রেজওয়ান আহমেদ
এই বাঙলার সামাজিক সম্পর্কের জাল বিশ্বের অন্য সব অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ় বন্ধনে বাঁধা। বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজবাস্তবতা সদর্পে বিরাজমান। গানও এর ব্যতিক্রম নয়। লোকগীতিতে বোধকরি একটু বেশিই প্রাধান্য পায় সমাজ। মানুষের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে এমন কিছু সম্পর্ক থাকে যেগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর রসিকতা। এরকম কিছু মধুর সম্পর্ক হচ্ছে দেবর-ভাবি, ননদ-বৌদি, শ্যালিকা-দুলাভাই, নানা-নাতি ইত্যাদি। এর মধ্যে শেষেরটি, অর্থাৎ নানা-নাতির সম্পর্ক সবিস্তারে দেখানো হয় গম্ভীরা সঙ্গীতে। গম্ভীরা এ লেখার জন্য অপ্রাসঙ্গিক বিধায় বাঙলা লোকগীতিতে উল্লেখিত অন্য সম্পর্কগুলোর স্বরূপ দেখানোর প্রয়াসেই লিখছি। প্রসঙ্গত পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া এবং তৎসংলগ্ন অন্যান্য জেলায় কিছু চটুল, দ্ব্যর্থবোধক আপাতদৃষ্টিতে বিকৃত রুচির গান প্রচলিত রয়েছে। সেগুলোও এ লেখায় অপ্রাসঙ্গিক।
১. বৌদি-ননদ
বলি ও ননদী আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে
ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে
লো ননদী
ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে!
ইস্টিশনের বাবুর মতো মিষ্টি পান খেয়ে
দেখেন তোরে দেখতে কেমন
ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে!
আমি তাই ত বলি চুলবেঁধে সাজ
হলুদরাঙা শাড়িতে!
ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে
লো ননদী
ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে!
পাঠাই কারে জেলে পাড়ায় – আনতে হবে মাছ
আর কিনতে হবে রাঙা আলু
পটল গোটা পাঁচ!
আবার এমন সময় মিনসে দেখি
সাবান ঘষে দাড়িতে!
ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে
লো ননদী
ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে!
হিসেবের চুলোয় হিসেবমতোই রান্না চড়ে রোজ। অথচ মধ্যবিত্ত সংসারে অতিথি এলে সে হিসেব এলোমেলো করতে দোষ নেই। আর অতিথি যদি হয় ননদের বর, তখন ত আরো দোষ নেই। দু’মুঠো চাল, মাছ-সব্জির পদ কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারে বাঙলার কুটুমশ্রেণির অতিথিরা। এদের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আদরের ননদের সাথে রসিকতা করতে বৌদিরা ছাড়ে না। খাবারের পরে হবে মিষ্টি পানের আপ্যায়নপর্ব। গোল বাঁধে পতিকে নিয়ে। তিনি অতিথি আসার খবর শুনে দাড়ি কাটতে উদ্যত। কাজের সময় ধীরস্থির স্বামীকে ‘মিনসে’ বলে ভর্ৎসনা করাটাও বাঙালি বধূর স্বাভাবিক আচরণ।
২. বৌদি-দেবর
ওরে হাড় মোর জ্বলিয়া গেল দেওরা রে!
তোমার দাদার পাল্লায় পড়ে
জাতকুলমান গেলো রে!
হাউস করে দিছে বিয়া
পাঁচ ভাইয়ের সংসারে
ভাসুর-শ্বশুর-দেওরা ভালো
মিনসে কপালপোড়া রে
হাড় মোর জ্বলিয়া গেলো দেওরা রে!
ইলশা মাছের মাথা দিয়ে
হবে কচুশাক
তাইতো ভাসুর দিলেন টাকা
করতে বাজারহাট।
মিনসে আনে লেঠা মাছ আর
তেলাকচুর পাতা রে
হাড় মোর জ্বলিয়া গেলো দেওরা রে!
ভাইয়ের ছেলের মুখে ভাতে
গেলাম বাপের বাড়ি।
মিনসে আমার মাকে বলে
কেমন আছেন দিদি রে
হাড় মোর জ্বলিয়া গেলো দেওরা রে!
বাউল গোষ্ঠ গোপাল দাসের এই গানটিতে নারীর বেদনা পুরুষের কণ্ঠে ধ্বনিত। বেদনাটা তার অপদার্থ-অবোধ স্বামীর নানাবিধ অস্বাভাবিকতা নিয়ে। স্বামীটি তার সংসারবিমুখ। তা নিয়ে বউয়ের দুঃখের অন্ত নেই। বাজার করতে গিয়ে উল্টাপাল্টা মাছ-সব্জি নিয়ে আসা আর সামাজিক আচারে গিয়ে শাশুড়িকে দিদি সম্বোধন করার অপরাধে (!) অপরাধী এ গানের মিনসে। পাঁচভাইয়ের শ্বশুরালয়ে এ অভাগী নারীর স্বামীভাগ্য খুব সুবিধের নয়। ভর্ৎসনার সুরে দেবরের কাছে নিজের দুখের কাহিনি বলার মধ্যে বিরক্তি, রাগ, রসিকতা – সবকিছুরই ঘ্রাণ পাওয়া যায়!
৩. ননদ-বৌদি
বউদিদি গো! আমার আইবুড়ো নাম আর ঘুচলোনা
কতো ফাগুন ত এলো তবু আমার লগন এলো না!
বউদি আমার লক্ষ্মী তুমি আমি সে ত জানি
আমার কথা সময় করে ভেবো একটুখানি
তুমি ভেবো একটুখানি।
এরপর বুড়ি হলে বিয়ে ত কেউ করবে না!
আলতা পরিয়ে দেবো বেঁধে দেবো চুল
সব কাজ করে দেবো হবে না তো ভুল
আমার হবে না তো ভুল।
শুধু দাদাকে একবারটি বুঝিয়ে তুমি বলো না!
বৌদি-ননদের সম্পর্ক বাস্তবতা আর পৌরাণিক কাহিনির নিরিখে কেমন, তা নিয়ে মতভেদের অবকাশ রয়েছে। তবে সম্পর্কটার মিষ্টতার পরিধি অপরিমেয়। সেজন্যই বউদির কাছে আদরের ননদ অনেক বায়না-আবদার করতে পারে। সে বায়না যদি ননদের নিজের বিয়ের জন্য হয়? এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ‘বউদিদি গো’ গানটি। আইবুড়ো ননদের সদগতি করবার ভার যে লক্ষ্মী বৌদির ওপরও বর্তায়!
৪. শ্যালিকা-দুলাভাই
চিড়া কুডি চিড়া কুডি বইল গাছের তলেতে
ও দিদি কুডুম আইসাছে বাড়িতে!
আগ দুয়ারে কুডুম আইসা পানের বাডা চায়
পিছ দুয়ারে বড় বইনে ঘোমটা দেয় মাথায়!
বড় বইনে চিড়া কুডে মাইঝা বইনে ঝাড়ে
ছোট্ট বইনে লৌড়দ্যা গেলো দেইখ্যা আইলো তারে!
সন্ধ্যাবেলা অতীত আইলে বসতে দিমু পিঁড়া
জলপান করিতে দিমু শালি ধানের চিড়া!
বিবাহ নতুন আত্মীয়-পরিজন তৈরি করে। আমাদের বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার খুব সুনাম। শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে শ্যালিকাদের আপ্যায়ন পাওয়া যায় বেশ। কুটুম শব্দটার অর্থের সম্প্রসারণ ঘটেছে এ গানে। আঞ্চলিক রূপমূলের ব্যবহার দেখা যায় গানটিতে। মাদল ব্যান্ডদলের সংগীতায়োজন এবং কোরাস মনোমুগ্ধকর।
৫. বৌদি-ননদ
কী কমু গো ও ঠাকুরঝি লাজে যে যাই মইরে
তোর দাদার লাইগা পরাণ আমার কেমন কেমন করে!
আমি রইলাম একলা ঘরে দাদায় পরবাসে
আদর সোহাগ কে করিবো তেমনি ভালোবেসে?!
হায় বক্ষ আমার দুরুদুরু চক্ষেতে জল ঝরে রে!
তারে কে খাওয়াইবো রাইন্ধা বাইড়া শুক্তা ঝালে-ঝোলে
আর মান-অভিমান কে বাড়াইবো অম্লমধুর বোলে?!
তারে হাতে ধইরা কইছিলাম গো খবর কিন্তু দিও
কথা রাখো মাথা খাও চিডি কিন্তু দিও!
এখন শুন্য ঘরের শুন্য শয়ান খা খা খা করে রে!
এ গানটিতেও মাদল ব্যান্ডের অংশগ্রহণ আছে। স্বামী-স্ত্রীর অবস্থানগত দূরত্বের বিষয়টি এ গানে ফুটে উঠেছে। স্ত্রীটি তার ননদকে বোঝাচ্ছে এ দূরত্ব তার মনে কী কী প্রভাব ফেলছে। স্বামীর ভালোবাসা, উপস্থিতি যেমন সে অনুভব করছে তেমনি চিন্তিত হয়ে পড়ছে বিদেশে সে পছন্দের পদ চাইলেই খেতে পারবে না – এই বাস্তবতায়!
গানের কথাকে বলা হয় গীতিকবিতা। সে অর্থে গীতিকার একজন কবি। সাহিত্যিক মনন যাদের থাকে তাদের সকলে কবিতা লিখে কবি হন, এমনটা বলা যায় না। তবে সাহিত্যিক মাত্রই কবিমননের অধিকারী। আর কবিতা হচ্ছে সাহিত্য তথা জীবনপ্রকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। কারণ, এক-দু’লাইনের একেকটা চিত্রকল্প জীবনের একেকটা বাস্তবতা ধারণ করতে সক্ষম। যেমন – “নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না?” – হেলাল হাফিজ। গানেও তেমনি জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। গান যেমন বিনোদনের মাধ্যম, তেমনি গানে আছে জীবন, প্রতিদিনের কড়চা, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, প্রেম, বেদনা, বিরহ, চিন্তা, ভাবনা, দর্শন – এমনকি যুদ্ধও। একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানে গানে মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রেরণার কথা কে ভুলবে?
(লেখক – শিক্ষার্থী, স্নাতক তৃতীয় সেমিস্টার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়)