২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, রাত ৮:২৮
নোটিশ :
Wellcome to our website...

কাঁঠালের সাতকাহন

রিপোর্টার
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৮ অপরাহ্ন

 মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

অ) আষাঢ় মাস। কাঁঠালের মৌসুম চলছে। আজকে সেই ঋতুভিত্তিক বড় আকারের ফলটি ঘিরে লিখতে শুরু করেছি। এ ফলটি গ্রাম বাংলায় বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। আর ফল সংস্কৃতিতে আমের পরেই এর অবস্থান। কথিত আছে যে গ্রাম বাংলার কোন পরিবারের কেউ যদি হাট বাজার থেকে কাঁঠাল বা ইলিশ মাছ কিনে আনে। সেদিন তাকে কিছুটা উচ্চ মাত্রায় দেখা হয়। এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি গর্ব ভরে এগুলো কেনার কথা বলে থাকে। এদিকে কাঁঠাল নিয়ে ছোট বেলায় রশিকতামূলক একটি গল্প শুনেছিলাম। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে বিট্রিশ আমলে এদেশে প্রচুর কাবুলিওয়ালা আসতো। তারা সুদে টাকা খাটাতো। একবার এক কাবুলিওয়ালা কাঁঠাল সুস্বাদু বলে প্রচুর পরিমাণ কাঁঠালের কোয়া বা রোয়া (Pod) খায়। অথচ এর আঠা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল না বিধায় তার দাড়িতে কাঁঠালের আঠা লেগে যায়। আর আঠা এমনভাবে লেগে যায় যে, এগুলো ছাড়াতে ব্যর্থ হয়। সেই সময় দাঁড়ি সম্বলিত এক বৃদ্ধ বাঙালি ওখানে দিয়ে যাচ্ছিল। তখন কাবুলিওয়ালা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে এই মর্মে উক্তি করে বলে যে, ‘হাম ভি কাঁঠাল খায়া, তুম ভি কাঁঠাল খায়া’ আও দু’জনে দস্তি করি’। এতে বাঙালি লোকটি অপ্রস্তুত হলেও এক গাল হেঁসে চলে যায়। এতদ্ব্যতীত কাঁঠাল নিয়ে অনেক রোমান্টিক গান আছে। তার মধ্যে সর্বজনবিদিত ও নন্দিত একটি গানের কলি তুলে ধরা হলো। সেটি হলো “পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পারে ছাড়ে না…..”। এতদ্ব্যতীত কাঁঠাল ঘিরে কতগুলো বাগধারা বা বাগবিধি প্রচলিত আছে। যেমন- কিলে কাঁঠাল পাকানো; মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গা; আমে ভোগ, কিন্তু কাঁঠালে রোগ, ইত্যাদি। তবে কাঁঠালে যে রোগ হয়, সে কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। কেননা এটি হজম করতে হলে সুস্থ পাকস্থলী দরকার। তাছাড়া পরিমিত খেলে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যাহোক, এখন যে কথাটি বলবো, যদিও এটি অসমর্থিত এবং কোন ভিত্তি নেই। তথাপিও চলমান কাহিনী হিসেবে বলতে হচ্ছে। আমরা জানি যে, কাঁঠালের ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো Jackfruit কিন্তু এ শব্দটি কিভাবে হলো, সেই কাহিনীটি এক্ষেত্রে তুলে ধরছি। আর এই বিষয়টি ছোটবেলায় আমার অশীতিপর দাদার কাছ থেকে শুনেছি। তিনি সেই ব্রিটিশ আমলের এন্ট্রাস পাশ ছিলেন এবং চাকুরী করতেন জেমস ফিনলে কোম্পানীতে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর, ধীরে ধীরে বাংলা সহ সারা ভারতবর্ষে ইংরেজরা ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, তাঁরা সারা বাংলার জনপদে নীলচাষ সহ বিভিন্ন বিষয় উপলক্ষ্য করে অবাধে ঘুরতে থাকে। একদা দুই জন ইংরেজ ঢাকার অনতিদূরে সাভারের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় নাকি প্রত্যক্ষ করেন যে, কাঁঠাল গাছের নিচে পড়ে যাওয়া একটি পাকা কাঁঠাল শেয়ালে (ইংরেজী Jackal) খাচ্ছে। তখন তাঁরা নাকি এর নাম Jackfruit বলে অভিহিত করেছিলেন। আর এই নামের পেছনে কারণ হলো যে, ইংল্যান্ড তথা যুক্তরাজ্যে এই ধরনের ফল নেই বলে এর নামকরণ সঙ্গতকারণেই ইংরেজিতে হয়নি। তাই ইংরেজরা এ দেশে আসার পর তাদের কাছে অজানা নতুন ফল হিসেবে এই নামে অভিহিত করেছেন। তবে নামের ব্যাপারে তথ্যভিত্তিক অন্য যে মেসেজটি পাওয়া যায়। তাহলো কাঁঠাল শব্দটি এসেছে পুর্তগিজ “জ্যাকা” থেকে। এদিকে ইংরেজি Jackfruit নামটি প্রকৃতিবিদ ও চিকিৎসক গর্সিয়া দে অর্টা ১৫৬৩ সালে তাঁর সম্পাদিত বইতে উল্লেখ করেছিলেন। আর এর শত বছর পর উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রাল্ফ যান্ডেলস স্টুয়ার্ট এই মর্মে পরার্মশ দিয়েছিলেন যে, এই ফলের নাম উইলিয়াম জ্যাকের এর নামে দেয়া সমীচীন। কেননা এই স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষ থেকে কাঁঠালের দেশ বাংলা, সুমাত্রা, মালয়, ইত্যাদি স্থানে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্তরিকভাবে সম্পন্ন করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। তবে যে ভাবেই নাম দেয়া হোক না কেন, কাঁঠালের ইংরেজী শব্দ Jackfruit হিসেবে অনেক পূর্বেই অভিধানে জায়গা করে নিয়েছে।

আ) কাঁঠাল হলো বাংলাাদেশের জাতীয় ফল। তাছাড়া শ্রীলঙ্কারও জাতীয় ফল এবং একই সাথে কেরালা এবং তামিল নাড়–র রাজ্যফল হিসেবে অভিহিত। এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসে যে, আম এমনই একটি ফল, যা বাংলাদেশের এমন কোন ব্যক্তি নেই যে খায় না। তাছাড়া এর পরিব্যাপ্তি ও গ্রহণযোগ্যতা কাঁঠালের তুলনায় বেশী। কিন্তু কেন কাঁঠালকে জাতীয় ফল হিসেবে ঘোষণা করা হলো, তা বোধগম্য নয়? এক্ষেত্রে হয়তো কাঁঠালের প্রাপ্যতা, গুণাগুণ, স্বাদ ও সুবাসকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যাহোক, কাঁঠাল গাছ বিশে^র ক্রান্তীয় অঞ্চলে ব্যাপক চাষ হয়। বস্তুত গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ফল হলো এই কাঁঠাল। আর দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ঘাট এবং মালয়েশিয়ার রেইন ফরেস্টর মধ্যবর্তী অঞ্চল কাঁঠালের উৎপত্তি স্থান হিসেবে বিবেচিত। এদিকে বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিম বঙ্গ, দক্ষিণ ভারত তথা কেরালা ও তামিলনাড়–, বিহার, মায়ানমার, মালয়, শ্রীলংকা, ইত্যাদি দেশে প্রচুর কাঁঠাল জন্মে। অবশ্য ব্রাজিল, জামাইকা, ইত্যাদি অঞ্চলে সীমিত আকারে হলেও কাঁঠাল জন্মে। সাধারণত লালচে মাটি সম্বলিত উচু এলাকায় অধিক জন্মে। সেহেতু বাংলাদেশের প্রায় অঞ্চলে কমবেশী কাঁঠাল জন্মিলেও ভাওয়ালের গড়, মধুপুরের গড় এবং পাবর্ত্য অঞ্চলে প্রচুর কাঁঠাল জন্মে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, হাজার বছর ধরে ভারত-বাংলার কৃষিতে কাঁঠাল চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আর প্রতœতাত্তি¡ক অনুসন্ধানে জানা যায় প্রায় ৬ হাজার বছর আগ থেকে এ অঞ্চলে কাঁঠালের চাষ হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে, কাঁঠালের বৈজ্ঞানিক নাম আর্টোকার্পাস হেটেরোফাইলাস (Artocarpus heterophyllus) এটি মোরাসিয়া পরিবারভুক্ত এবং গোত্র হলো আর্টোকার্পাস। বিশে^র ফল জগত বিবেচনা করলে এটি বৃহত্তম ফল। কেননা ওজনের আওতায় ছোট বড় হলেও সর্বোচ্চ এক মনের বেশী হতে পারে। বস্তু কাঁঠাল গাছ চিরসবুজ বৃক্ষ, এটি ৯ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। আর এতে দুধ কষা ভরা। পানি দাঁডায় না, এমন উঁচু ও মাঝারি সুনিষ্কাষিত উর্বর জমি কাঁঠালের জন্য উপযোগী। সাধারণত কাঁঠালের বীজ থেকে কাঁঠালের চারা তৈরি করা হয়। উত্তম পাকা কাঁঠাল থেকে পুষ্ট বড় বীজ বের করে ছাই মাখিয়ে ২/৩ দিন ছায়ায় শুকিয়ে বীজতলায় বপন করলে ২০-২৫ দিনে মধ্যে চারা গজায়। তৎপর ২-৩ মাসের চারা সতর্কতার সাথে তুলে কাম্য মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। এতদ্ব্যতীত কলমের মাধ্যমেও করা যায়। যেমন- গুটি কলম, ডাল কলম, চোখ কলম, চারা কলম, ইত্যাদি। বস্তুত সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত চারা বা কলম জ্যেষ্ঠের মাঝামাঝি থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত সময়ে রোপণ করতে হয়। সঙ্গতকারণেই গাছ ও লাইনের দূরত্ব ১২ মিটার করে রাখা আবশ্যক। আর  রোপণের সময় প্রতি গর্তে গোবর ৩৫ কেজি, টিএসপি সার ২১০ গ্রাম এবং এমওপি সার ২১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হয়। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতি গাছের জন্য সারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা আবশ্যক। বীজের চারা বা কলমের চারা দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পরিমিত ও সময়মতো সেচ প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ। গাছ ফলবান হলে এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। এ রোগের আক্রমণে কচি ফলের গায়ে বাদমি রঙের দাগের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে। এক্ষেত্রে ফলিকুর ছত্রাকনাশক ০.০৫% হারে পানিতে মিশিয়ে গাছে ফুল আসার পর থেকে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করা অপরিহার্য। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, কাঁঠাল গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল উভয়ই হয়ে থাকে। পুষ্প মঞ্জরীগুলো উপবৃহত্তকারের নলাকার হয়ে থাকে। অবশ্য ফুলগুলো ছোট ছোট। সাধারণ পুরুষ ফুলগুলো সবুজ বর্ণের এবং লোমশ। পরাগায়নের পরে পুংকেশর ধূসর হয়ে যায় এবং কয়েকদিন পরে ঝরে পড়ে যায়। এদিকে পরাগায়ন্তে একাধিক স্ত্রী ফুলের ডিম্বাশয়ের ফিউশন হতে গঠিত একাধিক ফলগুলো কান্ডের দীর্ঘ ঘন কাÐের উপর বৃদ্ধি পায়। এগুলোর আকার ও রং দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়। প্রাথমিকভাবে হলুজ-সবুজ থেকে হলুদ। তৎপর পরিপক্ক অবস্থায় হলুদ বাদামী হয়ে থাকে। এগুলো শক্ত ও ষড়ভ‚জীয় টিউবারক্লস দিয়ে ঘেরা ছোট ফিমুসযুক্ত এবং এতে আঠালো শেল থাকে। সাধারণত কাঁঠাল জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত বর্ষাকালে পরিপক্ক হয়। আর পাকতে ১২০ থেকে ১৫০ দিন সময় লাগে।

ই) এই বিশ্বে বহুজাতের কাঁঠাল থাকলেও ভারত-বাংলায় চাষাকৃত জাত মোটামুটি দুটি যেমন- ‘গালা ও খাজা’। তাছাড়া এর মাঝামাঝি একটি জাত রয়েছে। সেটি হলো ‘রসখাজা’। আরও কিছু ধরনের কাঁঠাল আছে। যেমন- রুদ্রাক্ষি, সিঙ্গাপুর, সিলোন, বারোমাসী, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী, ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো যে, এ সবগুলোই ভারতে চাষ হলেও কেবল হাজারী কাঁঠাল বাংলাদেশে আছে। এদিকে গালা কাঁঠালের ব্যাপারে উল্লেখ্য যে, এই কাঁঠাল যখন পাকে, তখন এর অভ্যন্তরে রক্ষিত কোষ বা কোয়া (Pod) অত্যন্ত কমল, মিষ্টি ও রসালো প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে মাঝে মধ্যে টক-মিষ্টিও হয়ে থাকে। আর কোষ অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কাঁঠালের গায়ে কাঁটা খুব একটা চ্যাপ্টা হয় না। তাছাড়া পাকার পর একটু লালচে হলুদাভাব হয় এবং কোষগুলো সহজে আলাদা করা যায়। এদিকে খাজা কাঁঠালের ব্যাপারে উল্লেখ্য যে, এর কোয়া বা রোয়া আকারে বড় হয় এবং পাকার পর কম রসালো ও অপেক্ষাকৃত শক্ত বা কচকচে হয়ে থাকে। আর কোষগুলোতে চাপ দিলেও সহজে রস বের হয় না। কোষগুলোর রং ফ্যাকাসে হলুদ ও স্বাদ মোটামুটি মিষ্টি হয়ে থাকে। অনেক এই কাঁঠাল পছন্দ করলেও বেশীর ভাগ মানুষ অতটা পছন্দ করে না। কেননা খাজা কাঁঠাল সহজে হজম হয় না। এই কাঁঠাল পাকার পর সবুজাভা থাকে এবং গায়ের কাঁটাগুলো বড় ও মসৃণ প্রকৃতির হয়ে থাকে। এদিকে এর শক্তিশালী সুগন্ধির ক্ষেত্রে অনেকে পাকা কলা ও আনারসের সুবাসের সংমিশ্রণ বলে মনে করেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এই ফল যে এত সুগন্ধিসহ সুস্বাদু, তার পেছনে কি কারণ নিহিত আছে, সে ব্যাপারে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে গবেষণায় দেখা গেছে, এতে যে উদ্বায়ী যৌগগুলো আছে, সেগুলো এর সুগন্ধি ও সুস্বাদুর ব্যাপারে সবিশেষ ভ‚মিকা রাখে। আর এগুলো হলো- ইথাইল আইসোভ্যালরেট, প্রোপাইল আইসোভ্যালরেট, বুটিল আইসোভ্যালেটে, আইসোবোটিল আইসোভ্যালরেট, ৩-মিথাইলবিউটেল অ্যাসিটেট, ১-বুথানল এবং ২-মিথাইলবুটান-১ অল, ইত্যাদি। আর এখানে একটি কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের প্রায় কৃষিজাত শষ্যাদি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এখন অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে কাঁঠালও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউড ইতোমধ্যে দুটি জাতের উচ্চ ফলনশীল কাঁঠাল উদ্ভাবন করেছে, যেমন- বারি কাঁঠাল-১ এবং বারি কাঁঠাল-২। তবে বারি কাঁঠাল-১ সারাদেশের চাষের উপযোগী এবং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, কাঁঠালের নিকট জ্ঞাতি ফল হিসেবে ডেউয়া এবং ব্রেডফুট প্রজাতি দু’টির মধ্যে ডেউয়া কেবল বাংলাদেশে জন্মে থাকে। আর এই ডেউয়া স্বাদে টক-মিষ্টি হয়ে থাকে।

ঈ) দেশের বিভিন্ন জনপদে একটি প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায়। তাহলো “কাঁঠালের কোন কিছু ফেলনা নয়” বস্তুত এই প্রবাদের সত্যতা শতভাগ বললে বেশী বলা হবে না। কারণ কাঁচা কাঁঠাল তরকারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় ভাবে এই কাঁচা কাঁঠালকে এঁচোড় বলে অভিহিত করা হয়। এটি কেবল শুধু সবজি হিসেবে নয়, মাছ-মাংসের সহগ দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আর পাকা কাঁঠালের কোয়া’র সুগন্ধি ও সুস্বাদুর কথা তো বলা নিস্প্রয়োজন। এর ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য ভিত্তি করে জেলী, চাটনি, চিপস, আইসক্রিম, জ্যাম, কেক, সিরাপ, ক্যান্ডি, স্যুপ, প্যাষ্ট্রি, মিষ্টান্ন, কাঁঠাল সত্ব, রিসিপি, ইত্যাদি তৈরীর ব্যাপারে কাঁঠাল অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। তাছাড়া কাঁঠালের কোয়ার রস দিয়ে বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরীর প্রচলন আছে। আর দুধ-ভাত-কাঁঠাল বাঙালিদের খুব উপাদেয় খাদ্য। তাছাড়া কাঁঠাল খাওয়ার পর বীচি তো বাড়তি নিয়ামক হিসেবে অভিহিত। কেননা বিচি তরকারি সহ নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই বিচি ভেজে খেতে খুবই মজাদার লাগে। তাছাড়া মুরগীর গোস্তের সাথে আলু ন্যায় কাজ করে। আর কাঁঠাল খাওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ মোটেই উচ্ছিষ্ট নয়, বরং এগুলো উত্তম গো খাদ্য হিসেবে সর্বজনবিদিত। তাছাড়া কাঁঠাল কাঠের আসবাবপত্র আলাদা আমেজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কারণ এই কাঠের গুণ ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনেক সময় সেগুন কাঠও হার মানে। বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে এই কাঠ উপযোগী। তাছাড়া সারি কাঁঠাল কাঠ এমনই সুন্দর রংয়ের যে বাড়তি পলিশ লাগে না। এদিকে সনাতনী ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে কাঁঠাল কাঠ পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। কেননা এই কাঠের তৈরী “অভনি পালকা” নামে অলংকৃত কাঠের তক্তাকে কেরালায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় পুরোহিতের আসন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতদ্ব্যতীত দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধরা রঙিন হৃদয়ের প্রতিভ‚ত হিসেবে এই কাঁঠাল কাঠ ব্যবহার করে থাকে। শুধু তাই নয়, সন্যাসীদের পোশাকগুলো কাঁঠালের আদলে হালকা বাদামী রংয়ের হয়ে থাকে। আর ভিয়েতনামে কাঁঠালের কাঠ দিয়ে তৈরী মন্দিরে বৌদ্ধমূর্তি কেবল মূল্যবানই নয়। একই সাথে সবার কাছে পুজনীয়। তাছাড়া কাঁঠাল পাতা ছাগল সহ সকল তৃণবোজী প্রাণীদের বেশ প্রিয় খাবার। মজার ব্যাপার হলো যে, কাঁঠালের আঠা ছিদ্র বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

উ) সত্যি কথা বলতে কি, কাঁঠালের গুণ অপরিসীম। এটি একটি বহুমুখী গুণসম্বলিত গুচ্ছ ফল, যাতে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, থায়ামিন বা ভিটামিন-বি, নিয়াসিন ও রাইবোফ্লাভিনের মত প্রচুর ভিটামিন আছে। মূলত বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন বি সমৃদ্ধ ফলের মধ্যে অন্যতম হলো কাঁঠাল। এতদ্ব্যতীত এতে প্রয়োজনীয় প্রোটিন এবং আঁশ বা ফাইবার কন্টেন্ট রয়েছে।কাঁঠালের বীজও ভোজ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্যে বেশ উপকারী। আসলে এই ফল বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, ভিটামিন, ফাইবার, চর্বি, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টম, ইলেক্ট্রোলাইট, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটগুলোর একটি শক্তিশালী উৎস। এতে যদিও ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। তথাপিও কোন কোলেস্টেরল বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে না। গুণের দিক দিয়ে যদি বিশদ ভাবে বলি, তাহলে বলতে হয় যে, কাঁঠালে ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে ভরপুর, যেমন ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ৬, ভিটামিন বি- ৩, প্যান্টেনিনিক এসিড, ফোল্যাট, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, ম্যাগনেশিয়াম, ইত্যাদি। এই সব পুষ্টি উপাদান বিশুদ্ধ রক্ত গঠন প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। এটি শরীরের লৌহ শোষণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং এর ফলশ্রæতিতে অ্যানিমিয়া প্রতিরোধসহ চিকিৎসার পথ সুগম করে থাকে। আর নিয়াসিন এবং থায়ামিনের সমৃদ্ধতার কারণে পেশীর দুর্বলতা, ক্লান্তি, মানসিক চাপ, বিষন্নতা ও দুর্বলতা দূর হয় এবং একই সাথে স্নায়ুতন্ত্র শক্তিশালী হয়। অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিআলসারেটিভ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং এন্টি প্রদানজনিত বৈশিষ্ট্যের কারণে আলসারসহ বিভিন্ন রোগের নিরাময় করার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এই ফল অনবদ্য ভ‚মিকা পালন করে থাকে। তাছাড়া কার্ডিওভাসকুলার রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং একই সাথে হাড়কে শক্তিশালী করে। কাঁঠাল এমনই একটি ফল, যার সুবাদে চোখের দৃষ্টি বৃদ্ধি হয় এবং ছানি প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়াও শ্লেষ্মা এবং ত্বকের অখন্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে এর ভ‚মিকা কম নয়। সত্যি কথা বলতে কি, কাঁঠালের মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্লভোন, ফাইটোনিউট্রেয়েন্টস ও ভিটামিন সি, যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। কারণ এটি মানব শরীরের ফ্রি র‌্যাডিক্যাল এবং দেহের কোষগুলির ডিএনএ এর ক্ষতিতে বাধা দেয়। আর উচ্চ ফাইবার কন্টেন্ট বৃহৎ অন্ত্র থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণে সাহায্য করে। সুস্থ হজমসহ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট পরিষ্কার করতে বেশ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। ফাইবারগুলি আমাদের পাচনতন্ত্রকে সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এগুলি শরীর থেকে বর্জ্য নিষ্কাশন নিশ্চিত করে। এই ফল অ্যান্টি-আলসারেটিভ এবং পেটের আলসারের জন্য উপকারী এবং একই সাথে অন্যান্য পাচক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত কাঁঠালের বীজগুলি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পুষ্টি সমৃদ্ধ। কাঁঠালের বীজ ভিটামিন-এ এর সমৃদ্ধ উৎস, যা স্বাস্থ্যকর চোখ বজায় রাখতে সাহায্য করে। বীজে উচ্চ পরিমাণ পটাসিয়াম থাকে বিধায় এটি উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া কাঁঠাল গাছের শেকড় হাঁপানী, চর্মরোগ ও ডাইরিয়া উপশম করে। তবে যতই গুণ থাকুক না কেন, এটি গর্ভবতী নারীদের এবং বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা সমীচীন। তাছাড়া কাঁঠাল খাওয়ার পর অ্যালার্জিও হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের কাঁঠাল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। তাছাড়া যে কোনও ধরনের অস্ত্রোপাচারের আগে কাঁঠাল খাওয়া উচিত নয়। আর হজমে সমস্যা থাকলে কাঁঠাল না খাওয়ায় বিধেয়।

ঊ) কাঁঠাল কেবল সুগন্ধিযুক্ত সুস্বাদু ফলই নয়, এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে প্রতিবছর ২.৫১ থেকে ২.৬৭ লক্ষ মে.টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। সত্যি কথা বলতে কি, আনুষ্ঠানিক চাষ (কাঁঠাল বাগান) ছাড়াও গ্রাম বাংলার প্রায় গ্রামের আনাচে-কানাচে সহ রাস্তার পাশের কাঁঠাল গাছ বিদ্যমান। এই গাছ থেকে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও কাঁঠাল বিক্রি করা হয়ে থাকে। কাঁঠালের বিপণনে তিনটি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট যেমন উৎপাদক, মধ্য স্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ী (পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা)। যতদূর তথ্যাদি নিয়েছি তাতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কাঁঠালের ব্যবসা হয়ে থাকে এবং এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক মানুষ জড়িত।

ঋ) পরিশেষে এই কথা বলে শেষ করছি যে, বৃহৎ ও সুস্বাদু ফল হিসেবে কাঁঠাল আমাদের ফল সংস্কৃতিতে বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, দিন দিন অন্য সব গাছপালার মতো কাঁঠাল গাছও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা মাফিক কাঁঠাল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার সহ আমাদের সকলকে সচেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। In fine, we may salute the jackfruit as our national fruit in the plea of heritage and traditional prestige.

সূত্রাদি ঃ

১। স্বাস্থ্য সাময়িকী, বর্ষ ৪০, সংখ্যা ১-৩, বৈশাখ-আষাঢ়/১৪২৪ইং।

২। বাংলাপিডিয়া।

৩। উইকিপিডিয়া।

৪। উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা- সম্পাদনা প্রফেসর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও সৈয়দ হাবীবুর রহমান।

৫। ইন্টারনেট।

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব, বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর