ফায়জুল হক নোমান
ঢাকার অসহনীয় যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণে নাকাল হয়ে আমি প্রায়শই ভাবতাম জনভারাক্রান্ত এ নগরী যদি অল্প দিনের জন্য হলেও জনশূন্য হতো তবে কেমন হতো এর চেহারা? এবং এমন একটি জনশূন্য ঢাকায় একা একা বিচরণ করে চারপাশের প্রকৃতি অবলোকন করার অলীক কল্পনাও করেছি বহুবার।
আবার যানজটে লোকাল বাসে বসে সুপারম্যানের মতো রাস্তার উপর দিয়ে উড়ে গন্তব্যে পৌছার শিশুসুলভ চিন্তাও কম করিনি।
তবে সে উড়ে চলাটা কল্পনায় থেকে গেলেও জনশূন্য ঢাকার কল্পনাটা আর অলীক নয়। করোনাভাইরাস তার বাস্তব রূপ দিয়েছে। ঢাকা আজ ফাঁকা। তবে দুর্ভাগ্য পরিবারের জোড়ালো আপত্তির কারণে আমি আজ ঢাকায় নেই। তাই শূন্য নগরী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার ইচ্ছেটাও অপূরণীয় থেকে গেলো।
টেলিভিশনে দেখলাম আমার প্রাণের ঢাকা নতুনরূপে সাজছে। প্রকৃতি পেয়েছে নতুন যৌবন। গাছের পাতাগুলো ঘন সবুজ। রমনা, হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেকের পাড়, ও রাস্তার পাশের গাছগুলোর পাতায় আর ধূলোর স্তর নেই। ঘন লাল কৃষ্ণচূড়ার আর হলুদ, সোনালি ফুলগুলোকে টেলিভিশনের পর্দায় নিষ্পাপ শিশুর হাসির মতো পবিত্র মনে হলো।
দেখলাম সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সকাল-বিকাল শহরের পিচঢালা রাস্তাগুলোকে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রণ দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। থুতু আর ময়লামুক্ত রাস্তাগুলো সকালের রোদে জ্যোতির্ময় হাসি হাসছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যায় আর শিল্পবর্জ্য পড়ছে না। শুনেছি এসব নদীতেও নাকি প্রাণচাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করেছে। এখন আর কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না এ ঢাকাই বারবার দূষণে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
একটা সময় আক্ষেপ করে বলতাম এ শহরের মানুষগুলো এতো স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর কেনো। ছিনতাই, খুন, গাড়িতে ধর্ষণের মতো কতো পৈশাচিক ঘটনাই না প্রতিদিন টেলিভিশন আর খবরের কাগজে হেডলাইন দখল করতো। এসবের প্রতিবাদ না করে বরং ফেসবুক লাইভ করতে দেখেছি কতো।
অথচ আজ খবরে দেখছি এ শহরের তরুণ তুর্কিরা অসহায় ক্ষুধার্তদের পরিচয়টা পর্যন্ত গোপন রেখে ঘরে ঘরে খাবার পৌছে দিচ্ছে। এমনকি অহেতুক নিজেদেরকেও প্রচারে আনতে নারাজ। আবার কেউ কেউ রাস্তার অভুক্ত কুকুর, বিড়াল আর কাকদের নিয়ে ভাবছে। এ যেন এক স্বপ্নের নগরী। আহা! এত মানবিক নগরী কি দ্বিতীয়টি আর আছে?
টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরো জানতে পারলাম ঢাকা আর তার প্রকৃতি ভালো থাকলেও ঢাকার মানুষগুলো ভালো নেই। ঢাকা সজীব হলেও মানুষগুলো নির্জীব হয়ে পড়ছে। তারা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী। অবশ্য স্বেচ্ছায় বলতে আমার কিছুটা আপত্তি আছে।
স্বার্থপর মানুষগুলো প্রকৃতির প্রতি প্রতিনিয়ত যে অবিচার করতো প্রকৃতি হয়তো তার প্রতিশোধ নিতে আজ ঘরে থাকতে বাধ্য করছে। করোনা আজ প্রকৃতির প্রতিনিধি। যে সৃষ্টিকর্তা আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতি অন্যসবও তারই সৃষ্টি। তবে সকল সৃষ্টির প্রতি সমান দরদ থাকলে সৃষ্টিকর্তা সবার দোয়া কবুল করবেন এটাই স্বাভাবিক।
টেলিভিশন আর ফেসবুকে আরো দেখলাম এ শুধু ঢাকার চিত্র নয়। ঢাকার মতো পৃথিবীর অন্যসব শহরগুলোতে ও নীরব কারফিউ। শুনেছি বিভিন্ন শহরের রাজপথে নাকি জন্তু-জানোয়ার, পশু-পাখিরা বেড়িয়ে আনন্দ মিছিল করছে। আজ তারা মুক্ত। শুধু মানুষগুলো আর তাদের কলকারখানা লকডাউন।
পৃথিবীর স্বার্থপর মানুষগুলো কি এ করোনা থেকে সঠিক শিক্ষা নিতে পারবে?..নিজেদের স্বার্থপর ধ্যান-ধারণা বদলে পারবে কি সাম্যের গান গাইতে?.. অবলা প্রকৃতির কিছুটা কষ্ট অনুভব করতে পারবে কি মোটেও?
আজ করোনা থেকে নিজেদের রক্ষায় পৃথিবীর মানুষ মরিয়া। তবে নিয়ম করে ৩৬৫ দিনের অন্তত ১০ টি দিন প্রকৃতিকে রক্ষায় স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী থাকতে পারবে কি?
(ফায়জুল হক নোমান, শিক্ষার্থী, সিভিল ইইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি)