১৭৫৭ অর্থাৎ পলাশী শুধু বাংলা নয়, সমগ্র উপমহাদেশই নয়, বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বছর, কারন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আর দক্ষিণ এশিয়ায় রূপো দিয়ে ব্যবসা করতে হল না, আমেরিকার রূপো ইওরোপের হাতে উদ্বৃত্ত হল। বাংলার খাজনা উদ্বৃত্ত আর আমেরিকা লুঠে রূপো সম্পদ মিলিয়ে সে বিশ্ব জয় করল। পলাশি সফল না হলে ইওরোপের বিশ্বজয়ের পতাকা ওড়ে না। বাংলার নিজামতের মীর জাফর, মীর কাশিমকে সামনে রেখে নিজেদের দেশে চাষী কারিগর হকার পশুচারকদের ওপর উপনিবেশ চাপিয়ে দেওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা সুবা জুড়ে অবর্ণনীয় লুঠ, বাজার দখল এবং সম্পদ দখল, জ্ঞান চুরি চালায়। এই সময়টাতেই বাংলা থেকে যে ব্যপক সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যার। এই সময়ের খতিয়ান লেখা হয় নি। এবং এই লুঠের প্রক্রিয়া আজও শেষ হয় নি। সাথী পলাশীর ২৬৬ বছরের খতিয়ান আমাদের নিতে হবে। এই লড়াই আমাদের সকলের লড়াই।
সাথী ১৭৫৭ সিরাজের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে অমিয় বাগচী যাকে স্টাকচারাল এডজাস্টমেন্ট নীতি বলছেন, যেটি প্রথমে বাংলায় তারপরে বিশ্বজুড়ে চালু হল তার প্রত্যক্ষ ফল ১৭৭০-এ বাংলা এবং বিহারের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ গণহত্যায় রূপান্তর হল শাসকেরা দুর্ভিক্ষ প্রশমনের চেষ্টা না করায় — জনগণের এই অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম। দুর্ভিক্ষ-গণহত্যায় সুবা বাংলার এক তৃতীয়াংশ (১০ মিলিয়ন – ১ কোটি) মানুষ মারা যান। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মারা যাওয়ায় জ্ঞান ভান্ডার মুছে যাওয়া, দক্ষতা নষ্ট হওয়া, দেশের শিল্প ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে হারিয়ে যাওয়া, মহিলাদের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে অন্তরীণ করা, কাজ কেড়ে নেওয়া আর ভদ্রবিত্তেরে ক্ষমতায়ন – এ সমস্ত কিছুই প্রত্যক্ষ করব এই সময়ে। তাই আমাদের সকলকে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে ১৭৭০ (বঙ্গাব্দ ১১৭৬) ধরে। ১৭৯৩-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঔপনিবেশিক শাসনকে আরও শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাবে। ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ় করার জন্যে দালালের ভূমিকা পালন করল নব্য জমিদার, বেনিয়া, ভদ্রবিত্তরা। বাংলা লুঠ করা সম্পদের ওপর দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ইউরোপের শিল্পায়ন হল ১৮-১৯ শতক জুড়ে। ঔপনিবেশিক শাসন টিকে থাকল দু’ভাবে – একদিকে সরাসরি সম্পদ লুঠ আর অন্যদিকে ঔপনিবেশিক মনন গড়ে তোলা যা সেই ব্যবস্থাকে মান্যতা দেয় এবং নিজের মাটি, নিজের ঐতিহ্য, নিজের সমাজ-অর্থনীতিকে হীনমন্যভাবে দেখার যুগের সূচনা করে। ফলে এই শাসকের হাত ধরে গড়ে উঠল ইওরোপ নির্ভর ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাবু সম্প্রদায়। তাই উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চার আঙ্গিনায় আধিপত্য এবং একচেটিয়াকরণের এই প্রক্রিয়াকে আমাদের সকলের উন্মোচন করাও খুব জরুরি।
লুটেরা উপনিবেশিক শক্তি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে একটা হীনমন্যতার সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে নিজেদের সার্বিক আধিপত্য কায়েম করবার স্বার্থে। মূল লক্ষ্য মগজের দখল নেয়া। লুটেরাদের ইতিহাস বিনির্মাণের জন্য এই উদ্যোগ তৃতীয় বিশ্বের সংগ্রামী জনতাকে হিম্মত যোগাবে। এটা কেবলমাত্র অতীত চারিতার বিলাস নয়। কমল কুমার মজুমদারের ভাষায় ধনুকের জ্যা সম্মুখ গতি হেতু পিছু হটে।
এই উপনিবেশ, লুঠ এবং কর্পোরেট বিরোধী চর্চায় চর্চায় আগ্রহীদের নিয়ে একটি জেনারেল বডি গঠন করা। প্রাথমিক কাজ ১৭৭০-এর সময়কে জানা এবং আজও যে লুঠ চলছে সেই ব্যাপ্তি বোঝা। এই কাজটির ভাবনার সঙ্গে আপাতত যুক্ত আছেন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষক সুমিত মজুমদার, ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড মিলটন বিশ্বাস এবং দুবাইএর মহুয়া লাহিড়ী। বাংলাভাষী অঞ্চলের প্রতিনিধি সঙ্গঠনদের নিয়ে একটা পরিচালন কমিটি তৈরি করতে হবে। গবেষণার কাজ হকার চাষী কারিগরদের কাছে নিয়ে যেতে হবে তাদের পরিবারের নত্রুন প্রজন্মকে এই গবেষণায় জড়িয়ে নিতে হবে কেননা ২০২৩-এও ২৬৬ বছরের স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট প্রক্রিয়াজাত লুঠের প্রক্রিয়া আরও ব্যপ্ত, সফিস্টিকেটেড এবং জোরদার হচ্ছে। ১৭৭০কে ভিত্তি করে সেই সমগ্র লুঠ প্রক্রিয়া আমাদের বোঝা দরকার।
আমরা উপনিবেশ বিরোধী চর্চা এবং গবেষণার পক্ষে সহায়ক দুর্মূল্য বই, ডকুমেন্ট সম্বলিত একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছি। সেটিকে জোরদার করতে হবেও।
অফিসের প্রাত্যহিক খরচ, লাইব্রেরি গড়ে তোলা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষকদের ন্যুনতম খরচ যোগানোর জন্য তহবিল সংগ্রহ অভিযান চলবে। এর আপাত নাম হবে জনভাণ্ডার।
ওয়েবসাইট তৈরি, প্রকাশনা বিভাগ চালানো, বই ছাপা, অডিও বুক তৈরি হবে। বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থাকে জোরদার করতে কারিগর চাষী হকারদের তৈরি জিনিস বিক্রি করার ব্যবস্থা থাকবে।
উপনিবেশ-লুঠ বিরোধী চর্চা কর্পোরেট বিরোধী চর্চা । ৪ হিদারাম ব্যানার্জী লেন। কলকাতা
১৭৭০/১১৭৬ গণহত্যা গবেষণা আন্দোলন ।। জনভাণ্ডার ।। অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা উদ্যম