অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।।
বেশিরভাগ মানুষ যেসকল পণ্যকে ব্যক্তি বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে সেগুলোর চাহিদাকে বাজে চাহিদা হিসাবে অভিহিত করা হয়। পণ্যগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো সমাজের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। সিগারেট, মাদক,ক্ষুদ্র অস্ত্র,অধিক সন্তান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এই শ্রেণীভুক্ত। মনে রাখতে হবে যারা এগুলোকে পেতে চায় তাদের বিবেচনায় এগুলো হচ্ছে তাদের সমস্যা বা নীডের একটি সমাধান। তাদের সমস্যার সমাধান হিসেবেই এগুলো পেতে চায়। প্রত্যেকেই পণ্যগুলোকে তাদের সমস্যার জুৎসই সমাধান হিসেবে বিবেচনা করে। যারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল খায় তারা তাদের বিবেচনায় একটা সমস্যার সমাধান বা নীডের সন্তুষ্টির জন্যই খায়। কোন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা ছাড়াই বিশ্বজুড়ে এ সকল পণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে কেউ কি কোনদিন দেখেছেন বিজ্ঞাপনে বা লিফলেটে লিখা আছে , “আরো বেশি করে ফেনসিডিল খান” অথবা “সন্তান যত বেশি ততো ভালো” । মাদক এবং সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য পণ্য ও ধারণার চাহিদা বেড়েই চলেছে।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (স্যার) এ এফ রহমান হলের কোয়ার্টারে থাকি। আমার বাসার বিপরীতে তখন কাটাবন বস্তি। বিশাল বস্তি, ফেনসিডিল এবং মাদকদ্রব্যের সবচেয়ে বড় আরত,পাইকারি এবং খুচরা দুই অর্থেই। একদিন রাতে বাসায় ঢোকার সময় দেখি এক যুবক আমার গেটের সামনে বসে ফেনসিডিল খাচ্ছে। আমাকে দেখে সরে যাচ্ছিল। আমি তাকে ধরে ফেললাম। জোরে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এগুলো খাচ্ছ কেন ‘? “স্যার, ঝিম মাইরা থাকার জন্য খাই”। বুঝলাম যুবকটির ঝিম মাইরা থাকা খুব প্রয়োজন। অতএব সে ১৫০ টাকা দিয়ে এক শিশি ফেনসিডিল কিনে খাচ্ছে।
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন কিন্তু সর্দি কাশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ মত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার কেতাব উদ্দিন সাহেব নিজে বাহ্যিক ভাবে দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও ভালো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সর্দি কাশি হলে ফেনসিডিল সিরাপ ২/৩ চামচ করে দিনে দুইবার প্রেসক্রিপশন হিসাবে দিতেন) নীলক্ষেতের ফার্মেসি থেকে ৮ টাকা দিয়ে এক বোতল ফেনসিডিল কিনে দুই তিন দিন খেলেই সর্দি কাশি ভালো হয়ে যেত। আমরা ফেনসিডিলকে সর্দি কাশির সিরাপ হিসাবে খেতাম । এটা যে পরবর্তীতে মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হবে এটা আমাদের তখন ধারণার বাইরে ছিল। যার ঝিম মেরে থাকার দরকার সে আরো বেশি বেশি করে ফেনসিডিল খাক এবং ঝিম মেরে থাকুক তাতে আমাদের কি যায় আসে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে এই ভেবে, ফেনসিডিল খেতে খেতে যদি দেশের পুরো যুবসমাজ ঝিমিয়ে যায়। তাহলে কি হবে? যারা ‘ইয়াবা’ খায় তাদের একজনের সাথে কথা বলে ইয়াবা খাওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলাম। সে বলেছিল “ছটফট” করার জন্য খাই। ফেনসিডিলের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইয়াবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত হয়। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সৈন্যদের অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করার জন্য ‘খচ্চর’ ব্যবহৃত হতো। ‘খচ্চর’ হচ্ছে ঘোড়া আর গাধার সংকরায়নে সৃষ্ট এক প্রাণী। পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় যেতে যেতে ‘খচ্চর’ যেন ঘুমিয়ে না পড়ে সেজন্য যাত্রার আগে প্রাণীটিকে ইয়াবা খাওয়ানো হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ঔষধ দেওয়া হয় সৈনিকদেরকে বিনিদ্র রাখার জন্য। শুনেছি ইদানীংকালে কিছুসংখ্যক বিসিএস পরীক্ষার্থী রাত জেগে সমুদ্রের গভীরতা আর পর্বতের উচ্চতা মনে রাখার জন্য পরীক্ষার আগের রাতে বিনিদ্র থাকার জন্য একটু ইয়াবা খেয়ে থাকে। পরীক্ষার পর তাদের এই অভ্যাস অব্যাহত থাকে কিনা জানিনা।
এগুলো বলছি এজন্যে, যেকোনো পণ্য ভোক্তা তাঁর একটা প্রয়োজন মিটানোর জন্য ব্যবহার করে। সমস্যাটা হচ্ছে সমাজের জন্য তা গ্রহণযোগ্য নয়। অধিক সন্তানের চাহিদাও এই শ্রেণীভুক্ত চাহিদার অন্তর্গত। প্রত্যেক সন্তান তাঁর পিতামাতার সন্তান। যদিও খ্রিস্টান ধর্ম মতে সবাইকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করতে বলা হয়। সন্তান যার দায়ও তার। এতে আমাদের কি যায় আসে। একজন মহিলা ইদানীংকালে সর্বোচ্চ ১৫ জনের বেশি সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমনটি বেশি দেখা যায় না। কারো যদি ইচ্ছে হয় বেশি সন্তান নেয়ার, নিক না, এতে আমাদের কি যায় আসে। (গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী রাশিয়ান ফেডারেশনের মিসেস Vassilyeva নামক এক মহিলা ২৭ বার গর্ভধারণ করে ৬৯ সন্তানের মা হতে পেরেছিলেন। এরমধ্যে ১৬ বার জমজ, সাতবার তিনজন এবং চারবার চারজন করে সন্তান জন্ম দেন। ১৭২৫ থেকে ১৭৬৫ এই ৪০ বছরে জন্মানো ৬৯ শিশুর মধ্যে মাত্র ২ জন শিশুবয়সে মারা গিয়েছিল। তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীও মোট ১৮ টি সন্তানের জন্ম দেন। ছয়বার দুইজন করে, আর দুইবার তিনজন করে, অর্থাৎ ওই ভদ্রলোকের দুই স্ত্রীর গর্ভে মোট ৮৭ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এটি এই পর্যন্ত বিশ্ব রেকর্ড)।
যার যত সন্তান হওয়া দরকার হোক না , এতে আমাদের কি যায় আসে? আমাদের সমস্যা হচ্ছে- স্কুলে সিট খালি নেই, বাসে জায়গা নেই, বসবাসের স্থান নেই, যেখানে বন্যার পানি ও মাছ থাকার কথা, (উত্তর সিটির কর্পোরেশনের ৪২ নং ওয়ার্ড) সেখানে মানুষ থাকছে, ইত্যাদি। এমনকি বাবা-মার অধিক সন্তানের ভরণপোষণের ক্ষমতা থাকলেও সমাজ তাঁদের বহন করতে পারছে না। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে সমাজে যারা সামর্থ্যবান তাঁদের সন্তান কম, যারা দরিদ্র তাঁদের সন্তানের সংখ্যা বেশি।
যাদের সন্তানের সংখ্যা বেশি তাঁদের সন্তানের চাহিদা বেশি বলেই এমনটি হচ্ছে। যারা বেশি সন্তান নিচ্ছে তাঁরা যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা রাখে না এটা বলা যাবে না। বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রায় ৯৫ শতাংশ দম্পতি পরিপূর্ণ ধারণা রাখে । তবু কেন মানুষ পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে না? কেউ কেউ মনে করে সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হচ্ছে (হায়াত, মউত রিজিক), সবকিছু তাঁর ইচ্ছায় চলে। অতএব ব্যক্তি এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করলে সৃষ্টিকর্তার নারাজ হবেন। এ ধরনের বহু যুক্তি তাঁরা সামনে নিয়ে আসে। হুজুররাও ওয়াজ মাহফিল এই কথাগুলি বলেন । ধনীদের তুলনায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে অধিক সন্তানের গ্রহহের কারণ জানার জন্য পরিচালিত একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধ্যাপক আলিমউল্লাহ মিয়ান প্রকল্প পরিচালক, আমরা কয়েকজন তরুণ শিক্ষক তাঁর গবেষণা সহযোগী। গবেষণার বিষয়বস্তু, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের অধিক সন্তানের আকাঙ্ক্ষার কারণ জানা। গবেষণা পদ্ধতিটাও ছিল অভিনব। কোন প্রশ্নপত্র থাকবে না। তথ্য সংগ্রহকারী অধিক সন্তান আছে এমন একটি দরিদ্র পরিবারের সাথে সখ্যতা তৈরি করে একদিন তাদের সাথে থাকবে এবং তাদের মনের কথা জেনে রিপোর্ট করবে। গবেষণা পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছিল ‘ডায়েরি মেথড’।
গবেষণা পদ্ধতিটি স্যার বুঝিয়ে দিলেন এবং একদিন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা সদরে নিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে দিলেন। এবং বললেন এখান থেকে তোমরা যার যার মতো করে গ্রামের দিকে চলে যাও, অধিক সন্তান আছে কিন্তু অতি দরিদ্র এমন একটি পরিবারের সাথে সারাদিন থাকবে এবং অধিক সন্তানের আকাঙ্ক্ষার পিছনে তাদের মনের কথাটা কি সেটা রিপোর্ট আকারে লিখে জমা দিবে। আমার যতদূর মনে পড়ে একটা রিক্সা নিয়ে আমি প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলাম। গ্রামের নামটি মনে করতে পারছিনা। তবে বাদশা মিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাদশা মিয়ার ডাকনাম বাদশা হলেও সে ছিল দিনমজুর। টিলার উপরে মাটির দেয়ালের কুঁড়েঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে সে থাকে। ঘরে তেমন কোন আসবাবপত্র নেই বাদশা মিয়ার । এই ভিটেবাড়ি ছাড়া কোন ফসলি জমিও নেই। প্রতিদিন দিনমজুরি করে খায়। সহায়-সম্বল বা সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই । আছে শুধু ছোট ছোট ৬টি বাচ্চা। চার ছেলে দুই মেয়ে। প্রথমে বাদশা মিয়াকে পাওয়া গেল না। সে কাজে চলে গেছে। আমি পরিবারটির সাথেই থেকে গেলাম। কিছু খাবার সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম এগুলো বাচ্চাদের দিলাম এবং এদের সাথেই গল্পগুজব করলাম এবং আশপাশটা ঘুরে দেখলাম।
বিকেলের দিকে বাদশা মিয়া কাজ থেকে বাড়ি ফিরে আসে। তাকে পূর্বপরিকল্পনা মত উপহারস্বরূপ ভালো সিগারেট ‘ক্যাপস্টান’ দুই প্যাকেট দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সাথে ভাব হয়ে গেল। আলাপ শুরু করলাম। ‘আচ্ছা বাদশা ভাই, আপনার তো সহায়-সম্পত্তি তেমন কিছু দেখছি না, সন্তান দেখছি ছয়টা’। “স্যার যে কি বলেন, গরিবের সন্তানই সম্পত্তি”। এটা বলে সে আমাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝাতে লাগলো। “স্যার আপনারা চাকরি করেন, সম্পত্তি আছে, বৃদ্ধ বয়সে সরকারি পেনশন পাবেন, আমাদের তো সম্পদ নাই, পেনশন নাই । বুড়ো বয়সে সন্তানই আমাদের দেখবে। কমপক্ষে দুইটা শক্তিশালী সামর্থ্যবান ছেলে থাকা দরকার। একজন তাঁর মাকে দেখভাল করবে আরেকজন আমাকে”। বাদশা মিয়ার কথায় যুক্তি আছে ! আমি বললাম, বলছেন দুইটা ছেলে দরকার কিন্তু আপনার ছেলে তো চারটা। “স্যার, আমাদের এলাকায় সন্তান বেশি বাঁচে না। মইরা ধইরা যদি দুইটা বাঁচে”। তারপর বললাম ছেলেরা আপনাকে এবং আপনার স্ত্রী কে বুড়ো বয়সে খাওয়াবে, কিন্তু মেয়ে কেন? “স্যার যে কি বলেন, মেয়ে হইল বাড়ীর সৌন্দর্য। তাছাড়া পোলাপাইনের মায়ের প্রায়ই অসুখ-বিসুখ থাকে। ঘরের কাজ কাম, রান্নাবান্না, হাড়ি পাতিল ধোয়ার জন্য একটা মেয়ে লাগবে না”? আমি বললাম আপনার মেয়ে তো দেখি দুইটা । বাদশা মিয়া জবাব দিল, “স্যার, মেয়ে তো আরো বেশি মরে”। (বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে গ্রামীণ দরিদ্র শিশুদের মধ্যে মেয়ে শিশুরা অপেক্ষাকৃত বেশি অপুষ্টিতে ভোগে। মায়েরা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদেরকে কম খাবার দেন)।
ঘটনাটা এইজন্য বললাম, বাদশা মিয়ারা আপনার-আমার বুদ্ধিতে চলে না। বাদশা মিয়ার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে মিলে মোট তিনটি সন্তানের নীড আছে। আর যেহেতু শিশু মৃত্যুর হার বেশি প্রত্যেকের বিপরীতে একটি করে “ব্যাকআপ ফাইল” তৈরি করেছে। প্রত্যেকের বিপরীতে ইন্সুরেন্স হিসাবে আরেকটা সন্তান নিয়েছে । আমার আর বুঝতে বাকি থাকল না শিশুমৃত্যুর উচ্চহার অধিক সন্তান জন্মানোর অন্যতম কারণ। এক সময় পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশু মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ ছিল আমাদের দেশে। ১৯৬৯ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজার জন্মের বিপরীতে ২২৪.১ জন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যাটি দাঁড়ায় মাত্র ৩০.২ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা হলেও কমিয়ে আনার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে “ওরস্যালাইন”। তখন সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হত ডায়রিয়া হলে। ডিহাইড্রেশন হয়ে বেশিরভাগ শিশু মারা যেত। ওরস্যালাইন আসার পরেই শিশু মৃত্যুর হার কমে গেছে। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমে গেছে । একসময়(১৯৭৫) প্রতি মায়ের সন্তান জন্মের হার ছিল ৬.৩ জন। বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা প্রতি শিশু জন্মের হার ২.০৬ জন(২০১৭)। জন্মহার এর দিক থেকে বাংলাদেশের উন্নতি অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানে জন্মহার এখনো ৩.৫৬ জন।(নাইজার-৬.৪৯, অ্যাঙ্গোলা-৬.১৫, নাইজেরিয়া-৫.০৭, আফগানিস্তান-৫.১২ জন)। বাংলাদেশ সন্তান জন্মদানে সক্ষম মহিলা প্রতি জন্মহার দুইয়ে নামিয়ে আনতে পারলেই আমাদের পক্ষে জেডপিজি অর্থাৎ ‘জিরো পপুলেশন গ্রোথ’ (ZPG) অর্জন সম্ভব হবে। তখন আমাদের দেশেও উন্নত দেশের মতো জনসংখ্যা আর বাড়বে না।
১৯৮০ দশকের দিকে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি যখন “রাজা” “মায়া” ব্র্যান্ডের জন্মনিরোধক সামগ্রী বিক্রি শুরু করেছিল যা এখনো অব্যাহত আছে। সেটা জনসংখ্যা কমানোর উপর যে প্রভাব ফেলেছিল তার চেয়ে বেশি সুফল আসে ওরস্যালাইন বিক্রির মাধ্যমে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যখন লবণ দিয়ে স্যালাইন খাওয়ানোর ব্যাপারে প্রচারণা শুরু করলো তারপরেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সফলতা আসতে শুরু করে। অতএব বাজে চাহিদার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নীডের কারণ অনুসন্ধান করে সামাজিক বাজারজাতকরন( Social Marketing) এর মাধ্যমে সেটা মোকাবেলা করা।(এ ব্যাপারে যারা বিস্তারিত আরো জানতে চান তাদের জন্য সুপারিশকৃত বাংলা ভাষায় রচিত বই হচ্ছে- “বাজারজাতকরণ : দর্শন ও প্রযুক্তির অব্যবসায়িক প্রয়োগ” অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন,ঢাকা)।
সামাজিক সমস্যাগুলোর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে আগ্রহীদের এগুলো থেকে দূরে সরিয়ে আনাই হবে বাজারজাতকরণকারীর কাজ। আমরা অসংখ্য সামাজিক সমস্যা মোকাবেলা করছি- দারিদ্র্য, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, নারী ও শিশু নির্যাতন; জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মাদকাসক্তি, পরিবেশ দূষণ, ইত্যাদি বহু সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই সমস্যাগুলো নতুন নয়। কোন কোনটা শত বছরের পুরনো। আর এগুলোর সমাধানের প্রচেষ্টা যেগুলো আমরা দেখছি তাও সাম্প্রতিককালে শুরু হয়েছে বলে মনে করার কোন কারন নাই। শতশত এনজিও ও সরকারি প্রতিষ্ঠান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য এই উপমহাদেশে সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)থেকে শুরু করে রাজা রামমোহন রায়(১৭৭২-১৮৩৩), হাজী মোহাম্মদ মহসীন(১৭৭৩-১৮১২) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৮৬১-১৯৪২) কেউই কম চেষ্টা করেননি। ইদানিংকালের ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস(১৯৪০- ) এবং স্যার ফজলে হোসেন আবেদ(১৯৩৬-২০১৯) এর কথা না হয় নাই বললাম। সবাই যার যার মতো করে চেষ্টা করছেন কিন্তু রহস্যজনক হচ্ছে সমস্যা ও সমাধানের চেষ্টা পরস্পর হাত ধরাধরি করে বাড়ছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দী শুরুতে ১২০৩ সালে সেন বংশের শাসনের পতনের পর আফগান সামরিক জেনারেল ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির(মৃত্যু-১২০৬) শাসন আমল থেকেই এই বঙ্গদেশে ওয়াজ শুরু হয়। এই সময় থেকেই এই এলাকার লোকজন তাদের আদি ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে দলে দলে মুসলমান হতে শুরু করে। সেই থেকে ধরলে এদেশে ওয়াজ মাহফিলের ইতিহাস অনেক পুরানো। হুজুররা ওয়াজ করছে মানুষকে আল্লাহর পথে আনার জন্য। গত প্রায় ৭০০ বছর ধরে এই অঞ্চলে ওয়াজ চলছে, শীতকালে ওয়াজ একটু বেশি বেড়ে যায়। কিন্তু ওয়াজ কি কোন কাজে এসেছে? ধর্মে নিষিদ্ধ কাজ সম্পর্কে এত বলার পরও অপকর্মগুলো আরো বাড়ছে। এখন এক একটা ওয়াজ মাহফিল বড় ধরনের কনসার্টের চেয়েও জাঁকজমকপূর্ণ। এলইডি লাইট, সাউন্ড বক্স, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ভিডিও, ফেসবুক-লাইভ, গান, নাচ (জিকিরের তালে তালে), কবিতা সবই আছে। ইউটিউবে সবচেয়ে বিনোদনমূলক কনটেন্টগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে কিছুসংখ্যক হুজুরের ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও। কিন্তু মাহফিলের পরে যেটা নাই, সেটা হচ্ছে হেদায়েত। মানুষ আরো বেশি মুনাফিক হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের টাকা লুট করে বারবার ওমরা করতে যাচ্ছে। ঘুষের টাকায় হালাল মাংস খুঁজছে। পাঁচ ওয়াক্তের ফরজ নামাজ না পড়ে সাপ্তাহে একদিন শুক্রবার জায়নামাজ নিয়ে বাহারি পাঞ্জাবি (কস্টিউম) পড়ে, চীনে প্রস্তুত সৌদি টুপি ও তসবি হাতে নিয়ে মসজিদের সামনের সারির জায়গা দখল করছে। হুজুরদের ওয়াজগুলো ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মার্কেটিং কনসেপ্ট এর প্রয়োগ না করা। বড় হুজুর যা শিখিয়ে দিচ্ছে, ছোট হুজুর ওয়াজে গিয়ে সেটাই ডেলিভারি দিচ্ছে; সেলিং কনসেপ্ট। মুসুল্লিরা কি জানে, তাদের কি জানা দরকার, কি বলতে হবে, এসব কিছু খোঁজ খবর না নিয়ে হুজুররা অনবরত বেহেশতের “হুর” এবং “পানীয়ের” বর্ণনা দিয়ে থাকে। আল্লাহর আরশের বর্ণনা ওয়াজের আরেকটা বহুল আলোচিত বিষয়। আল্লাহর আরশের একটি পায়া থেকে আরেকটার দূরত্ব , ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে ফারসি প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করছে, না বুঝেই চোখের পানি ফেলছে অনেকে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
আমার আব্বা একটা গল্প বলতেন, ওয়াজ-মাহফিলের গল্প। প্রত্যন্ত এলাকায় ওয়াজের জন্য বড় হুজুরের কাছে সবাই আবদার করল কিন্তু দুর্গম পথে হেঁটে যেতে হবে এ কারণে বেশি বয়সী বড় হুজুর রাজি হলেন না। তখনকার দিনে হেলিকপ্টার দূরের কথা গাড়িরও প্রচলন ছিল না । আর রাস্তাঘাটও ঐ এলাকায় যাওয়ার জন্য কোন যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত ছিল না। এখনকার দিন হলে আয়োজকরা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে ফেলত। ইদানিং প্রায়ই দেখি হুজুররা হেলিকপ্টারে ওয়াজ করতে যায়। বড় হুজুর ছোট হুজুরকে ওয়াজের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। ছোট হুজুর অনেক কষ্ট করে পায়ে হেঁটে ওয়াজে হাজির হলেন। মাঘ মাসের শীতের দিনের ওয়াজ। অনেক রাত পর্যন্ত বিভিন্ন মাসআলা বললেন হুজুর। এর মধ্যে একটি মাসআলা ছিল এইরকম- ‘মহিলাদের শাড়ি কাপড় দিয়ে যে কাঁথা তৈরি হয়, তা তাঁর স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষ, যাদেরকে বেগানা পুরুষ বলা হয়, তাঁরা গায়ে দিতে পারবে কিনা। হুজুর বললেন, “অসম্ভব! মহিলার শাড়ি কাপড় দিয়ে বানানো কাঁথা পরপুরুষ গায়ে দিলে ঈমানই থাকবে না; ইত্যাদি ইত্যাদি। ওয়াজের পর হুজুরকে ভালো খাওয়া দাওয়া করানো হলো । কিন্তু সমস্যা দেখা দিল হুজুর ঘুমাবেন কিভাবে। হুজুরের জন্য বিভিন্ন বাড়িতে কাঁথা খোঁজা হলো, কিন্তু কোথাও মহিলাদের শাড়ি কাপড় ছাড়া কাঁথা পাওয়া গেল না। আজকালকার দিনে গ্রামে যেমন লেপ, কোরিয়ান কম্বল এগুলোর কোনো অভাব নেই, তখন এগুলোর কথা চিন্তাই করা যেত না। গ্রামে কাঁথাই ছিল একমাত্র সম্বল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও শাড়ি কাপড় বিহীন কাঁথা না পেয়ে একপর্যায়ে ওয়াজের আয়োজকরা চেষ্টা বন্ধ করে দিল। রাত আরও গভীর হলো, হুজুর শীতে কাবু হয়ে কোনরকমে সাথে আনা চাদর গায়ে দিয়ে রাতটা পার করলেন। আয়োজকদের উপর খুব বিরক্ত হলেন এবং খুবই রাগ করলন। তাহাজ্জতের নামাজের সময় হুজুর গ্রাম ত্যাগ করে শহরের দিকে রওনা হয়ে গেলন। সকালে ফজরের নামাজের পরে বড় হুজুর ছাত্রদের নিয়ে রৌদ্রে বসে কোরআন হাদীসের তামিল দিচ্ছিলেন। এমন সময় দেখেন ছোট হুজুর শীতে কাঁপতে কাঁপতে মাদ্রাসার দিকে আসছেন। বড় হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, “ওয়াজ মাহফিল কেমন হলো”? “খুবই ভালো, আলহামদুলিল্লাহ” । “খাওয়া-দাওয়া কেমন করালো? “খুবই সুন্দর, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ঘুমাইতে একটু কষ্ট হইছে”। এই কথা বলার সাথে সাথে বড় হুজুর ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। আর জিজ্ঞেস করল, “তুই কি কাঁথার ওয়াজটা করছিস নাকি”? ছোট হুজুর মাথা নেড়ে সম্মতি সূচক জবাব দিলেন । তখন বড় হুজুর বললেন, “আরে বেআক্কেল, এইটা তো চৈত্র মাসের ওয়াজ, তুই এটা মাঘ মাসে করতে গেলি কেন”?
চৈত্র মাসের ওয়াজ মাঘ মাসে করা হচ্ছে সেলিং কনসেপ্ট, মাঘ মাসের ওয়াজ মাঘ মাসে করা হচ্ছে মার্কেটিং কনসেপ্ট। এই কনসেপচুয়াল সমস্যার কারণেই আমাদের সামাজিক সমস্যার সমাধান করার প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। আধুনিক বাজারজাতকরণ দর্শন ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। (চলবে)
( লেখক- কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)