২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, রাত ৯:৫২
নোটিশ :
Wellcome to our website...

মৃত্যুক্ষুধা

রিপোর্টার
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫২ অপরাহ্ন

রেজওয়ান আহমেদ

শুরুর কথা

বনফুলের নির্বাচিত ছোটগল্পে মজেছিলাম একবার। ‘পাঠকের মৃত্যু’ পড়ে সাধ জাগলো অমন মৃত্যুর স্বাদ আমাকেও গ্রহণ করতে হবে। সিদ্ধান্তে আসলাম মৃত্যুর স্বাদ নেব কাজী নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’য়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপর ২০১১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বইটা নিয়েছিলাম বোধকরি। এ তথ্য যদি সঠিক না হয় তবে শাহবাগে গণগ্রন্থাগার এলাকায় আয়োজিত কোনো হেমন্ত বইমেলায় কেনা হয়ে থাকতে পারে বইটি। সেবারই শীতের ছুটিতে দুতিনবারে পড়া শেষ করেছিলাম মৃত্যুক্ষুধা। আজ ন’বছর পর দ্বিতীয়বার পড়তে বসে আমার মৃত্যুযন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে টের পেয়েছি। টের পেয়েছি দাগা খাওয়া শুরুর অষ্টম বছরে একজন পাঠক হিসেবে বিশ্লেষণধর্মে কতখানি দীক্ষিত হয়েছি।

মূল আলোচনা

অবিভক্ত বাঙলার নদীয়া জেলার কথা। অভাব-অশিক্ষা-দারিদ্র্য-ক্ষুধার উৎপীড়নে দিশেহারা চাঁদ-সড়ক, কৃষ্ণনগরের নিম্নশ্রেণির জনগণ। এখান থেকেই উঠে আসা একটা পরিবারের গল্প দিয়ে শুরু হয় ‘মৃত্যুক্ষুধা’। সে পরিবার থেকে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে দিতে বাকি থাকে প্যাকালে, তার মা, বড়-বৌ আর মেজ-বৌ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি প্যাকালের মনে প্রেমের টান দেখা যায়, দেখা যায় সংসার বাঁচানোর প্রতিজ্ঞাও। একদিন এ দ্বিমুখী স্রোতের টানে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ঘরছাড়া হয় সে। সংসার সংসারের নিয়মে চলতে থাকে খ্রিস্টান মিসবাবাদের শুশ্রূষায়। অথবা ক্ষুধায়-জরায়-রোগে-শোকে। সমান্তরালে এসে যোগ দেয় এক সরকারি কর্মকর্তা নাজির সাহেবের সংসার। রেলগাড়ির মতো চলতে থাকে কাহিনি।

মানুষ জীবনের কাঙাল। সে সূত্রে ধৈর্যের পরীক্ষক ঐশ্বরিক শক্তির ওপর রাগ দেখানো মানবিক প্রবৃত্তিরই পরিচায়ক। সেরকম বাস্তবতারই আকস্মিকতায় মেজ-বৌ ধর্মত্যাগ করে হয়ে যায় হেলেন – গ্রিক পুরাণের স্পার্টার রাজা মেনিলাউসের অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রীর নাম গ্রহণ করে। আর হয়ে যায় নাজির সাহেবের সম্বন্ধী আনসারের চোখের দুই তারার একটি।

উপন্যাসের সকল চরিত্র-উপচরিত্র ছাপিয়ে সামনে চলে এসেছে কাহিনিতে প্রভাব বিস্তার করে চলা মেজ-বৌ আর ক্ষুধাতুর, দারিদ্র্যপীড়িতদের মাঝে প্রকৃত অর্থেই জনপ্রিয় আনসার। বুদ্ধিমান পাঠক হয়তো বুঝতে পারবেন আনসার কার ছায়া ধারণ করেছে আখ্যানে।

তাহলে এখানে অন্যরা কোথায়? কী করেছে তারা কাহিনিতে? কী পরিণতিই বা বরণ করেছে কে? এরকম অজস্র প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে ‘মৃত্যুক্ষুধা’ পড়লে।

যে কথাগুলো মন ছুঁয়েছে

এরা সব ভোলে – ভোলে না কেবল তাদের অনন্ত দুঃখ, অনন্ত অভাব! (অভাবের বাড়াবাড়ি)

… ঝগড়া তোর গজালের মা-র সঙ্গেই হয়েছে, পাঁচির মা-র সঙ্গে ত হয় নি!” (মাতৃত্ব)

… বিশ্ব-সংসারে তেলামাথায় তেল দেওয়ার সবচেয়ে বড় মালিক যিনি তিনিই জানেন। (স্রষ্টার প্রতি বাস্তব অভিমান)

জি না! আপনারা একটু একটু করে আমায় খ্রিস্টান করেছেন! (ধর্মত্যাগের স্বরূপ)

… – ওর জীবনের অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনবার জন্য। … কেবলি মুখ লুকাবার চেষ্টা করতে লাগল। (স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি – ধীকামিতা)

সত্যই ত, সে স্বধর্মে ফিরে এলে আরো অসহায় অবস্থায় পড়বে। (সমাজবাস্তবতা)

… স্বর্গে উঠে যেতে হবে, পাতালে নেমে যেতে হবে! (বিদ্রোহ)

দাদি, তুই আব্বার কাছে যাবি? আচ্ছা দাদি, আব্বা যেখানে থাকে সেই বেশি দূর, না, মা যেখানে থাকে সেই বরিশাল বেশি দূর? … তাহলে আমি আব্বার কাছে যাব। আচ্ছা দাদি, আব্বার কাছে যেতে হলে কদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়! … মা ভালবাসে না, খেরেস্তান হয়ে গিয়েছে! হারাম খায়! … (শিশুর যুক্তি)

… আমায় যদি অমনি করে হাতে পেয়ে মুখের কাছে তুলে ধরে পান করতে পেত তোর দাদু, তাহলে আমিও ঐ চায়ের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে উঠতুম!(উত্তরাধুনিক চিন্তাচেতনা)

তালগাছ না থাকলেও তালপুকুর নামটা কি বদলে যায়? (নারীর নাম হারানোর সংস্কৃতি)

ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণেমৃত্যুক্ষুধা‘ –

এ উপন্যাসের ভাষাবৈচিত্র্য প্রশংসার দাবিদার‌। চরিত্র, প্লট, পর্বের ধারায় প্রয়োজনমতো ভাষাবৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক নজরুল।

সম্পূর্ণ পাঠে এ উপন্যাসে বঙ্গকামরূপী এবং মুর্শিদাবাদী বাঙলার মিশ্র প্রভাব লক্ষণীয়। কিছু কিছু জায়গায় রাঢ়বাঙলার শব্দচয়ন পাওয়া যায়। যেমন – “আমরা চুনোপুঁটি ভায়া, চুনোপুঁটি, ওরা রুই-কাতলাই ধরতে এসেছিল!”

অপরাধজগতের সাংকেতিক শব্দও দেখা যায়। যেমন – টিকটিকি।

নারীতে-নারীতে সংলাপ বিনিময়ে গ্রাম্য ঐতিহ্যবাহী ভাবপ্রকাশক রূপমূল যেমন – লো, লা, মাগী ইত্যাদি। আবার ঝগড়ার সময় খাঁটিবাঙলার এন্তার প্রয়োগও দেখা যায় – “হ্যাঁ লা ভাতার-পুতখাগী! তিন বেটাখাগী।…”

প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোড মিশ্রণও দেখা যায় – “এইবার হাম তোমাকে গুলি করেগা।”

বিলিতিরা বাঙলা কেমন বলে, তাও এ উপন্যাসে পেয়েছি – “… ওডের আমি বিস্কুট ডেবে, খাবার ডেবে, ওরা খুশি হয়ে ঠাকবে।”

বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে নিয়ে বেশি লিখবার ধৃষ্টতা আমার নেই। একজন কবি যে শুধু কবি নন, সব্যসাচী স্রষ্টা – তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। তাঁর অন্যান্য রচনার কথা যদি বাদও দেই, বলতে হবে বিশেষ করে ‘বাঁধনহারা’র কথা – বাঙলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস এটি। নজরুল আরো একটি উপন্যাস লিখেছেন – ‘কুহেলিকা’।

( রেজওয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী, স্নাতক তৃতীয় সেমিস্টার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর