ময়দা, ইস্ট, সয়া সস, টক দই আর চিকেন তন্দুরি মসলা – চিকেন তন্দুরি বসনিয়ান রুটি দিয়ে খেতে হলে এগুলো বাজার থেকে কিনে আনতে হয়। ছোট খালা কয়েকদিন আগে আমাদের মফস্বলের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। এই আইটেমটা খাওয়াবেন বলে সিদ্ধান্ত হলো। বাজার করে আনার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। কী মুশকিল! বসনিয়া বলকান উপদ্বীপের একটা দেশের নাম – জানতাম। কিন্তু হেকিম হাবিবুর রহমান সাহেবের ‘ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’ মারফত সেকালের (১৮৯৫ সাল) ঢাকায় প্রচলিত বাহারী নামের অজস্র রুটির নাম জানলেও এই রুটির নাম যতদূর মনে পড়ে দেখিনি ঐ গ্রন্থে। কিংবদন্তী আছে – শুধু ঢাকায় যতো প্রকারের রুটির অস্তিত্ব ছিল বা এখনো আছে, তা খোদ ভারতবর্ষেই ছিল না। না থাক, আবার মফস্বলে ফিরে যাই। ঐ পাঁচটার সবই এক দোকানেই মিললো। বলাবাহুল্য, মিললো চিকেন তন্দুরি মসলাও। তবে এক্ষেত্রে আমাকে অফার করা হলো ঐ মসলা পাকিস্তানিটাও আছে। দৃঢ় অথচ শান্ত কণ্ঠে অবলীলায় বলে দিলাম – পাকিস্তানি কোনো কিছু আমি কিনি না, কিনবো না। পরিচিত সেলসম্যান একটা পাতলা হাসি দিলে আমি সদাই বুঝে নিয়ে ফিরতি রিক্সায় চেপে বসলাম আর ভাবতে লাগলাম।
কী করে এত সহজে পাকিস্তানি মসলাকে ‘না’ বলা যায়? সেই শান্ত-নিষ্ঠুর ‘না’ এর শক্তি কতোটা হলে তা রিক্সায় উঠে বসার পর ভাবনার দরজায় কড়া নাড়তে থাকে বারবার? যেভাবে আটচল্লিশ বছর আগের এরকমই ডিসেম্বরে করাঘাত পড়েছিলো নির্বাচিত কয়েকটি ঘরের দরজায়? ২০১৯ সালে আমার ভাবনার দরজায় যেখানে আমার মন দাঁড়ানো সেখানে ১৯৭১ সালে বাংলার প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীর দরজায় দাঁড়ানো ছিল একেকটা বিশ্বাসঘাতক কালসাপ! সেই বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে লেখার রুচি হয়না আমার। সরল বিশ্বাসে যাঁরাই সেদিন একেকটা দরজা খুলছিলেন, তাঁদের নিয়ে আফসোস হয় আজ। আফসোস হয় এই সময়কে নিয়ে। সময়টা আজ দুর্ভাগা। যে নিয়মে দিন এগিয়ে গেছে, সে নিয়মে আমাদের জ্ঞান এগোতে পেরেছে খুবই অল্প। বলা যায় এক পা এগোতে পারলে তিন পা পিছিয়েছে। ফলাফলে শূন্যও নেই এখন। ঋণাত্মক দূরত্ব পাড়ি দিচ্ছি আমরা অজানা গন্তব্যের পথে।
ওরা সেদিন গুনে-বেছে এই ভূখণ্ডের শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিসেবী, ডাক্তার, সাংবাদিক – প্রত্যেককে ধোঁকা দিয়েছে ওদের এদেশীয় এজেন্টদের ব্যবহার করে। আজ আমরা শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে জ্ঞানে-গরিমায় যেখানে অবস্থান করছি, তা আমাদেরকে দোলাচলে ফেলে দেয় – আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ বিজয়ের আটচল্লিশ বছরের বিবেচনায় ঠিক জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি? না পারিনি? উত্তরটা সম্ভবত সুখকর কিছু হবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় – এদেশে গুণীর কদর হয়না। ইতিহাসের এ সাক্ষ্যের পাদটীকায় লেখা থাকে না – ইতিহাসের সূচনালগ্নের ঠিক দুদিন আগে থেকে তাঁদের মধ্যে খুব কম লোকেরই খোঁজ মিলেছে যাঁরা আক্ষরিক অর্থেই গুণী। আজকের বাংলাদেশের প্রবীণ হিতৈষী যাঁরা জ্ঞানের পূজারী, তাঁদের ক’জন বেঁচে আছেন? যখন ভাবি, একজন করে মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার পাশা, জহির রায়হান, সেলিনা পারভীন, ডা. ফজলে রাব্বী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি. সি. দেবসহ সেদিন নিরুদ্দেশহত্যার শিকার হওয়া বাকিদের যদি এমন পরিণতি না হতো, কে বলতে পারে, আজকের বাংলাদেশ কোথায় থাকতো? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আমার নিরন্তর ভাবনা হয় ভাষাটা নিয়ে। এ ভাবনাটা খুবই যৌক্তিক এজন্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর দুটি ভাষার একটি আমার, আমাদের বাঙলা ভাষা। আর এই ভাষার প্রশ্নেই পাকিস্তান সরকারের আমাদের সাথে বিরোধের সূত্রপাত। নয় মাসের নৃশংসতায় উল্লেখিতদের ছাড়াও আরো অনেককে ওরা হত্যা, গুম করেছে। তাঁদের অপরাধ – তাঁরা বাঙালি জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সবক দিয়ে এসেছেন যার যার জায়গা থেকে। যাঁকে যখন যেভাবে পেরেছে ওরা তুলে নিয়ে গেছে ওদের ক্যাম্পে। কেউবা অতর্কিতে সকলের সামনেই স্মিতহেসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, তবু কুর্ণিশ জানাননি নরপশুদেরকে।
বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানের একমাত্র এমিরেটাস প্রফেসর ড. অরুণ কুমার বসাকের একটা ইন্টারভিউয়ে দেখলাম তিনি তাঁর গবেষণাজীবনের কথা বলতে গিয়ে কোনো একজনের উদ্ধৃতিতে বলছেন – ভুলে যাওয়ার পর যেটুকু মনে থাকবে, সেটাই জ্ঞান। এমন জ্ঞানবিতরণ করার মানসিকতা আমি আমাদের প্রবীণ শিক্ষকদের মধ্যে পেয়েছি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি শিক্ষক শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আবুল কালাম মনজুর মোরশেদকে পেয়েছি। এরকম প্রবীণ শিক্ষকদের কাছে শিখতে পারা, জানতে পারা, পড়তে পারা – অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। এঁদের সমসাময়িকরা বলতে গেলে তেমন কেউই বেঁচে নেই এখন। কিন্তু যাঁরা অকালে ওভাবে হারিয়ে গেছেন তাঁদের অভাব কি কোনোদিনও ঘুচবে? বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদদের অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। স্বাধীনতার আগে-পরেও কারো কারো এমন পরিণতি হয়েছে। মুহম্মদ আবদুল হাই স্যারের মৃত্যুর উদাহরণ দেয়া যায়। রেলপুলিশের রিপোর্টে তাঁর মৃত্যুর বর্ণনায় এসেছে – সময়মতো হেঁটে রেললাইন অতিক্রম করতে না পারায় চালকের চেষ্টাসত্ত্বেও তিনি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। হৃদয়বিদারক। হৃদয়ের বিদারণ আরো বাড়ে যখন এমন কথাও শোনা যায় – তৎকালীন কিছুসংখ্যক সহকর্মীর ষড়যন্ত্রমূলক অপবাদে অতিষ্ঠ হয়ে মানসিক চাপে ছিলেন এই প্রখ্যাত ধ্বনিবিজ্ঞানী। না হলে দশ মাসের ট্রেনিং শেষ না করেই কেন উদ্ভ্রান্তের মতো দেশে চলে আসবেন? কেনইবা অস্থিরতায় শেষ কিছুদিন কাটিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়বেন? ১৯৬৯ সালে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে এই ধ্বনিবিজ্ঞানীর এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু এ লেখায় প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, মুনীর চৌধুরী এবং আনোয়ার পাশা – দুজনই স্যারের নিজহাতে গড়ে তোলা রত্ন। যথাক্রমে ধ্বনিবিজ্ঞান এবং বাঙলা ভাষাতত্ত্বে এ দুজনের অবদান থাকতে পারতো যদি স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁদের স্বাভাবিক মৃত্যুটা অন্তত নিশ্চিত হতো। ২০০৪ সালে জার্মানিতে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিলেন হুমায়ূন আজাদ স্যার। তাঁর ক্ষেত্রে ভাষার না হলেও অধর্মের কোপে ধর্মের পার্থক্য সূচিত হয়। ২০১৫ সালে এসে একইভাবে প্রাণ গেছে মুক্তমনা বিজ্ঞানলেখক অভিজিৎ রায়ের। এ আততায়ীর পরিচয়েও সেই ধর্মব্যাবসার ঘ্রাণ। যখন এ অংশ লিখছি, তখন পুত্রহত্যার বিচার দেখে যেতে পারলেন না পিতা অজয় রায়।
জীবনানন্দ দাশ। বাঙলা কবিতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় নাম। একদল বলেন – মৃত্যুচিন্তা করতে করতে ট্রামের ধাক্কায় আত্মহত্যা করেছেন, ত আরেকদল বলেন – তাঁর মৃত্যুশয্যায়ও বাঁচার আকুতি প্রকাশিত। এদিকে তাঁর কবিতা তাঁর মৃত্যুচিন্তা তুলে ধরেছে অনেকবারই। সবমিলে জীবনানন্দের মরণের আনন্দ অথবা বিষাদ যেটাই হোক না কেন, তা আশ্চর্যজনকভাবে রহস্যাবৃত।
আজ আক্ষরিক অর্থেই একটা পরিপূর্ণ বাঙলা অভিধানের দারুণ অভাব বোধ করি। ইংরেজি ভাষার অক্সন, ক্যামট্যাব, লংম্যান, কলিন্স কোবিল্ড এর অভিধানগুলোর বিপরীতে যখন বাংলা একাডেমির অভিধানের দৈন্যদশা দেখি, আফসোস হয়। খুব আফসোস। ইতিহাসের পতিত নক্ষত্ররাজি, তাঁদের এহেন নিখোঁজ সংবাদ কাঁদায় অত্যাচারীর চাবুকের ঘা হয়ে। এতো এতো অপমৃত্যুর ভিড় ঠেলে জেগে ওঠা সহজ নয় কিছুতেই। কান্না আসাটা ত অস্বাভাবিক নয়!
প্রবাদ আছে – গতস্য শোচনা নাস্তি। এ ধরণের শোচনা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আবার ‘সাইকোসিস’ বলে পরিচিত। ‘সাইকোসিস’ মনোরোগ বলে বিবেচিত। এক্ষেত্রে সচেতনভাবেই সাইকোসিসবাহক হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আমার। শুধু বাঙলা ভাষার নয়, এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রের সম্ভাবনাময় এবং যোগ্যপ্রমাণিত প্রতিটি মানুষকে ধোঁকা দিয়ে মারার অপরাধে ওরা অপরাধী। জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে এখনও বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়। প্রায় পঁচাত্তর বছরেও ঘোচেনি পারমাণবিক অমানবিকতার ক্ষত। আটচল্লিশ বছরে কী করে ঘুচবে বিশ্বাসঘাতক বেয়নেটের ক্ষত? পাকিস্তানিদের জন্য একরাশ ঘৃণাও অপ্রতুল প্রতিদান। তবুও রিক্সায় উঠবো। তবুও ভাবনার দরজায় মন দাঁড়াবে আর দুহাতে গলা টিপে ধরবো বিশ্বাসঘাতক কালসাপেদের।
লেখক – শিক্ষার্থী, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
(বিশেষ কৃতজ্ঞতা – অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।)