১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ৮:৪০
নোটিশ :
Wellcome to our website...

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট ও শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রিপোর্টার
শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪০ পূর্বাহ্ন

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান।।
১৯৩২ সালে জগন্নাথ হল ম্যাগাজিনে ঢাকা ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ছাপা হয়। তাতে তিনি লিখেছিলেন: দিনের পথিক মনে রেখ আমি চলেছিলেম রাতে, সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনও এক দশক অতিক্রান্ত করেনি। হিন্দু ও মুসলমান অভিজাত শ্রেণির দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ এ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাথেয় করে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষ নতুন দিনের দিকে যাত্রা করে। ররীন্দ্রনাথের বাসন্তিকা নামের এই কবিতাটি তাই সাংকেতিক অর্থে সমৃদ্ধ। জাতীয় জীবনে পুরাতনের পৌরহিত্যের দিন শেষ। তবে নতুন দিনের নেতৃত্বকে ভুলে গেলে চলবে না অন্ধকার রাতের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন যারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে বিশেষভাবে স্মরণীয় এর প্রতিষ্ঠালগ্নের প্রধান মানুষেরা। নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যদরে উদ্যোগ ও সহায়তায় এই জনপদের মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হার্টগ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্থপতি ছিলেন না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্চশিক্ষার প্রসারে তার ভূমিকা অগ্রগণ্য; পাল্টামেন্টারিয়ান হিসেবে তাঁর প্রস্তাবেই গড়ে ওঠে লন্ডনের স্কুল অফ অরিয়েন্টাল আর্টস (ল্যাম্বো, ২০১৭) ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ বছরের মূল্যায়নে তাই শুরুর দিনগুলির আশাবাদ ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ২০২১ এর বাস্তবতার তুলনা এসেই যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ও উদ্দেশ্য ধ্রুব নয়। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিকল্প প্লেটোর একাডেমি ও তাঁর শিষ্য এরিস্টটলের পেরিপ্যাটোর মধ্যে কালের পার্থক্য কয়েক দশকের, এবং শিক্ষাপদ্ধতিকে পাঠভিত্তিক থেকে নিরীক্ষাভিত্তিক করে তোলেন এরিস্টটল (প্যান্ডারসন, ১৯৯৭) । পশ্চিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশের সময় থেকে আজকে পর্যন্ত যতদিন অতিবাহিত হয়েছে তা মানবসভ্যতার তুলনায় সামান্য। এই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত ধারণা ও প্রয়োগে বিবিধ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন যেসব মানদণ্ড ব্যবহৃত হচ্ছে সেসবও স্থায়ী বা অপরিহার্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ি দিয়েছে ঔপনিবেশিক, পরাধীন এবং স্বাধীন — এই তিন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার। এর বাইরে বিশ্বজুড়ে বিগত অর্ধশতকে রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশ্বিবদ্যালয়ের আন্তঃসম্পর্কও পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন এতোটাই প্রভাবিবস্তারি ও জটিল যে শতবর্ষে একটি প্রতিষ্ঠানের সরল মূল্যায়ন এখন আর সম্ভব নয়।
উন্নত বিশ্বেও গত অর্ধশতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা, উদ্দেশ্য ও মূল্যায়নের মানদণ্ড নিয়ে যথেষ্ট ওলটপালট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন্ড বা গতিধারা বুঝতে আমরা যুক্তরাজ্যের দুইটি রিপোর্টের একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিতে পারি (তবে এর অর্থ এমন নয় যে আমারা ঔপনিবেশিক চিন্তা-কাঠামোর মধ্যেই ঘুরপাক খেতে চাইছি; বরং ঐ চিন্তাকাঠামোর ক্রিটিক আমাদের মতো দেশগুলোর সরকারি নীতি গঠনে জরুরি)। প্রথম প্রতিবেদনটি রবিনস রিপোর্ট নামে খ্যাত। লর্ড রবিন্সের সভাপতিত্বে উচ্চশিক্ষা কমিটির এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ লর্ড লিওনেল রবিন্স লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসের অধ্যাপক ছিলেন। দ্বিতীয়টি ২০১০ এ প্রকাশিত দা ব্রাউন রিভিউ। যুক্তরাজ্যের সরকার নিয়োজিত উচ্চ শিক্ষার তহবিল এবং শিক্ষার্থী অর্থায়ন বিষয়ক এই “স্বতন্ত্র পর্যালোচনা”র প্রধান ছিলেন ব্যবসায়ী লর্ড ফিলিপ ব্রাউন যিনি ব্রিটিশ প্রেট্রলিয়ামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বা ভূমিকা নিয়ে লিওনেল রবিন্সের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হল: উচ্চশিক্ষা কেবল অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক নাগরিক তৈরির কারখানা নয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌল উদ্দেশ্যও এটা হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত মূল্য অর্থনৈতিক বা অন্য কোনও সূচক দ্বারা পরিমাপযোগ্য বা সংখ্যায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নে জরুরি এর রূপান্তর করবার ক্ষমতাকে যাচাই করা। একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক রূপান্তরের সামর্থ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের পরিমাপক (রবার্ট ২০১০)।
সহজেই অনুমেয়, ব্রাউনের প্রতিবেদন এই অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করবে। এর সারাংশ হচ্ছে: উচ্চতর ডিগ্রির মাধ্যমে ডিগ্রি অর্জনকারীর উচ্চতর আজীবন উপার্জন নিশ্চিত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। কোনও রাখঢাক না রেখেই সেখানে বলা হয় যে ডিগ্রি থেকে বেশি আয় হয়, সে ডিগ্রিতে খরচও বেশি করতে হবে। এবং আয়রোজগার ঠিকমতো নিশ্চিত করতে পারবে না যেসব ডিগ্রি সেগুলো হায়িয়ে যাবে।
রবিন্স ও ব্রাউনের রিপোর্টদ্বয়ের দ্বন্দ্বের চরিত্র ইডিওলজিকাল বা মতাদর্শিক। এই দ্বন্দ্বের বিচার বর্তমান প্রবন্ধে সম্ভব নয়। তবে, আমরা এটিকে মোটা দাগে ব্যক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও বাজারকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈপরীত্য দিয়ে বুঝে নিতে পারি। একথা মনে রাখতে হবে বাজারকেন্দ্রিক শিক্ষাপরিকল্পনা নিশ্ছিদ্র নয়। উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার এবং শিক্ষা ঋণ নিয়ে আজীবন দেনার দায়ে জর্জরিত কোটি কোটি শিক্ষার্থীর প্রসঙ্গগুলি উন্নত বিশ্ব উত্তপ্ত রাজনৈতক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে, প্রভাব রাখছে সরকারের গঠন ও পতনে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দশকের অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতির কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অধিকাংশই তৃতীয় বিশ্বের রুগ্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেটেছে। এই বাস্তবতায় পৃথিবীর অনেক দেশেই, বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়, অর্থ, অস্ত্র এবং ঋণদাতা শক্তিশালী দেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ‘পরামর্শে’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কর্মী সরহবরাহের কারখানায় রূপান্তরের চেষ্টা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রাতিষ্ঠানিক আলস্য, এবং দক্ষতার অভাবের কারণে বাজারকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষার মডেল বাস্তবায়িত হতে পারে নি। এবং ঠিক এই কারণগুলোর জন্যই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও গুরুত্ব হারাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদশের অর্থনীতিতে একাধিক বৈশ্বিক মন্দা ও অতিমারীর প্রভাব ঐ মাত্রায় পড়েনি যে মাত্রায় দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে পড়েছে এবং সেখানকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থনৈতিক হতাশাকে পুঁজি করে চরম ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে এবং তাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। উদাহরণ হিসেবে ব্রাজিলের কথা বলা যায়। ১৯৩৪ সালে স্থাপিত সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাজিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পড়ে। উদার সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক মানসিকতা সৃষ্টিতে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এরকম আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন রাজনৈতিক পরির্তনের ক্ষেত্রে পরিণত হলেও, কেন্দ্রীয় সরকার সেগুলোকে দুর্বল করে রেখেছে। বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির ফসল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট দুই দশকে বাড়েনি। এবং এসব প্রাতিষ্ঠানিক অপুষ্টকরণের উপর যুক্ত হয়েছে উগ্র ডান সন্ত্রাসী হামলা যেমন ২০১৮তে রিওডি জেনেরিও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত যাদুঘরে অগ্নিসংযোগ। ব্রাজিলের বুদ্ধিজীবীদরে একটি অংশ মনে করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ নেই। অধিকতর রাজনৈতিক সচেতনতা ও আত্মসমীক্ষাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানবৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে (সুপার্টি ২০২০)।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এককেটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও এদের কিছু মৌলিক সামজিক উদ্দেশ্য রয়েছে। সমাজগঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন ভূমিকার অন্তরায় উচ্চ শিক্ষার ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ, সরকারি ব্যয় সংকোচন , এবং উগ্র ডানপন্থার উত্থান। গোটা বিশ্ব প্রসঙ্গেই একথা বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্বতা রক্ষায় এই তিনটি বিষয়েই সচেতন থাকতে হবে। উল্লেখ্য বাণিজ্যিকীকরণের বিতর্কটি ক্যান্টিনের খাবারের মূল্য, ভর্তি ফি বৃদ্ধি কিংবা নৈশকোর্সরে মতো কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নের সামর্থ্যই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হতে পারে। বাণিজ্যিকীকরণের প্রধান প্রভাব জ্ঞানতাত্ত্বিক। সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস জ্ঞানের এই আপাত অলাভজনক শাখাগুলোকে রুগ্নদশার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাহিত্যতাত্ত্বিক টেরি ইগলটনের মন্তব্য দিয়ে ইতি টানছি-আমরা আমাদের সময়ে যা দেখেছি তা হল সমালোচনার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৃত্যু। মার্গারেট থ্যাচারের পর থেকে [১৯৯০], উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রগুলো স্থিতিশীলতা বজায় রেখে গেছে; ন্যায়বিচার, ঐতিহ্য, কল্পনা, মানব কল্যাণ, উন্মুক্ত ভাবনা বা ভবিষ্যতের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির মাধ্যমে এটিকে চ্যালেঞ্জ করে নি। কেবল মানবিক বিভাগগুলিতে রাষ্ট্রীয় তহবিল বৃদ্ধির মাধ্যমে এটিকে পরিবর্তন করা যাবে না (কারণ এটা স্রেফ তহবিল একেবারে না থাকার চেয়ে ভালো)। পরিবর্তন হবে তখন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিছু হবে তার কেন্দ্রীয় বিষয় হবে মানবিক মূল্যবোধ এবং নীতির বুদ্ধিদীপ্ত পর্যালোচনা। (ইগলটন, ২০১০)
তথ্যসূত্র
Anderson, Robert. “The ‘Idea of a University’ today”. History & Policy. 2010. Print
Eagleton, Terry. “The death of universities”. London: Guardian, 17-12-2020. Newspaper
Lambo, Angel. “Sir Philip Hartog: Remembering SOAS’s forgotten founder”. SOAS Centenary. London. 2017. https://www.soas.ac.uk/centenary/. Website.
Pedersen, Olaf. The First Universities: Studium Generale and the Origins of University Education in Europe. Cambridge: Cambridge UP, 1997. Print.

Superti, Eliane et al. “Public Universities in Brazil: Between the Social Institution and the Service Provider Organization”.Research on Humanities and Social Sciences. Vol.10, No.24, 2020
(অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, সাবেক ভিসি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর