মো. আহসান হাবিব।।
১ জুলাই ২০২১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি। বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তির আঁতুড়ঘর খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকের এই আসনে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।উচ্চ শিক্ষার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটিকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসতে অনেকের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। (পি.জে হার্টগ)
স্যার হার্টগ ২ মার্চ ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাবা মায়ের কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা হলান্ডে বাস করলেও উনিশ শতকের শুরুর দিকে তাঁর এক পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে যান। পিতা আলফানসোঁ হার্টগ ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে ইংল্যান্ডেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। স্যার পি. জে হার্টগ বৃটিশ হলেও তিনি উদারপন্থী ইহুদি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
শিক্ষানুরাগী পরিবারের সন্তান হওয়ায় তাঁকে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বজনীন শিক্ষা অর্জন করতে বেগ পেতে হয়নি। তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুলে এবং ম্যানচেস্টারে ওয়েন্স কলেজে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ভিক্টোরিয়া বিদ্যালয় থেকে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে এসসি ডিগ্রি এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রসায়ন শাস্ত্রে বিএসসি (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। জার্মানি ও ফ্রান্সে বেশ কয়েক বছর রাসায়নিক গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সহকারী প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ম্যানচেস্টারে ওয়েন্স কলেজের রসায়ন বিভাগে। কিছুদিনের জন্য ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের প্রকল্পে খণ্ডকালীন সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৩ থেকে সুদীর্ঘ ১৭ বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক রেজিস্ট্রার পদে অত্যন্ত দক্ষতা ও মর্যাদার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বিবেচনায় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগকে। চার হাজার টাকা বেতন ও বাসভবন সুবিধা নিয়ে স্ত্রী ম্যাবেল হেলেন হার্টগ ও দুই শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অফিস কলকাতায়। অবশেষে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি শীতের এক বিকালে ঢাকার বলধার বাগানবাড়িতে সংবর্ধনা দেয়া হয় হার্টগ দম্পতিকে।সেদিনের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মনোনিবেশ করেন।
পাঁচ বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে একজন সফল,নিষ্ঠাবান,এবং দক্ষ প্রশাসক হিসেবে আমরা তাঁকে জানতে পারি।
উপমহাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুকরণ না করে বরং জার্মান ও ফরাসি শিক্ষাব্যবস্থায় স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনন্য মাত্রায় নেওয়ার স্বপ্ন দেখে গেছেন তিনি।
তিনি নিঃসন্দেহে একজন অসাম্প্রদায়িক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অগ্রনায়ক। পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের এগিয়ে নিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তাদের কথা মাথায় রেখে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘অ্যারাবিক এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ ‘ বিভাগ। হিন্দু সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে খোলা হয় ‘স্যান্সক্রিটিক স্টাডিজ এন্ড বেঙ্গলি ‘।প্রকৃতপক্ষে দুই জাতিকে নিজ নিজ ঐতিহ্যের দিকে ধাবিত করতেই স্যার হার্টগ-র এমন যুগান্তকারী উদ্যোগ। যা অসাম্প্রদায়িক চেতনার চমৎকার উদাহরণ।
তিনি ছিলেন অনন্য স্বপ্নদ্রষ্টা। পূর্ব বাংলায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই আর্থ- সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে তিনি মনেপ্রাণে স্বপ্ন দেখতেন। ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টি, পাকিস্তানী নিপীড়ন-নির্যাতনের অমানবিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীর অকুতোভয় অবদান তারই প্রমাণ।
নব্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট, টানাপোড়েন থাকবে এটা স্বাভাবিক। এমনকি বাজেট সীমাবদ্ধতাও ছিল প্রকট।এমন সীমাবদ্ধতার মাঝেও শিক্ষা ব্যবস্থাকে গতিশীল করতে স্যার হার্টগ কখনো পিছপা হননি। বিভিন্ন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার গড়ে তোলেন। পাঠাগারের জন্য তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগটি আমাদেরকে দারুণভাবে তৃপ্ত করে এবং একইসঙ্গে একজন নিবেদিত কর্মবীর হিসেবে তাঁকে জানতে পারি।
পি.জে হার্টগ একজন শিক্ষার্থীবান্ধব প্রশাসক ছিলেন। শিক্ষকরা ঠিক মতো ক্লাসে পড়াচ্ছেন কিনা,কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে আসছে কিনা,পাস করার পর ছাত্ররা কোথায় চাকরি করছে , অসুস্থ শিক্ষার্থীকে দেখতে যাওয়া প্রভৃতি খোঁজ খবর তিনি রাখতেন।
শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই নয় বরং সহকর্মীদের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন বন্ধুপ্রতিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ও তাকে ভাবিয়ে তুলতো। প্রভাষক আবুল হুসেন (শিখা গোষ্ঠীর অন্যতম পুরোধা) পায়ে চোট পেয়ে একদিন ক্লাসে না আসলে তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন। শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর প্রতি উনার যে সহানুভূতি তা উদার ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তিনি সৎ ও নির্মোহ ছিলেন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাত করতেন না। ভারত এবং ইংল্যান্ডে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিতেন। যার ফলে দেশ – বিদেশ থেকে আবেদন আসত। বন্ধুদের সুপারিশকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং একাডেমিক যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতেন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ।তাইতো ইংরেজি বিভাগে সি.এল.রেন, দর্শনে জর্জ হ্যারি ল্যাংলি, রসায়নে জ্ঞানচন্দ্র, পদার্থবিজ্ঞানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং ইতিহাসে এ.এফ রহমানের সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞ পণ্ডিত ও প্রাজ্ঞজনদের নিয়োগ দিয়েছিলেন তাঁদের স্বীয় যোগ্যতায়।
বন্ধু মহলেও তিনি ছিলেন প্রিয়পাত্র। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড ও বোরনের মতো অনেক আধুনিকমনা ব্যক্তি ছিলেন স্যার হার্টগ-র বন্ধু। ব্রিটেনসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজাতে চেষ্টা করেছেন তিনি। কতটা দরদ ও ভালোবাসা থাকলে এমন কাজ করা যায় তা উনাকে না জানলে জানাই হতো না।
পি.জে হার্টগ-র ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, হিন্দি, উর্দু এবং বাংলা ভাষায় ছিল অসামান্য দখল। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে An Examination of Examinations;The Marks of Examination, culture :It’s History and meaning উল্লেখযোগ্য।
পি.জে হার্টগ পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কিছু নিয়ম চালু করে গিয়েছলেন যা আজও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান আছে।শিক্ষকদের বেতন,ভাতা,প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। তিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যানচেস্টার ওয়েলস কলেজে বিশপ বার্কলে স্কলার হিসেবে যোগ দেন। খুব কম সংখ্যক মানুষই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। শিক্ষকতার চেয়ে প্রশাসক হিসেবে প্রশাসনকে মজবুত করার প্রতিই তিনি সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন।
স্যার পি.জে হার্টগ একজন কর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জাঁকজমকভরা গভর্নমেন্ট হাউস তারঁ জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরত্ব একটু বেশি হওয়ায় তিনি সেখানে থাকেননি। কাজ পাগল মানুষটার এই ত্যাগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই। যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
প্রিয়তম স্বামীর কর্ম ব্যস্ততায় নিঃসঙ্গ স্ত্রী লেডি ম্যাবেল হার্টগ-রও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবদান কম না। বাঙালি ছাত্রীদের সঙ্গ দিতেন। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় তিনি চাইতেন বাঙালি নারীরা বেশি বেশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোক।মাঝে মাঝে ছাত্রীদের বাসায় এনে আপ্যায়ন করতেন। ফিরতে দেরি হলে ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। তাঁর এই ভূমিকায় নিঃসন্দেহে তাকে যোগ্য স্বামীর যোগ্য স্ত্রী বলা যায়। প্রিয়তম স্বামীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, ” P.J Hartog – A Memoir”
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ৩০ নভেম্বর স্যার পি.জে হার্টগ-এর উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়। ঐবছরই তাকে সম্মানসূচক এলএলডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
প্রথম উপাচার্যকে স্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি হোস্টেল নির্মাণ করেছে। যে হোস্টেলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা থাকে।
তিনি ১৯২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় শিক্ষাবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এবং পরীক্ষায় নির্ভরযোগ্যতা অনুসন্ধানের জন্য গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ইংলিশ কমিটির ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি লন্ডনে বসবাসরত উদারপন্থী ইহুদিদের ধর্মমন্দির (সিন্যাগগ)পরিচালনা পরিষদের সদস্যও ছিলেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে নাইটহুটে ভূষিত করা হয়।১৯৪৭ সালের ২৭ জুন লন্ডনের একটি নার্সিং হোমে ৮৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান ব্যক্তি।
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবর্ষ উদযাপন করছে।যাদের অসামান্য অবদানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ সমাদৃত- তাঁদের মধ্য এক দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকার নাম স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ।আশা করছি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তাদের প্রথম উপাচার্যকে স্মরণ করছে।বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তির আঁতুড়ঘরে যে মানুষটি সর্বপ্রথম আলো জ্বালিয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া দরকার,লেখালেখি হওয়া দরকার,সেমিনার সিম্পোজিয়াম হওয়া দরকার। আমৃত্যু বাঙালির হৃদয়ে তিনি চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
(লেখক, মো. আহসান হাবিব , তরুণ কলামিস্ট ,সদস্য, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, সাবেক শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)