ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কিন ধনকুবের বিল গেটস বলেছেন,“ বিশ্বকে করোনাভাইরাসের মহামারির আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হলে এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের সাতশো কোটি মানুষকে এই টিকা দিতে হবে ।” এটি অবশ্য বিল গেটস কেবলমাত্র নয় সমগ্র বিশ্বের জনগণের একমাত্র চাওয়া করোনা ভাইরাসের টিকা ! বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে এখন বিশ্বজুড়ে ৫০টিরও বেশি গবেষণা দল টিকা আবিষ্কারের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। অধীর আগ্রহে পৃথিবী তাকিয়ে আছে এই সকল বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের দিকে।
আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে ভ্যাকসিনেশন বা টিকা আবিস্কার করেছিলেন এডওয়ার্ড জোনার। খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। সতেরো শতকের প্রথমভাগে ইউরোপে গুটিবসন্ত দেখা দেয়। ১৬৬৬ খ্রি. থেকে ১৬৭৫ খ্রি. সময়কালে ইংল্যান্ডে মহামারী আকারে দেখা দেয় যা বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পযন্ত অব্যাহত ছিল। আজকের করোনা ভাইরাসের মতো এই অদৃশ্য শত্রুও অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানান দেশে।
অবিভক্ত বাংলায় এর থাবা ছিল গত শতকের সত্তরের দশক পযন্ত। আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা কখনো কখনো সমানে দাড়িয়ে গেছে। ঠিক আজকের মত থমকে যাওয়া পৃথিবীর মতো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসে উনিশ শতকের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা পড়ে মনে হবে এ যেন এখনকারই চিত্র। তিনি লিখেছেন: “রোগ সময় পাইল। জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।”
মহামারির সময়কার পদচিহ্ণ গ্রামের আরো বর্ণনা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তুলে ধরেছেন এভাবে- “ ১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পলাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে, ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে, দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে, অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে, শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না, বৃক্ষে পক্ষী দেখি না, গো চারণে গোরু দেখি না, কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুক্কুর।”
এগুলো বঙ্কিম সাহিত্যের কল্পিত কোন কথা নয়। আজকের বাস্তবতায় আমরা বুঝতে পারছি মহামারির উপলদ্ধি ! বসন্ত রোগে বাংলাদেশে কি পরিমাণ লোক মৃত্যু বরণ করেছিল – পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। ( বছর – আক্রান্ত- মৃত্যু) [ ১৯৫০- ২১২৭৩- ৯৪৪৫; ১৯৫১- ৩৮৮৭১- ৩০৩৪১; ১৯৫২- ১০৪৯০- ৮০৫৩; ১৯৫৩- ১১০২-৭৮৮; ১৯৫৪ – ৪৪৫-১৮৮; ১৯৫৫- ১৯২৬- ৯৭৯; ১৯৫৭- ২৪৯২০-১৮১৪৯; ১৯৫৮- ৭৯০৬০-৫৮৮৯১; ১৯৫৯- ১৫০৪৮-৯৫০৮] । উনিশ শতকে এবং বিশশতকের প্রথমার্ধের চিত্র আরো ভয়াবহ ছিল। স্যানিটারি কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলায় কয়েক লক্ষ লোক শুধুমাত্র বসন্ত রোগে মারা গেছে।
ইংল্যান্ডের চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ! ২০-৩০% লোক এই রোগে মারা যেতে থাকে। শয়ে শয়ে মানুষ মরছে। এর কোন ওষুধ নেই । শুধু ঈশ্বর এর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই করার নেই কারো। এ সময়ে দেবদূত হয়ে আসেন রাজা চতুর্থ জর্জের প্রধান চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার। রোগ প্রতিরোধ বিদ্যার জনক এডওয়ার্ড জেনার বসন্ত রোগের টিকা আবিস্কার করলেন এবং বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুপথ হতে উদ্ধার করার পথ বাতলে দিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রকে আধুনিকতার পথে উত্তরণ ঘটালেন। ১৪ মে, ১৭৯৬ জেনার তার হাইপোথিসিস সর্বপ্রথম তার মালির আট বছরের ছেলে জেমস ফিলিপ এর ওপর পরীক্ষা করেন । জেনারের টিকা উদ্ভাবনের ঘটনাটি ছিল এ রকম। ইংল্যান্ডের এক খামারে কিছু গরু গো-বসন্তে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত গরুর পুঁজ সংগ্রহ করে তাঁর মালির ছেলে ফিলিপের দুই বাহুতে টিকা দেন। এর ফলে ফিলিপের সামান্য জর দেখা দেয় । কিন্তু সেটা গুরুতর হবার আগেই সে সুস্থ হয়ে উঠে । পরবর্তীতে আর কিছু পরীক্ষা চালালেও ফিলিপ সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, এবং ইনফেকশনের কোন লক্ষণ দেখা দেয় না । জেনার বুঝতে পারলেন গুটি বসন্তের টিকা তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। গরুর বসন্তের পুঁজ মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হলেই সেই মানুষ আর গুটি বসন্তে আক্রান্ত হবে না। মানব জাতি পেয়ে গেল এক মহাঔষধ। অনেকটা বিষে বিষ ক্ষয়ের মত অবস্থা।
এরপরেও জেনার তার গবেষণা চালিয়ে যায় । শুরুর দিকে রয়্যাল সোসাইটি তার গবেষণাপত্রগুলি গ্রহণ করে নি । কিন্তু আর বিস্তর গবেষণা আর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার ২৩টি কেস এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়, যার মধ্যে একটি কেস ছিল তার ১১ বছরের ছেলে রবার্টের । তার কিছু সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কিছু ছিল ভ্রান্ত; যদিও আধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ও আনুবিক্ষন পদ্ধতি তার গবেষণা গুলো আরও নির্ভুল করে তুলতে পারত । শেষ পর্যন্ত ভ্যাকসিনেসন পদ্ধতি স্বীকৃতি পায়, এবং ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার ভেলরেসন নিষিদ্ধ করে ও বিনামূল্যে ভ্যাকসিনেসন পদ্ধতির সুচনা করে । মানব জাতি পেয়ে গেল এক মহাঔষধ। এই সাফল্য সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে । হাজার হাজার লোককে স্মল পক্সএর টিকা দেয়া হয় ।
এরপর থেকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনেশন বা টিকার একের পর এক সাফল্য যুক্ত হতে থাকে। বিশ্বের কোটি কোটি জনসংখ্যাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি চলতে থাকে রোগ নির্মূলের চেষ্টা। টিকার আরো আবিস্কার যে সকল রোগের বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ ঘটায়- হুপিং কাশি (১৯১৪), ডিপথেরিয়া (১৯২৬), টিটেনাস (১৯৩৮), ইনফ্লুয়েঞ্জা (১৯৪৪), পোলিও (১৯৫৫), হাম (১৯৬৩), রুবেলা (১৯৬৯) ইত্যাদি। কিন্তু টিকা দেয়া নিয়েও চক্রান্ত ছিল। ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে আন্তজাতিক টিকাদান কর্মসূচির অগ্রগতি স্থবির ছিল। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৩০ মিলিয়ন শিশুদের মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেয়া হয়নি। অবশ্য সামর্থ্যের অভাবও ছিল । কিন্তু বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং আন্তজাতিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসে । ২০০০ খ্রি. ভ্যাকসিন এবং টিকাদানের জন্য গঠিত হয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স, যা গ্যাভি নামে পরিচিত। এতে করে দরিদ্রতম দেশগুলোতে শিশু মৃত্যুর পরিমাণ কমে গেছে ।
লেখাটি শেষ করব টিকা আবিষ্কার করে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিপ্লব ঘটানোর নায়ক এডওয়ার্ড জেনারের একটি উক্তি দিয়ে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, “ মানুষ আমার প্রতি কৃতজ্ঞ নয় বলে আমি বিস্মিত হই না, আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং জীবন দান করেছেন।”
(অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, প্রো-ভিসি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)