ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
বননের মন খুব খারাপ! বর্ষা খালামনির বিয়ে হবে বলে সেই মার্চের ২০ তারিখে নানার বাসায় এসেছে, প্রায় দুই মাস হতে চললো নিজেদের বাসায় ফিরতে পারছেনা। বাসায় ফিরবে কি ভাবে। করোনার মহামারীতে প্রথমে কোয়ারেনটাইন, তারপরে লকডাউন । এগুলোই চলছে। সারাক্ষণই বাসার সবাই মন খারাপ করে ড্রইংরুমে বসে টিভিতে করোনার তথ্য শুনে মন আরো খারাপ করে ফেলছে।
বর্ষা খালামনির বিয়েটা হলো না। সারাক্ষণই মন উদাস করে জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কাছে বিষাদের মতো লাগছে সবকিছুকেই। গায়ে হলুদের স্টেজকে মনে হচ্ছে ভীষণ তাপমাত্রা দিয়ে জ্বর এসে সেগুলোকে শুকনো খটখটে করে ফেলছে। রিয়েলের সাথে বর্ষার অনেকদিনের সম্পর্ক । ছেলেবেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় সব একসাথে । বর্ষাই বরাবর প্রথম। স্কুল থেকে মাস্টার্স পযন্ত। তবে শেষ সেমিস্টারে এসে দুজন আলাদা। বর্ষা খাইরুল স্যারের অধীনে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে আর রিয়েল প্রীতম স্যারের অধীনে সলিড ফিজিক্স নিয়ে থিসিস করেছিল। এরপর ভাগ্য খোলে রিয়েলের । ইতালীর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসিটিপি) তে ফেলোশীপ নিয়ে চলে যায় ডিপ্লোমা করতে। বহুদিন ধরেই দুজনের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিল। কিন্তু ব্যাটে বলে না মিলায় দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। রিয়েলের ক্যারিয়ারের চিন্তা করেই বর্ষা অপেক্ষা করছে। শেষে ঠিক হয় এ বছরে ২৬ মার্চ বিয়ের পিঁড়িতে বসবে দুজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিনে লাল সবুজের শাড়ীতে বিয়ের বার্ষিকী পালন করে যাবে বছরের পর বছর। রিয়েল বর্ষার প্রস্তাব লুফে নিয়ে ইতালী থেকে দুবাই হয়ে বিয়ের বাজার করে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই চলে আসে।
খবরটি গায়ে হলুদের দিনে সকালে চাউর হয়ে গেল। রিয়েলদের বাসা থেকে হলুদের কোন জিনিসপত্র দুরে থাকুক, ওদের বাসা থেকে কাউকে বের হতে দেওয়া হবেনা । বাসা লক ডাউন।
বর্ষাও বিষয়টি খেয়াল করেছিল। ইতালী থেকে ফেরার পর রিয়েল যখন বর্ষাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়েছিল টুকটাক কিছু কিনতে সারাটা পথই ও হাঁচি দিয়েছে। ড্রাইভার হাসান বারবার বলেছে ভাইজান এসি বন্ধ করে দেই। বর্ষা পাত্তা দেয়নি। শরীর খারাপ বলে মার্কেট থেকে ফেরার পথে ডা: শহীদুলের সাথে দেখা করে এসেছে। ডা: শহীদুল নাপা আর মনটেন -১০ দিয়ে বলেছে রাতে জ্বর আসলে নাপা খাবেন। আর মনটেন -১০ মাসখানেক খেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন গলায় ব্যাথা, কাশি আর শ্বাস কষ্ট হতে থাকলে বিষয়টি গুরুত্বই পায়।
সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি সকলেই তটস্থ। ইতিমধ্যে ঢাকায় করোনা রোগীর সন্ধান পেয়েছে। মেয়র সাহেব এসে রিয়েলদের বাসা লক ডাউন করে দিয়েছে আর স্যাম্পুল নিয়ে গেছে। দুই দিন পরে রেজাল্ট চলে এসেছে রিয়েল করোনা ভাইরাসের রোগী। বাসায় আরো দুই জন পজেটিভ। পুলিশ এসে বাসায় লাল নিশান টানিয়ে গেছে। ইতালী থেকে বাসায় এসেছে বলে পাড়ার সবাই গাল মন্দ দিতেও বাঁকী থাকছেনা।
বননের মনে জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। সারাক্ষণই নানাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলে। ওর এখন এক নম্বর শত্রু এই করোনা। এই অসুখ না হলে কত মজা করে খালামণির বিয়ে হতো। বাসার বড়দের আলোচনায় ও জানতে পারলো এই করোনা মহামারীতে কোন অনুষ্ঠান করতে নেই।
সকাল থেকেই ও নানাকে জিজ্ঞেস করছে আচ্ছা নানা ভাই করোনা কি রকমের অসুখ?
করোনা হলো একটি ভাইরাস বাহিত রোগ। এই রোগটি খুব বেশি দিন আগের নয়। চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই অসুখ দেখা দেয়। এটি ক্রমাম্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকলে ২০২০ সালের ৯ই জানুয়ারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাথমিক পরীক্ষায় এই ভাইরাসটিকে নভেল করোনা ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয় কোভিড-১৯। বুঝলে নানা ভাই।
বনন করোনার ছবিটা দেখিয়ে বলে এটা দেখতে হুল ফুটানো বলের মতো।
হ্যা নানু ভাই তুমি ঠিকই বলেছে এই ভাইরাসটা দেখতে গোলাকার মুকুটের মতো। করোনা শব্দের অর্থ মুকুট। এর এর গায়ে যেগুলো জড়িয়ে আছে সেগুলোকে বলে স্পাইক প্রোটিন। এই স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।
বনন বলল এই ভাইরাসের ছবি কারা তৈরী করল – বনন বলতে থাকে।
বননের নানা বোটানীর অধ্যাপক ছিলেন। বছর তিনেক আগে শাহজাদপুর সরকারী কলেজ থেকে অবসর নিয়েছেন । মরিচ গাছের ভাইরাস নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। নেচার পত্রিকা সহ দেশ বিদেশের অনেক জার্ণালে তার লেখা ছাপা হয়েছে। এই বিষয়ে তিনিও অনেক কিছু জানেন। বননকে বললেন আমরা করোনার যে ছবি দেখি, সেটা অস্টিন এর ইউনিভার্সিটি অব টেক্সস এবং ইউনাইটেড স্টেটস এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এর গবেষকরা এই প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আণুবীক্ষণীক মানচিত্র তৈরী করেছেন।
এসো তাহলে এই ভাইরাসটিকে আরো ভালোভাবে চেনা যাক বলে প্রবীণ অধ্যাপক সাহেব বলতে শুরু করলেন।
সার্স কোভ-২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন করোনা ভাইরাস ডিজিস-১৯ বা সংক্ষেপে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঘটায়। এঞ্জিওটেনশিন কনভাটিং এনজাইম ২ (ACE2) নামক রিসেপ্টর এর সাহায্যে এই ভাইরাস মানব কোষে প্রবেশ করে।
এরপর কি হয়- বননের জানার ইচ্ছাটা আরো বেড়ে যায়।
ও আচ্ছা তাহলে শোনো- বননের নানা ভাই বলতে থাকে- মানব কোষের রিসেপ্টর এর সাথে আবদ্ধ হবার প্রবণতার কারণে নভেল করোনা ভাইরাস খুব বেশি মাত্রায় মানব সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণভাবে এই ৃরোগের লক্ষণগুলো হলো মূলত: জ্বর, কাশি, নাক থেকে পানি পড়া এবং শ্বাস কষ্ট। এগুলো সাধারণত আক্রান্ত হবার ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে প্র্রকাশ পায়। সবশেষে মারাত্মক নিউমোনিয়া, তীব্র শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণঘটিত সিনড্রোম (Acute Respiratory Distress Syndrome) সেপসিস বা সেপটিক শক দেখা দিতে পারে।
মানুষের ACE2 এর প্রতি ২০১৯ এনকোভ এস গ্লাইকোপ্রোটিনের তীব্র আসক্তিই এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে – কথা গুলি বলতে বলতে আলোচনায় ঢুকে পড়ে আবীর মামা। সে যশোর বিজ্ঞানপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের ল্যাবে করোনা রোগের সনাক্তকরণের কাজ শুরু হবে। হয়ত দু একদিনের মধ্যেই ও যশোর চলে যাবে। আবীরকে পেয়ে বননের জিজ্ঞাসা আরো বেড়ে গেল। বললো মামা আজ কয়েক দিন ধরে টিভিতে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। তুমি একটু ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলোতো।
আবীর বননকে বলল তার মানে তুমি জানতে চাইছে কিভাবে এই রোগটিকে সনাক্ত করা যায়?
তাহলো শোনো- (কোভিড-১৯) এবং সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা। মূলত দুই উপায়ে এই পরীক্ষা চালানো হয়: আনবিক চিহ্নিতকরণ এবং সেরোলোজি পরীক্ষা। আণবিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া (পিসিআর) এবং নিউক্লিক এসিড পরীক্ষা, এবং অন্যান্য আধুনিক বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর মাধ্যমে প্রকৃত-সময় বিপরীত ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া ব্যবহার করে রোগ নির্ণয়ের জন্য ভাইরাসের জিনগত উপাদান শনাক্ত করা হয়। আমরা আমাদের ল্যাবের আরটি পিসিআর (RT-PCR) টেস্টের মাধ্যমে এই ভাইরাসটিকে সনাক্ত করব। আরটি- পিসিআর বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিএ্যাকশন হলো ডিএনএ নির্ভর এক টেস্ট যা দিয়ে খুব দ্রুত বলে দেয়া যায় যে কোন ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটি আছে কিনা। খ্যাতিম্যান গবেষকরা মত দিয়েছেন সম্ভাব্য কোভিড রোগীকে RT-PCR পরীক্ষা করা প্রয়োজন, কারণ এটিই সবচেয়ে বিশেষায়িত পরীক্ষা।
আবীরের কথা শুনে বননের নানা ধমক দিয়ে উঠল, তত্ত্ব কথা বাদ দিয়ে পিসিআর জিনিসটা কি সেটা ওকে বল।
ও আচ্ছা- বলছি- পিসিআর বা পলিমারেজ চেইন রিএ্যাকশন হলো একটি দ্রুত এবং কম ব্যয়বহুল প্রযুক্তি যা ডিএনএ এর ছোট ছোট অংশগুলিকে প্রশ্বস্তকরণ করতে ব্যবহার হয়। আণবিক এবং জিনগত বিশ্লেষণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ডিএনএন যে পরিমাণ প্রয়োজন পড়ে তা পিসিআর ছাড়া অসম্ভব। অণুজীব বিজ্ঞানের গবেষণায় ডিএনএ নির্ণয়ে পিসিআরের ব্যবহারের জন্য কেরি মুলিসকে ১৯৯৩ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
তাহলে এই রোগের চিকিৎসা কি? উদ্বিগ্ন হয়ে নানাকে জিজ্ঞেস করে।
নিশ্চিতভাবে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্যে কোনো সুনির্দিষ্ট ঔষুধপত্র নেই। কেন নেই তার ছোট্ট একটা জবাব হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানে পযাপ্ত প্রমাণের অভাবে শ্বাসকষ্টযুক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাসনাশক ঔষুধ দেয়া যায় না।
বননের খুব চিন্তা হলো। যদি অন্য কারো থেকে ওর শরীরে করোনা ভাইরাস ঢোকে। ও: ভাবাই যায় না। কি হবে ।
আবীর বলে বনন এজন্যই তো আমরা অন্যদের থেকে পৃথক থাকব। আর বাসায় সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুলে এই রোগটির সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।
নানু ভাই এই ভাইরাসের সাথে সাবান পানির সম্পর্ক আসছে কেন? শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলেই তো ময়লা চলে যায়। বননের উত্তরে নানু ভাই বললেন- না ভাই তাতে ভাইরাসের জীবাণু হাত থেকে যায় না। কারণ গঠনগতভাবে করোনাভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস, ইবোলা ও জিকা ভাইরাসের জিনের উপাদানগুলি তৈলাক্ত লিপিডের স্তরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সাবানের অণুগুলি দেখতে অনেকটা আলপিন বা পেরেকের মতো । তার মাথার অংশটি হাইড্রোফিলিক এবং শেষের অংশটি ওলেওফিলিক। এই ওলেওফিলিক ভাইরাসের বাইরের আবরণটিকে ভেঙে দেয় এবং ভাঙা নিক্রিয় অংশগুলি পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বেরিয়ে যায়।
একইভাবে স্যানিটাইজারের এলকোহল লিপিডের আস্তরণকে দ্রবীভূত করে ভাইরাসকে নিক্রিয় করে দেয়। ভাইরাসের লিপিড স্তরে থাকা ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে প্রোটিনগুলোকেও বিকৃত করে দেয়। ফলে ভাইরাসটি মানবকোষে ঢুকতে পারে না। তবে স্যানিটাইজার হাতে থাকা রোগজীবাণুর সংখ্যা কমিয়ে দিলেও পুরোপুরি নির্মূল করতে পারে না। ঘরের বাইরে একদম যাওয়া যাবে না। গেলেও মাস্ক পড়ে যেতে হবে। অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। মোট কথা সংস্রবহীন থাকলেই সুরক্ষা!
ওদের আলোচনার কোন এক ফাঁকে বর্ষা খালামনি চিৎকার দিয়ে উঠে। এই মাত্র রিয়েল ম্যাসেজ পাঠিয়েছে আইসোলেশন থেকে করোনা নেগেটিভ হয়ে বাসায় ফিরেছে। আর একটু অপেক্ষা! বিপদের দিনগুলি কেটে গেলেই শুরু করবে নতুন জীবন। মহামারী মুক্ত পৃথিবীতে নতুনভাবে ওরা বেঁচে থাকবে। বননের নানা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। বলতে থাকে করোনামুক্ত পৃথিবী হবে সত্য ও সুন্দরের ! সেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথার মতো অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।