রেজওয়ান আহমেদ
Vibrio choleri. ব্যাকটেরিয়ার একটি প্রজাতির নাম। মারাত্মক পেটব্যথা, পাতলা পায়খানা, বমিতে পানিশূন্য হয়ে মানুষ মরে পর্যন্ত যেতে পারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
কী সব বলছি?! বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হয়ে অণুজীববিজ্ঞান, ডাক্তারিবিদ্যার ইকরিমিকরি বুলি কপচাচ্ছি! খুউব খারাপ! এবার তবে বাঙলা মায়ের সুবোধ বালক হই। শব্দ আমার ভীষণ প্রিয়। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক বিশ্বাস, কাহিনির বিদগ্ধ পাঠক-শ্রোতা আমি। এর প্রতিনিধিত্বকারী একটা চরিত্র ‘ওলাউঠাবিবি’, সংক্ষেপে ওলাবিবি। ওলাইচণ্ডীও একই। ওলাইচণ্ডী হিন্দু বিশ্বাসের লৌকিক দেবী, ওলাবিবি মুসলিম বিশ্বাসে।
ফারসি دست (দস্ত) শব্দটি বাঙলায় দাস্ত হয়ে গেছে। এর অর্থ পাতলা মল। ব্যথার পেট থেকে নিচের দিকে নিঃসৃত হয়। চলতি কথায় বলা হচ্ছে ওলা।
আবার সংস্কৃত মূল √বম+অন(ল্যুট্) হয়ে বাঙলা ভাষায় বমন শব্দটি এসে বলছে আমি হচ্ছি বমি। ব্যথার পেট থেকে ওপরের দিকে উদগিরণ হয় বমির। চলতি কথায় যাকে সবাই বলছে উঠা।
এভাবেই ‘ওলাউঠাবিবি’ বলছে – তোমরা যারে Vibrio choleri কচ্ছো তার সঙ্গে আমার ভীষণ মিল। আর এদের দুয়ের এই মিলটা দেখাতেই আমার মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট বনে যাওয়া।
‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের মকবুল বুড়োর কথা মনে পড়ে প্রায়ই। ভরদুপুরে ছাতা মাথায় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে যিনি ডাকছিলেন – আরে তোমরা কে কোথায় আছো? গেরামে ওলাবিবি আইছে! এ উপন্যাসে তৎকালীন গ্রাম্য মুসলিম সমাজের বাস্তবতা দেখানো হয়েছে। হিন্দুধর্মের লোকবিশ্বাস প্রতিফলিত হয়নি। হলে ওলাবিবি নামের জায়গায় হতো ওলাইচণ্ডী।
ওলাবিবি হোন বা ওলাইচণ্ডী – একজন নন বরং এরা সাতবোন। ওলাবিবি ছাড়াও রয়েছেন আসানবিবি, ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি আর ঝেটুনেবিবি। তেমনি ওলাইচণ্ডীর বোনেদের প্রচলিত নামও বাহারি – চমকিনী, সনকিনী, রঙ্কিনী, জামমালা, বিলাসিনী, কাজিজাম, বাশুলি, চণ্ডী! শাস্ত্রে বলা হয় সপ্তমাতৃকা ব্রাহ্মণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বরাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, নারসিংহীদের জাত পূর্বোক্ত বোনেরা যদিও সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে সবচে বেশি প্রভাবশালী ওলাবিবি, যার প্রভাবের প্রমাণ কলেরা রোগ। মহামারির আকারে জনপদ নিশ্চিহ্ন করতে কলেরার জুড়ি মেলা ভার। দক্ষিণ ভারতের মারাম্মা ও আনকাম্মা এবং উড়িষ্যার যোগিনী দেবী কলেরার দেবী বলে পূজিত। সে বিচারে ওলাবিবির প্রতিরূপী দেবী এরা।
ত্রিলোচনা হলুদবরণ ওলাবিবির দুহাতের তারা পূজারিমুখি হয়ে থাকে। কোলে একটি শিশু থাকে। যেন দেবী আশীর্বাদ করছে। সন্দেশ, বাতাসা, পানসুপারিতে তার পূজা দেয়া হয় যখন কলেরায় আক্রান্ত হয় লোকালয়বাসী। এ পূজাকে মাঙন বলে। সেই যে হিন্দি মাঙ্ ধাতু! সেখান থেকে এসেছে মাঙন। প্রসঙ্গত মাগনা অর্থাৎ বাকিতে, বিনামূল্যে, মুফতে কোনো কিছু পাওয়া বা নেয়া, যেখানে স্বত্ব ত্যাগের বিষয়ও জড়িত, সেক্ষেত্রেও এরূপ ব্যুৎপত্তি, অর্থাৎ মাঙ্ ধাতুর প্রভাব।
১৯৬৪ সালের গ্রামীণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার চিত্রে ওলাবিবির কুকুরের আকৃতি ধারণ করে আসার বিশ্বাসের বর্ণনা পাই জহির রায়হানের কলমে। একজন লেখক তাঁর সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁর কলমের প্রতি মিলিলিটার কালিতে। কখনো কখনো সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তীও হন লেখক। এখনো দুই বাঙলার গ্রামাঞ্চলে আবহমানকালের ভ্রান্ত বিশ্বাস মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সময়ে চলে এসেও পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে কেউ হন ভীত, কেউবা প্রীত। তবু দিন-রাত আসে এই আকাশে-বাতাসে। হাজার বছর ধরে।(লেখক – শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ৩য় সেমিস্টার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।)