২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ১০:৫৫
নোটিশ :
Wellcome to our website...

আমার জীবন !

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন

পলিন অধিকারী।।

দীর্ঘ বসবাস করছি।৭৬ /সেন পাড়া /মীরপুর ১০

একাত্তরে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই সায়েন্স ল্যাব কোয়ার্টারে ঘর বাঁধা, ওখানেই পিংকার জন্ম, ওর পনের বছর বয়সে এই ঠিকানায় আগমন।চমৎকার একটা পরিবেশে দীর্ঘদিন বসবাস করে তারপর এই অচেনা মীরপুরে বসবাস করার আগে মন খারাপ হয়েগিয়েছিল।কি জানি কেমন লাগবে! তখন এই এলাকা ছিল খানা ডোবায় ভরা,ভেসাল জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখা যেত।রাস্তাঘাট ছিল না। বর্ষাকালে বেচারা কি কষ্ট করে কিছুটা হেঁটে, কিছুটা নৌকায় এসে, না খেয়ে বাড়ির কাজ দেখতেন।কিছুটা অসম্পূর্ণ অবস্থায় ৮৯ এ আমরা এখানে এলাম।মন ঠিক করে নিতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল। তবু ভাড়া বাসায় থাকতে হয়নি।তারপর একটা একটা করে গাছ লাগানো।গেইটে প্রবেশ দ্বারে ছোট্ট বকুল গাছ, তার পছন্দে লাগানো হল।আমারও বটে! ছোট বেলা থেকে কিশোরী কাল,তারপর কোয়ার্টারে রাস্তার পাশে অনেক গুলো গাছ ছিল। অজস্র ফুল বিছিয়ে থাকতো।বকুল গাছ বেশিদিন ফুল দিতেk পারেনি,যা দিত কুড়াতাম। একে ঘিরে আদরে আহ্লাদে বাগান বিলাস উঠে পড়লো তারপর নীল লতা পারুল আরও বেশি করে ওকে আঁকড়ে ধরে বিছানার মত বেগুনি ফুল বিছিয়ে ফুটতো।তারপর আছে বিশাল কামিনী গাছ।বছরে কয়েকবার অজস্র সাদা ফুল যেন ঝাপিয়ে ফোটে,মাদকতাময় সুবাসে ঘর মৌ মৌ করে। এটা আবার বারান্দা ঘেঁষে। তাই তার পরিপূর্ণ রূপ দর্শন করা, ছবি তোলা, ভিডিও করা খুব সহজ ছিল। তারপর আছে লক্ষী একটা বিশাল শিউলি গাছ,যা বারোমাস ফুল ফুটিয়ে যায়।আর শরতকালেতো কথাই নেই। পুরো উঠানটা সাদা ফুল বিছিয়ে থাকে।

তারপর আছে রংগনের শোভা।এখন দুটো গাছ লাল থোকা ফুলে সেজে আছে।এমন করে ওরা ফোটে যার সৌন্দর্য বর্ণণা করার ভাষা নেই আমার।তারপর আছে এ্যারোমেটিক যুঁই, এটা বেশিদিন আগের নয়।আর আছে মায়াবী নীলঘন্টা ফুল। তারপর আছে রোজক্যাকটাস।কমলা রংএর ফুল ফুটে আলো করে থাকে। এখন বিশাল ব্যাপৃতি তার। তারপর আছে তিনতলা পর্যন্ত বেড়ে ওঠা ক্যাকটাস গাছ।জুন জুলাই মাসে বড়বড় ফুল ফোটে।তারপর আছে কাঁঠাল গাছ, দেশী পেয়ারা গাছ, বিশাল পঁয়ত্রিশ গাছ। কাঁঠাল গাছ ফিলিমনের দেশ থেকে বীজ এনে লাগিয়ে ছিল। খাজা কাঁঠাল,বড় বড় কোয়া।পেয়ারা এত ভাল, দেশী স্বাদ খুব ভাল।জামরুল হাজার হাজার হয়।

এখানে পাখিদের অভয়ারণ্য। বুলবুলি, দোয়েল, টুনটুনি,কাঠঠোকরা, ঘুঘু, হানি সাকার আসে। সকাল বেলায় কাঁঠাল গাছে বসে ঘুম ভাঙানিয়া গান গায়, রুটিন বাঁধা। ঘুঘুরা নীড় বেঁধে আছে, পাকাপোক্ত ভাবে। কি ভাল লাগে ওদের ডাক!আর আছে বাড়তি পাওনা পাশে অন্ধস্কুলের মনোরম সবুজ পরিবেশ। ভোর বেলায় দরজা খুলে বেরুলেই সবুজ ঝাপটা চোখ মুখ সজীব করে শান্তি দেয়।

আমার ঘর অনেক সুন্দর না হলেও আমার কাছে রাজপ্রাসাদ। রেডঅক্সাইড দেয়া সিড়ি, বারান্দা একটা আলাদা ঠান্ডা আমেজ এনে দেয়।ওয়াসরুম টাইলস নেই, রান্না ঘরে টাইলস নেই, তৈরি করার পর থেকে বাড়ির বাইরে রং করানো হয়নি।তবু কোন অভাববোধ নেই আমার।আমি যে সবুজের অধিপতি। নীচে বাগান, উপরে ছাঁদ বাগান। একসময় গোলাপ ফুটিয়েছি রকমারি। তাদের বর্ণ বৈচিত্রে মুগ্ধ ছিলাম আমি। কি অপরূপা ছিল ওরা!এমন কত শত, হাজার ফুলের স্মৃতি আছে আমার মনে,আগের চুরি যাওয়া ফোনের গ্যালারীতে।

আমার বিজ্ঞানী ভোলাভালা মানুষটা, ভোলাভালা এই কারণে তিনি মোটেও বৈষয়িক ছিলেন না কিন্তু সমাজ সংস্কারক হিসেবে ছিলেন প্রথম সারির একজন।আর বৈজ্ঞানিক হিসেবে ছিলেন সার্থক।বাড়ি তৈরির জন্য শ্রমিক খাটাতে হলে গালাগালি করতে হয়, যা তিনি পারতেন না একেবারেই। সেই সায়েন্স ল্যাব কোয়ার্টার থেকে মীরপুর আসতে অনেক কাঁঠখড় পোড়াতে হতো। এমন সুন্দর রোকেয়া সরণী ছিল না তখন।বর্ষাকালে কিছুটা নৌকায় ও আসতে হতো।সারা দিন না খেয়ে কাজ দেখতে হতো।এভাবেই ৮৯ এ কিছুটা অসম্পূর্ণ ঘরে এসে উঠি।ধ একটা এলাকা!তখন এত সব দালান কোঠা, দোকান পাট ছিল না।আর আমাদের সায়েন্স ল্যাব, এলিফেন্ট রোড,হাতীরপুল,গাওসিয়া,নিউমার্কেট এলাকা ছিল বিচরণ ক্ষেত্র।পায়ে হেঁটেই এসব জায়গা ঘুরতাম।সেই সব ছেড়ে কোয়ার্টার এর সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে এমন মফস্বলে চলে আসতে কতদিন যে মন কেমন করেছে!তারপর ভাবি আমি কোনদিন ভাড়া বাসায় থাকিনি।কত পরিবারকে কত বার সংসার জীবনে হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা যেতে হয়। এখানে এসে গাছ লাগানো শুরু হলো। আস্তে আস্তে সবুজ প্রকৃতি আমাদের চারিদিকে ছেয়ে গেল। কত গাছগাছালির মাঝে আমি থাকি,যে দেখে না বলে পারে না, কি সুন্দর সবুজে ঘেরা এ বাড়ি!আজ পাঁচ বছর চলছে মানুষটা নেই। শুয়ে আছে বরিশালের সেই কাঠিরা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে। যেখানে সবুজ প্রকৃতি, পাখি ডাক, ঝরে পড়া শিউলিরা আছে। আমি বলেছি কবর নিয়ে আমার কোন ইচ্ছা বা আবেগ নেই, ঘাড়ে করে অতদুর টেনে নিও না।ঢাকায় নারিন্দায় পুতে ফেলো।

কথা হচ্ছিল আমার এই বাড়ি নিয়ে। ফিলিমন নামের গাড়ো ছেলেটি এই অসম্পূর্ণ বাড়িতে কেয়ার টেকার হয়ে এল।ছাব্বিশটা বছর হৈহৈ করে আমাদের বাড়ি আর আমাদের আগলে রেখেছিল।আমার বাড়িতে খালি জায়গায় তিনটা ঘর তৈরি করা হয়েছিল টিনশেড করে। এমন কোন কাজ ছিল না যা ফিলিমন পারতো না।রাজমিস্ত্রী, প্লাম্বার, ইলেক্টট্রিশিয়ান,গার্ডেনার ইত্যাদি ইত্যাদি! অসাধারণ একটা মানুষ ছিল।স্যার ছিল ওর দেবতা।উনি চলে যাবার আগে একুশ দিন হাসপাতালে ছিলেন, ব্রেইন স্ট্রোক করে। আমি আর ফিলিমন পালা করে ওনাকে দেখাশোনা করতাম।সেপ্টেম্বর মাসে ভোর বেলায় চলে গেলেন। আমি আর ফিলিমন পাশে ছিলাম! মসজিদ থেকে তখন আজান ধ্বনি ভেসে আসছে! আমি চোখের সামনে মৃত্যু এই প্রথম দেখলাম! কোন দীর্ঘ শ্বাস নয়,ছটফট করা নয়,হাতপা ছোঁড়া নয়।প্রাণ বায়ু কখন যে চলে গেল, বুঝতে পরিনি।চিৎকার করে কাঁদিনি,ওকে ও বারণ করেছিলাম।ধীর মস্তিষ্কে আমার দেবর, জাকে জানালাম।ওরা অনেকে এক ঘন্টার মধ্যে যাবতীয় ব্যাবস্থা করে ফেললো।ওনাকে ঘরে আর আনা হয়নি।সবকাজ আমাদের বি বি সি এস করলো।

তারপর থেকে শুরু হলো আমার একা জীবনের যুদ্ধ। ওনার অসুস্থতার মধ্যে ছেলে এসেছিল।কদিন আমরা দু’জন হাসপাতালে ডিউটি করতাম, ভাল লাগতো ওর সাহচার্য।সি সি ইউ তে উনি তখন মানুষ চিনতে কম পারতেন।ছেলে যেদিন তার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো! সে মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও তুলে রাখার প্রয়োজন ছিল। বাবার চোখ মুখ অব্যাক্ত কথা!আনন্দাশ্রু! কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে হাতে হাত রাখা!বিছানা বন্দী ছিলেন তখন।৭/৮টা বিভিন্ন যন্ত্র সংযুক্ত ছিল। পরে ও কয়েকদিন থেকে চলে যেতে হলো।এর এক সপ্তাহ পর উনি চলে যান।তারপর থেকে আমার একা জীবন। এত বড় জায়গা এত গাছ,সামলানো ভাল কেয়ার টেকার ছাড়া সম্ভব নয়। তখন স্বামী স্ত্রী এভাবেই রাখা হতো।নীচে গাছ, ছাঁদ বাগানে প্রায় পঞ্চাশ /ষাটটা টব, এসব নিয়ে হিমসিম খেতে হতো।তার উপর সংসারে একটি ছাতার মত আশ্রয় না থাকলে কর্মচারীরা বেঠিক চলতে চায়।এদের চালাতে গিয়ে জীবনী শক্তির অপচয় করেছি। প্রাণ বিপন্ন করে দেয় এদের ব্যবহার,রীতিমতো অপমানিত হতে হতে মন ছোট হয়ে যায়। এভাবেই চলছিল।

এই গাছপালা,পাশের অন্ধস্কুলের সবুজ মাঠ, ফুল বাগান দেখে আমার অভাববোধ চলে গিয়েছিল।সকাল বেলায় দরজা খুলে বের হলেই কামিনীর সুবাস ঝাপটা দিয়ে আমাকে মুগ্ধ করে, গাছের সবুজ পাতারা কি যে আনন্দে দুলে দুলে আমাকে সুপ্রভাত জানায়! এটাই স্বর্গ!!বুলবুলির কন্ঠ প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় রুটিন বাঁধা গলা সাধা শুরু করে। এ একটা পরম পাওয়া। ইদানীং ঘুঘু দম্পতি ডেকে যায়।একটা হলুদ পাখি মাঝে মাঝে আসে। দোয়েল শিস্ দেয়।এ বাড়ি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। লতা-পাতায় এমন ভালবাসার বন্ধন!আমি ভাবতাম আমার শেষ যাত্রা এখান থেকে হবে। সেটাই কাম্য ছিল কিন্তু আমার ভাগ্য বলে, তা নয়। আমাকে চলে যেতে হবে চার দেয়ালের মধ্যে। সেখানে আছে অখণ্ড নিরাপত্তা আর এক বিশাল আকাশ। আর কিছু নয়।অনেকদিন ধরে আমি আমার এই বিশাল সবুজ চত্বরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, চোখের জলে! আমি বলি,” পারলাম না, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমাদের জড়িয়ে ধরে থাকতে!”রূঢ় বাস্তব আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, তোমাদের কাছ থেকে দুরে, চারটে দেওয়াল শুধু থাকবে আমায় ঘিরে। “মানুষতেো কিছুই ভাবে, সব কি বাস্তবে ঘটে!রইলো আমার জংগলগড়,আমার পাখির গান,আমার ফুটে থাকা ফুলেরা। আজ আমি বড় নিঃস্ব হয়ে, ভিকারির মত চলে যাচ্ছি। রইলো আমার ফুলের ছবি তোলা, আমার সুন্দর পাতা বাহাররা,রইলো তাদের বর্ণবৈচিত্র, পাখিদের কলকাকলি ভিডিও করা, ৬/৭ বছর যারা আমার দুঃখ ভুলে যাওয়া সাথী, তাদের ছেড়ে চলে যাই।ফেসবুকে পোস্ট দেবার মত আর রইলো না কিছু। নিঃশ্বাস বন্ধ করা কষ্ট সয়ে নিতে নিতে চলে যাবার সময় হয়ে যাবে।হায়রে রূঢ় বাস্তব!!

মৃত্যুর আগে এযেন আর এক মৃত্যু! ছিলাম প্রকৃতির সম্রাজ্ঞী, হতে চলেছি নিঃস সর্বহারা।এটা মেনে নিতে নিতে চলে যাবার সময় হয়ে যাবে। চার দেওয়ালে বন্দী হব। কে যেন ডেকে বলে, ” হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোন খানে।নোঙর তোল তোল, সময় যে হলো হলো!এটাই নিয়তি! মানুষের ভাবনা আর বাস্তবের কোন মিল হয় না।হয়তো নতুন ঘর সুন্দর, আধুনিক সব কিছু কিন্তু আমার এ ৩০/৩২ বছরের পুরনো বাড়ির সব কিছু আমার বড় প্রিয়।এর জানালা,দরজা,মোজাইক, সব পুরানো।হোক পুরানো তবু তারা আমার বড় প্রিয়। এবাড়ির প্রতিটা গৃহ কোণ যে আমার প্রিয়। আমি চলে যাবার পর পাখিরা কি আমায় খুঁজে ফিরবে?আমার গাছপালারা কি বুঝতে পারবে যে আমি নেই, কোনদিন আমার পায়ের চিহ্ন পড়বে না। আমার প্রিয় বারান্দা কি ভোর বেলায় ডেকে বলবে, “ওঠ, হাঁটবে না?” সেই লেফট রাইট হাঁটাতো আর হাঁটতে পারি না।সকাল হলে নিক্যাপ বেঁধে ছাঁদে না গেলে চলে না।আবারও নীচে শিউলি তলায় বারো মাস কিছু ফুল পড়ে থাকে, রঙন,রোজ ক্যাকটাস,রেড জিঞ্জারের ঝোপ,ক্লেমেটিসের সুবাসিত ঝাড়, বাগান বিলাসের ছড়িয়ে থাকা রং আরও কত কত সবুজ! বাড়ির প্রবেশ দ্বারে বিশাল বকুল গাছকে ঢেকে ফেলেছে বাগান বিলাস আর নীল লতা পারুল। বকুল গাছ আর কোন দিক দিয়ে মাথা তুলে ফুল ফুটাতে পারে না। জীবনে নিজের মত করে সায়েন্স ল্যাব কোয়ার্টার থেকে বাগান শুরু করেছিলাম।চওড়া কার্নিশ ছিল, ওখানে। অনেক টব রাখা যেত।তখন বেশি চন্দ্রমল্লিকা লাগাতাম। নিজে মাটি, সার হাতদিয়ে ইচ্ছে মত নেড়ে চেড়ে নখের অসুখ বাধিয়েছিলাম।তবে চেয়ে থাকার মত বাগান হতো।উননব্বই এ নিজের বাড়িতে ধীরে ধীরে এই জংগলের সৃষ্টি করে ছিলাম। ফিলিমন আর আমি যেখানে যেটা পারতাম পুতে দিতাম।এই যে কাঁঠালচাঁপা গাছ আদরে আহ্লাদে মাটি থেকে ছাঁদে চলে গিয়েছে এটাও ফিলিমন লাগিয়েছিল।উনি কেবল বলতেন যা লাগাবে একটু শৃঙ্খলাবদ্ধ করে কর!আমরা নিজের ইচ্ছে মতই করতাম। এবার সবাই কেমন যেন অজস্র ফুল ফুটিয়ে গেল!বিশাল ক্যাকটাস যাকে আমি পারিজাত বলি ও এত ফুল কোনদিনই দেয়নি।এখানে যখন বিশাল দালান কোঠা হবে তখন নাজানি ওদের কত কষ্ট আর খরচ হবে এই ক্যাকটাসটাকে কেটে ফেলতে। উনিতো দৈর্ঘপ্রস্থের কোন ধার না রেখে বেড়ে গিয়েছেন।রংগন দুটো থোকা থোকা লাল ফুলে ভরে আছে! ক্লেমেটিস ও যতটা পারা যায় ফুটে সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। কামিনী বিশাল ডালপালা ছড়িয়ে কি যে সুবাস ছড়িয়ে দেয়।ও আমার বারান্দায় সংলগ্ন বলে ওর সৌন্দর্য আর সুবাস তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি।আর আছে ফিলিমনের লাগানো বিখ্যাত কাঁঠাল গাছ । খাঁজা কাঁঠাল ছাড়া আমরা খেতাম না,বিশেষ করে গৃহকর্তা।বড় বড় কোয়ার কাঁঠাল ছিল, যা আমাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু প্রিয়জনকে পরিতৃপ্ত করেছে।একটা দেশী পেয়ারা গাছ আছে। যার পেয়ারা অপূর্ব স্বাদের। গাছভরে পেয়ারা হয়।এখন সময় আমরা আর বুলবুলিরা উপভোগ করি।এত ফলন হয় যে পেকে হলুদ হয়ে নীচে পড়ে থাকে। কোন শিশু, কিশোর নেই বলে এই দশা।উনি বলতেন পাখিদের জন্য রেখ।বিশাল বিচিকলার ঝাড় যার পাতা দিয়ে পাতুড়ি হতো!কি যে উপাদেয় এক রান্না! বরিশাল, ফরিদপুর ছাড়া বিশেষ পরিচিত নয় অন্যদের কাছে। গন্ধবাদালি শাকের লতা ডিসের তার বেয়ে পৌঁছে গিয়েছে অচেনা ৫/৬ তলা দালানের ছাঁদে, মনে হয় ওরা ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে।আমার সিংহ দুয়ার ওওও এখন আর আমার নয়! কি যে বিশাল এক ঝোপঝাড় তৈরি করেছে!বকুল, বাগান বিলাস আর লতা পারুল কেউ কারো কথা না শুনে নিজের মত বেড়েছে।ওখানে ও সৃষ্টিছাড়া জংগল তৈরি হয়েছে। মানিপ্ল্যান্ট সুয়ারেজ লাইন থেকে রস নিয়ে কি বিশাল পাতার সৌন্দর্য ছড়াতো,ওটা শেষ। সুয়ারেজ আটকে এর রহস্য ভেদ করে দেখা গেল পাইপ জুড়ে শিকড় বাকড়।

অনেক শূন্যতা হৃদয় জুড়ে! অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেন, “মনে কর মরে গেলেতো কিছুই সাথে যাবে না।” এটা হচ্ছে আমার প্রথম মৃত্যু! অবশ্যই তাই।আবার বলে ওখানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে! এটা কি নতুন কিছু মানিয়ে নেবার বয়স!

পাশে আমার বাল্যবন্ধুর বাড়ি, বেচারীর সুন্দর বাগান ছিল। নিজেদের যত্ন নেয় কে!কত কত গাছ শুকিয়ে পড়ে আছে। ওটাও আমার জন্য একটা বড় শিক্ষা! বয়স হয়েছে, শক্তি কমেছে,হাঁটু বিদ্রোহী। আর কত এবার ক্ষেমা দাও।হাত, পা কোলে নিয়ে চারদেয়ালের মাঝে বসে ঝিমাও।ফ্ল্যাটে দোতলা নির্বাচন করা হয়েছিল।তখন আমার এক পুত্র আমাকে বলেছিল, গাছপালা হারাতে যাচ্ছেন, অন্ততঃ আকাশটাকে কাছে পেতে উপরে যান।আসলেই বড় সঠিক নির্বাচন হল।নতুবা বিরাট ভুল হয়ে যেত।কেবল ভাবনা হয় ঐ সবুজ গেটদিয়ে শেষ বের হওয়ার সময়টা কি অনুভূতি হবে! এই ভাঙাচোরা রাস্তার গলিটা যে বড় প্রিয়!কত শত পদচারণা, আমার, গৃহকর্তার, পিংকার!একজন তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিল,কত দিন ও বাইরে থেকে ফিরে পুরাতন বাড়ির কাছ চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে।

যাই হোক, বিধির বিধানে নোঙর তুলতে হবে, সময় হল পাততাড়ি গুটিয়ে, হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা!সর্বহারার মত চল অন্য কোথা।যথেষ্ট হয়েছে রাজত্ব ভোগ করা।এটাই সত্যি, এটাই রূঢ় বাস্তব। জীবনের আর কটাদিন আছে জানিনা। ভেবেছিলামএভাবেই কেটে যাবে, ছন্দ পতন ঘটবে না।এখানেই সমাপ্তি হবে সব কিছুর!হলো না, হবার নয়।

(পলিন অধিকারী, সাবেক শিক্ষক, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর