অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।।
আপনি কি কোকাকোলা হতে চান ?
প্রতিবছর শত শত বই, প্রবন্ধ লিখা হয়; এমনকি প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কিভাবে আপনি নিজকে “প্যাকেটজাত” করবেন। প্যাকেটে এমন কিছু ভরতে পরামর্শ দেয়া হয় যা ভরলে আপনাকে আপনার চেয়ে “মোটাতাজা”(more of who you are) দেখাবে। নিজকে নিজে পণ্যে রূপান্তর (self-commodification) করবেন কিনা পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথমেই এ ব্যাপারে নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে(Lair,D.J;2014)। অনেক সমালোচক বলেন পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিকে পণ্যের জায়গায় প্রতিস্থাপন করে মানুষকেই পরাভূত করে । মিডিয়া, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া (Facebook Twitter, Instagram, YouTube …) এমন একটি বাস্তবতা ব্যক্তি সম্পর্কে তৈরি করে যার কারণে দেখা যায় রাতারাতি কোন রাজনৈতিক নেতা নেতৃত্বের মানবহিতৈষী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও গুণাবলী ব্যতিরেকেই পীর বা সাধু বাবার ন্যায় বহুল পরিচিত ব্রান্ডের পণ্যের জায়গায় সমাসীন হন। তাদের ভক্ত কেবলমাত্র অনলাইনে সীমাবদ্ধ থাকেনা; বাস্তব জীবনেও তাঁরা হিরো (আলম !) হয়ে যায় এবং বিরাট এক সমর্থক গোষ্ঠী তাদের তৈরী হয়ে যায়(Banet-Weiser Sarah;2012)। সাম্প্রতিক কালের অত্যন্ত প্রভাবশালী ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বিখ্যাত লোকদের আত্মজীবনীসমূহ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। তাঁর ধারণা বেশিরভাগ আত্মজীবনী লেখা হয়েছে পরিপূর্ণ বয়সে অথবা জীবন সায়াহ্নে এসে ব্যক্তি যে অবস্থায় পৌঁছে তার সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো করে পুর্ববর্তী জীবনকে রিকনস্ট্রাক্ট করে। অনেকটা পরিসংখ্যানের ইন্টারপোলেশন অথবা এক্সট্রাপোলেশন এর মত। ( শেখ মুজিবুর রহমানের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” এই ধারণা থেকে বাদ পড়বে, কারণ বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন সায়াহ্নে অথবা জীবনের পরিপূর্ণতায় এসে এই আত্মজীবনী লিখেননি। তিনি “বঙ্গবন্ধু” বা “জাতির জনক” হওয়ার অনেক আগেই এই অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছিলেন। বইটি প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৩৭ বছর পরে। নিশ্চিত করেই বলা যায় এই আত্মজীবনীতে একটি বাক্যও রিকনস্ট্রাকটেড না। )
ইদানিংকালে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের বড় হাতিয়ার হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত দৈনন্দিন জীবনযাপনের তথ্য অথবা নিজস্ব ভাবনা ( ফিল্টারকৃত ) অন্যের জন্য অবমুক্ত করে। এটা ব্যক্তি ব্র্যান্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যক্তি জীবনযাপনের যে সকল দৈনন্দিন তথ্য ও নিজস্ব ভাবনা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়াচ্ছে সেগুলি কি পরিপূর্ণ সত্য, নাকি আংশিক সত্য, নাকি বানানো সত্য? এ প্রসঙ্গে আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যারের একটি গল্প মনে পড়ে গেল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মার্কেটিং এর ছাত্র হলেও আমার আগ্রহের বিষয় ছিল সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি। মার্কেটিংয়ের ক্লাস করার চেয়ে সুযোগ পেলে অন্য বিষয়ের বিখ্যাত অধ্যাপকদের ক্লাসে হাজির থেকেই বেশি আনন্দ পেতাম। তখন এর রেওয়াজটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ছিল, বিশেষ করে সাবসিডিয়ারি ক্লাসে। আমার বিভাগের ড. আব্দুল্লাহ ফারুক স্যারের ক্লাস করার জন্যও অন্য বিভাগের ছাত্ররা চলে আসতো। তখন মার্কেটিং বিভাগ ছিল কলা ভবনের তৃতীয় তলায়। আমাদের সবগুলো ক্লাস কলা ভবনেই হত। সুযোগ পেলেই আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যারের ক্লাসে ঢুকে পরতাম। একদিন কলাভবনে ১০১৭ নম্বর কক্ষে ক্লাশ হচ্ছিল। আমরা মনোযোগ দিয়ে বিমোহিত ভাবে স্যারের বক্তৃতা শুনছিলাম। এমন সময় স্যার হঠাৎ করে বক্তৃতা থামিয়ে একজন ছাত্রকে বললেন, “আপনি একটু বাইরে গিয়ে দেখে আসুন তো ওখানে দুই ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে হাসছেন কেন”। কিছুক্ষণ পরে ওই ছাত্র ফিরে এসে স্যারকে বলল, “স্যার ওখানে তো মহিলা চারজন”। স্যার তৎক্ষণাৎ বললেন, “আমি তাহলে সত্যের অর্ধেকটা দেখেছি”। আমরা প্রায়ই সত্যের অর্ধেকটা বা অংশবিশেষ দেখি।
সচেতনভাবে এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যক্তিবিশেষের নিজের সম্পর্কে অন্যের ধারণাকে প্রভাবিত করে নিজকে “স্বাতন্ত্র্য” হিসাবে উপস্থাপন এবং প্রতিযোগীর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে স্থান করে নেয়ার চেষ্টাকেই পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং হিসেবে অভিহিত করা হয়। (চলবে)
(অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, সাবেক ভিসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কলামিস্ট ও লেখক)