সেজন্যই চাকরিমুখো হচ্ছে এদের উত্তরসূরিরা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন তাঁতির সন্তানদের এন্তার দেখা মেলে। যুগে যুগে এরা স্থানীয় জমিদার, জোতদারদের অত্যাচার থেকেও বেঁচে থাকতে পারেনি। ১৯৯৪ সালের দিকে সালমান শাহ অভিনীত একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয় বিটিভিতে- ‘ইতিকথা’ নামে। তা ছিল তাঁতশিল্পেরই ইতিকথা । সে নাটকেই প্রমাণ মেলে তাঁতশিল্পের বিস্তার ইংল্যান্ড পর্যন্ত ঘটেছে সেই ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে।
(লেখক – শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ৩য় সেমিস্টার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।)