সুইটি বণিক।।
পৃথিবীকে চিরবিদায় দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর; কিন্তু তাঁর গান এখনও ফিরছে মানুষের মুখে মুখে।
৩০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্রের অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর; মানুষকে ভাসিয়েছিলেন আবেগের স্রোতে। আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পুরেছেন নিজের ঝুলিতে।
এন্ড্রু কিশোরের স্মরণে তার জনপ্রিয় ১০টি গান নিয়ে সাজানো হলো এ প্রতিবেদন- এবং এন্ড্রু কিশোরের জীবনী সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম!
১. জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প
১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভেজা চোখ’ চলচ্চিত্রে মনিরুজ্জামান মনিরের কথা ও আলম খানের সুরে এ গানে কণ্ঠ দেন এন্ড্রু কিশোর। শিবলী সাদিক পরিচালিত এ চলচ্চিত্রের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও চম্পা।
২.হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস
সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের কথা ও আলম খানের সুরে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের এ গানে কণ্ঠ দিয়ে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে শ্রোতামহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের পরিচালনায় ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে আনোয়ার হোসেন, প্রবীর মিত্র অভিনয় করেছেন।
৩. ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে
মনিরুজ্জামান মনিরের কথায় ও আলম খানের সুরে গানটিকে ‘প্রাণ সজনী’ চলচ্চিত্রের এ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। ছবিটি পরিচালনা করেন জহিরুল হক।
৪. আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি
প্রয়াত সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রের গান এটি। ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি পরিচালনা করেন বেলাল আহমেদ। অভিনয় করেছেন জাফর ইকবাল, কাজরী।
৫. বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে
এন্ড্রু কিশোরের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির গানে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা। এ গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। তোজাম্মেল হক বকুলের পরিচালনায় ১৯৮৯ সালে ছবিটি মুক্তি পায়।
৬. ভালো আছি ভালো থেকো
কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা থেকে গানটির সুর করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
৭. তুমি মোর জীবনের ভাবনা
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে ‘আনন্দ অশ্রু’ চলচ্চিত্রের এ গানে কনকচাঁপার সঙ্গে যৌথভাবে কণ্ঠ দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। ছবিটি ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়।
৮. সবাই তো ভালোবাসা চায়
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায়, আলম খানের সুরে ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সারেন্ডার’ চলচ্চিত্রের এ গানে সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে যৌথভাবে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। ছবিটি পরিচালনা করেন জহিরুল হক।
৯. আমার বুকের মধ্যেখানে
১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নয়নের আলো’ সিনেমার এ গানে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে কণ্ঠ দেন তিনি।
১০. বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোরের গানের ঠোঁট মিলিয়েছেন নায়ক জাফর ইকবাল।
এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ (মঞ্চনাম এন্ড্রু কিশোর হিসেবেই অধিক পরিচিত; ৪ নভেম্বর ১৯৫৫ – ৬ জুলাই ২০২০) প্লেব্যাক সম্রাট। তিনি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন, যে’জন্য তিনি ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে “জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প”, “হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস”, “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে”, “আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি”, “আমার বুকের মধ্যে খানে”, “আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন”, “ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা”, “সবাই তো ভালোবাসা চায়” প্রভৃতি।
রাজশাহী কলেজে এন্ড্রু কিশোর: জন্ম নামএন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ জন্ম৪ নভেম্বর ১৯৫৫।রাজশাহী, বাংলাদেশ মৃত্যু ৬ জুলাই। ধরন-লোকসঙ্গীত, পপ, চলচ্চিত্রের গান। সঙ্গীত শিল্পীর-কার্যকাল১৯৭৭–২০২০।
কিশোর ছয় বছর বয়স থেকে সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি রাজশাহী বেতারে নজরুল, রবীন্দ্র, লোকসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান শাখায় তালিকাভুক্ত হন। চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম গান মেইল ট্রেন (১৯৭৭) চলচ্চিত্রের “অচিনপুরের রাজকুমারী নেই”। তিনি বড় ভাল লোক ছিলেন (১৯৮২) চলচ্চিত্রের “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস” গানের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি সারেন্ডার (১৯৮৭), ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর (২০০৭) ও কি যাদু করিলা (২০০৮) চলচ্চিত্রের গানের জন্য আরও সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি পাঁচবার বাচসাস পুরস্কার ও দুইবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
এন্ড্রু কিশোর ১৯৫৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মাতা মিনু বাড়ৈ রাজশাহীর একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন ।মায়ের কাছে পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়েছিল। তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে রাজশাহী। তার মাতা ছিলেন সংগীত অনুরাগী, তার প্রিয় শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার। প্রিয় শিল্পীর নামানুসারে তার সন্তানের নাম রাখেন ‘কিশোর’। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেই তিনি সংগীতাঙ্গনেই পা রাখেন।
এন্ড্রু কিশোর আব্দুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে প্রাথমিকভাবে সঙ্গীত পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান শ্রেণিতে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন।
এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রের “অচিনপুরের রাজকুমারী নেই” গানের মধ্য দিয়ে। তার রেকর্ডকৃত দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রের “ধুম ধাড়াক্কা”। তবে এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রতীজ্ঞা চলচ্চিত্রের “এক চোর যায় চলে” গানে প্রথম দর্শক তার গান শুনে এবং গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি অন্যান্য প্লেব্যাক গান রেকর্ড করেন যেমন ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘ভালবেসে গেলাম শুধু’ এর মত জনপ্রিয় সব গান।
কিশোর চলচ্চিত্রের গানে প্রথম সম্মাননা লাভ করেন বড় ভাল লোক ছিল (১৯৮২) চলচ্চিত্রের জন্য। মহিউদ্দিন পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে সৈয়দ শামসুল হকের গীত ও আলম খানের সুরে “হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস” গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই গানের জন্য তিনি প্রথমবারের মত শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের গীত ও সুরে নয়নের আলো চলচ্চিত্রের তিনটি গানে কণ্ঠ দেন, সেগুলো হল “আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি”, “আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন” ও “আমার বুকের মধ্য খানে”। এটি বুলবুলের পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের নির্মাণব্যয় কম থাকার কারণে তিনি সৈয়দ আবদুল হাদী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনদের মত বড় ও ব্যস্ত শিল্পীদের নিতে পারছিলেন না। ফলে পুরুষ কণ্ঠের জন্য এন্ড্রু কিশোর এবং নারী কণ্ঠের জন্য সামিনা চৌধুরীকে নির্বাচন করেন। তবু অভিনেতা জাফর ইকবালের ঠোঁটে তার তিনটি গানই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৮৭ সালে তিনি সারেন্ডার চলচ্চিত্রে আলম কানের সুরে তিনটি গানে কণ্ঠ দেন, সেগুলো হল “সবাইতো ভালোবাসা চায়”, “গুন ভাগ করে করে”, ও “ঘড়ি চলে ঠিক ঠিক”। তন্মধ্যে প্রথমোক্ত গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই গানের জন্য তিনি তার দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।এছাড়া তিনি ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর (২০০৭) ও কি যাদু করিলা (২০০৮) চলচ্চিত্রের গানের জন্য আরও সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
এন্ড্রু কিশোর এছাড়াও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বরাবর আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর, দিদারুল আলম বাদল, শামসুল ইসলাম নান্টু সাথে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান ‘প্রবাহ’ শিরোনামে উদ্বোধন করেন।
এন্ড্রু কিশোর লিপিকা অ্যান্ড্রু ইতির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের কন্যা মিনিম অ্যান্ড্রু সংজ্ঞা এবং পুত্র জয় অ্যান্ড্রু সপ্তক।
কিশোর ২০২০ সালের ৬ জুলাই ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেও ক্যান্সার নির্মূল হয়নি প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পীর। চিকিৎসক হাল ছেড়ে দেওয়ায় ক্যান্সার নিয়েই ৯ মাস পর ২০২০ সালের ১১ জুন দেশে ফেরেন তিনি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাজশাহীতে ছিলেন।