৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, সকাল ৬:২১
নোটিশ :
Wellcome to our website...

হায়রে তালাকনামা কার দোষে তুই এলি?

রিপোর্টার
রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২১ পূর্বাহ্ন

* মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব।।
কয়েকদিন আগে ইউটিউবে দেখলাম ষাট/সত্তর দশকের সিনেমার অন্যতম কোন এক জনপ্রিয় নায়িকা অকালেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর অব্যবহিত পর তার বাক্সে একটি তালাকনামা পাওয়া যায়, যা তিনি সযতনে রেখে দিয়েছিলেন। এতে কি প্রতীয়মান হয় না যে কতখানি হৃদয়ভাঙ্গা কষ্ট করে রেখে দিয়েছিলেন এই অনাকাঙ্খিত কাগজটি? একদিকে তাঁর কাছে ঘৃণিত; আবার অন্যদিকে মহামূল্যবান। কেননা শুধু এর কারনে তার জীবনের মোড় সম্পূর্ণরূপে ঘুরে গিয়েছে। বস্তুত বাংলার পারিবারিক সংস্কৃতির আওতায় স্বামী কি স্ত্রী, যেই হোক না কেন, সহজে কেউ তালাক দিতে চায় না। একান্ত অবস্থার শিকার হয়ে এই ঘৃণিত কাজ করে থাকে। যে ভাবেই বলি না কেন, মানব জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেছেন যে তোমাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি (স্বামী-স্ত্রী রূপে) জোড়ায় জোড়ায় (সূরা নাবা, আয়াত-৮)। বাল্যকালে এই রকম আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা দেখেছিলাম, যা না হয় পরে তুলে ধরা হবে। যাহোক, প্রথমে তালাকের কিছু মৌলিক বিষয়কে ঘিরে সঙ্গতকারণেই নিম্নে আলোকপাত করার প্রয়াসী হয়েছি।
অ) আজকের আধুনিক সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বৈধ এবং আইন দ্বারা সমর্থিত হলেও সমাজে তার স্বীকৃতি পায় সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই। তাই তালাক তথা বিবাহবিচ্ছেদের প্রথা এখনকার নয়। এটি যিশুখৃষ্টের জন্মের অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ খৃষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির রাজত্বকালে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। এর নজির হিসেবে উল্লেখ্য যে তখনকার পাথরের গায়ে ২৮২টি আইন খোদাই করা ছিল, যার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনটি বলা তবিয়তে অন্তর্ভূক্ত ছিল। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, আদিতে বিয়ে প্রথা প্রচলিত ছিল না। তখন স্বেচ্ছাচারিতা প্রকট ছিল। যে বেশি শিকার করতে পারতো বা ফসল ফলাতে পারতো তার সঙ্গী বা সঙ্গীনির অভাব হতো না। যাহোক, আদিম যুগে যখন মানুষ টোটেম গ্রুপের আওতায় সমাজবদ্ধ হতে থাকে, তখনই বিবাহ শুরু। আবার এই ভাবে ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য সম্বলিত দুটি পৃথক সত্ত্বা এক সূত্রে গাঁথা হলে ছন্দপতন হওয়া স্বাভাবিক বলে বিচ্ছেদও শুরু হয়। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, তালাকের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ডিভোর্স । এই “ডিভোর্স” এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে, যার অর্থ বিচ্ছেদ। আর এটি “ডিভোর্টের” শব্দের সমতুল্য। এক্ষেত্রে “উর” এর মানে আলাদা, এর অর্থ বিভিন্ন পন্থায় ঘুরে আসা। মজার ব্যাপার হলো যে, এই ডিভোর্স শব্দটি ১৪ শতকের পরবর্তী সময়ে ফরাসি শব্দভান্ডারে অর্ন্তুভুক্ত থাকলেও ১৩৫০-১৪০০ সালের দিকে ইংরেজিতে জায়গা করে নেয়। বর্তমানে, যদিও বিবাহবিচ্ছেদ বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ বা সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের সর্বাধিক জনপ্রিয় সংজ্ঞাগুলির মধ্যে তিনটি উল্লেখ করা হলো। প্রথমত- বিবাহের আওতায় সম্পূর্ণভাবে স্বামী এবং স্ত্রীকে একসাথে বসবাসের বৈবাহিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেওয়ার একটি বিচারিক ঘোষণা; দ্বিতীয়তঃ প্রতিষ্ঠিত প্রথা অনুযায়ী স্বামী ও স্ত্রীর যে কোন একজনের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ এবং শেষতঃ সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা, যা বৈবাহিক মিলনকে বিচ্ছিন্ন করা বুঝায়। মূলত তালাক শব্দটির উৎস আরবী ভাষা থেকে, যার অর্থ হলো কোনো কিছু ভেঙ্গে ফেলা বা ছিন্ন করা। মুসলিম আইনের বিধান মতে তালাক স্বামী-স্ত্রীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। যখন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এমন এক চরম নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছায় যে দুইজনের পক্ষে একত্রে বসবাস করা সম্ভব হয় না। তখনই যে কোন এক পক্ষ থেকে বা উভয়েই কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে তালাকের মাধ্যমে তাদের এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, মুসলিম আইনের বিধানমতে তালাক দেবার ক্ষমতা বা অধিকার স্বামী ও স্ত্রীর সমান নয়। স্বামীর এক্ষেত্রে প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতা রয়েছে। তথাপিও স্বামী বা স্ত্রী যে কোন এক জনের ইচ্ছেতে (কিছু আইনগত শর্ত পূরণের মাধ্যমে) তালাক হতে পারে। মুসলিম আইন অনুযায়ী নিম্নলিখিত ভাবে তালাক দেওয়া যায়:
স্বামীর পক্ষ থেকে তালাকের ব্যাপারে উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ন বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিস্কের মুসলিম ব্যক্তি যে কোন সময় কোন কারণ দশানো ছাড়াই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। এতে আইনের কাছে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়না। আশ্চর্যর বিষয় হলো যে তাকে কেন তালাক দেওয়া হলো স্ত্রী তা জানতে চাইতে পারেনা। তবে এক্ষেত্রে এখনও অনেকে মনে করেন “এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক” বা বায়েন তালাক উচ্চারণ করা মাত্র তালাক হয়ে যায়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। স্বামী যে কোন সময় তালাক দিতে পারলেও তাকে আইনগত ভাবে সব নিয়ম মেনেই তালাক দিতে হয়।
এদিকে স্ত্রী তিন উপায়ে তালাক দিতে পারেন যেমন (ক) তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে (নিকাহনামার ১৮ নং ঘর বা অনুচ্ছেদ স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাকা প্রদানের ক্ষমতা অর্পন করে থাকে, সে ক্ষমতার বলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চায়, তাহলে সে বিচ্ছেদ, তালাক-ই তৌফিজ বলে) (খ) খুলার মাধ্যমে (স্বামী এবং স্ত্রীর আলোচনার সাপেক্ষে নিজেদের সমঝোতার মাধ্যমে যে বিচ্ছেদ হয়, তাকে খুলা বলে। তবে স্বামীকে খুলা বিচ্ছেদে রাজী করানোর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর। অবশ্য এক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ইদ্দতকালীন সময়ে ও গর্ভস্থ সন্তানের ভরনপোষণ দিতে বাধ্য)। (গ) এখন আদালতের মাধ্যমে তালাক অহরহ দেখা যায়। এ সূত্র ধরে স্বামী-স্ত্রী দুই জনই নিজেদের ইচ্ছাতে নিজেদের সম্মতিক্রমে সমঝতার মাধ্যমে তালাকের ব্যবস্থা করতে পারেন। যদিও বর্তমানে তালাক রেজিস্ট্রেশন করা এখন আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। তালাক প্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী কি পুনরায় বিয়ে করতে পারবে? হাঁ পারে। সেক্ষেত্রে নতুন করে বিয়ে করতে হবে। আর তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে? এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে তালাকের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসদ্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা বহন করবে। যদি বাবা দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন। আর তালাক কখন প্রত্যাহার করা যায়? সেক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগেই তালাক প্রত্যাহার করা যায়। মূলত কোন ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথা শীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ/পৌর/সিটি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিসের নকল প্রদান করতে হবে। এ ব্যাপারে বিশদ আইন ও বিধিমালা রয়েছে, যা প্রবন্ধের কলেবরের সংক্ষিপ্ততার স্বার্থে বর্ণনা করা সম্ভব হলো না। তবে কিছুটা উল্লেখ না করা হলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই যৎকিঞ্চিত তুলে ধরা হলো। প্রকাশ থাকে যে ৭(২) ধারা অনুযায়ী নোটিশ ছাড়া তালাক দিলে এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার শাস্তি হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তালাক-ই-তৌফিজ ও খুলার মাধ্যমে স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ না নিতে পারে এবং স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন মনে করে তাহলে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে। সেই কারনগুলোর প্রতি নিম্নে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো:
* চার বৎসর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে; দুই বৎসর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে; স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদন্ড হলে; স্বামী কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে; বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে; স্বামী দুই বৎসর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে; বিবাহ অস্বীকার করলে। তাছাড়া কোন মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটির ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে; তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে, তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে। এদিকে স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে এবং স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে বিচ্ছেদ হতে পারে। এই নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে অভ্যাসগত ভাবে স্ত্রীকে আঘাত করলে বা নিষ্ঠুর আচরণ করলে, উক্ত আচরণ দৈহিক পীড়নের পর্যায়ে না পড়লেও, তার জীবন শোচনীয় করে তুলেছে এমন হলে; স্বামী খারাপ মেয়ের সাথে জীবন যাপন করলে; স্ত্রীকে অনৈতিক জীবন যাপনে বাধ্য করলে; স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করলে; স্ত্রীকে ধর্মপালনে বাধা দিলে; একাধিক স্ত্রী থাকলে সকলের সাথে সমান ব্যবহার না করলে এবং অন্য যে কোন কারণে, যে সকল কারণে মুসলিম আইনে বিয়ের চুক্তি ভঙ্গ হয়।
অবশ্য আদালতে উপরিউক্ত অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে। আদালত ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে। চেয়ারম্যান উক্ত নোটিসকে তালাক সংক্রান্ত নোটিস হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবেন এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবেন সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্ত ভাবে কার্যকর হবে।
(ই) এতক্ষণ মুসলিম ধর্মের তালাক ঘিরে আলাপ করা হলো। এবার আসুন সনাতন হিন্দু ও খৃষ্টান ধর্মে তালাক নিয়ে যৎকিঞ্চিত কথা বলা যাক। বস্তুত সনাতন হিন্দু আইনে সরাসরি বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই। তবে ভারতে ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ (সাত পাকে বাঁধা) আইনে কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এ আইন প্রযোজ্য নয়। স্ত্রী যদি একান্তই মনে করেন যে, স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা দুর্বিসহ, তা হলে তিনি পিত্রালয়ে বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে পৃথক থাকতে পারেন এবং এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হন। এদিকে ১৯৪৬ সালে বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান এবং ভরণপোষণ আইন পাস হওয়ার পর, এ আইন অনুযায়ী- এক স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথক থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবেন।
আর খ্রিষ্টানদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে, তা ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত, যা ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্ট নামে পরিচিত। কিন্তু এ আইনে কোনো ক্যাথলিক খৃষ্টান বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালে তা গ্রহণীয় নয়। অবশ্য প্রোটেষ্ট্যান্ট খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বৈধ বিয়ের বিচ্ছেদ মেনে নেন। তবে বিশেষ বিবেচনায় অথবা চার্চের হস্তক্ষেপে কিছু ক্ষেত্রে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতে দেখা যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্টের বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে নারীকে অধিকার প্রদান করা হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে স্ত্রীর ক্ষমতা ও অধিকারকে স্বামীর পাশাপাশি সমুন্নত রাখা হয়েছে।
(ঈ) শুধু দেশে নয় সারা বিশ্বেই তালাক জ্যামিতিক গতিতে বেড়ে চলেছে। আর তালাকের দিক দিয়ে আমেরিকা রেকর্ড করে ফেলেছে। তালাক এখন স্বাভাবিক ব্যাপার, যেন ভাত-মাছ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাহোক দেশে তালাক বাড়ছে। গ্রামে যেমন, তেমনই শহরে। শহরের চেয়ে গ্রামে তালাকের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক ২০২৩-এর ফলাফলে দেখা যায় যে, গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে তালাকের সংখ্যা ১১, আর শহরে ৯। তালাক বৃদ্ধি বিশেষত গ্রামে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে এটি অধিক পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। গ্রামে বাল্যবিবাহের সংখ্যাও বেশি। যখন কম বয়সী একটি মেয়ের দুয়েকটি সন্তান নিয়ে তালাক হয়ে যায়, তখন তার দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা ও অনিশ্চয়তার শেষ থাকে না। দ্বিতীয় বিবাহ যেমন তার জন্য কঠিন হয়ে ওঠে, তেমনি বাবা-মার কাছেও অনেক সময় আশ্রয় জোটে না কিংবা তাদের আশ্রয় দেয়ার মতো অবস্থা থাকে না। এহেন পরিস্থিতিতে তালাকপ্রাপ্তা ও তার সন্তান-সন্ততির কী দুঃসহ অবস্থা দাঁড়ায়, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। আসলে তালাকের কারণ প্রধানত দারিদ্র্য বা পারিবারিক ব্যয়বহনের অক্ষমতা। তাছাড়া পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা ইত্যাদিও তালাকের জন্য দায়ী। মূলত অভাব-দারিদ্র্য পারিবারিক অশান্তির প্রধান কারণ। আর পারিবারিক অশান্তি তালাকের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। পারিবারিক অশান্তি বা কলহ-বিবাদ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনের মূলে। দেখা গেছে যে, দেশের যে সব এলাকায় অভাব-দারিদ্র্য বেশি, সে সব এলাকায় তালাকের হার বেশি। এছাড়া বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও তালাক হতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ায় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় বেশি বয়সী বর ও দ্বিজবরের কাছেও বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কেননা মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। মেয়েদের জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, জবরদস্তি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ইজ্জত-সম্মান রক্ষার স্বার্থে তারা কিছুমাত্র সুযোগ পেলেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে স্বস্তি লাভ করে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত জুন মাসে প্রকাশ করা জরিপের ফল অনুযায়ী দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে ১.৪ শতাংশ, যা আগে ছিল ০.৭ শতাংশ। আশ্চার্যর বিষয় হলো যে ঢাকায় গড়ে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে একটি করে তালাকের ঘটনা ঘটছে। আর তালাকের দিক দিয়ে পুরুষকে পেছনে ফেলে মেয়েরা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলছে। দুঃখের বিষয় হলো যে, এখন কোন ঠুনকো বিষয় নিয়েও তালাক হয়। যাহোক বর্তমানে তালাক হওয়ার পেছনে উল্লেখ্যযোগ্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারন হলো পরকীয়া; মাদকাশক্ত; মোবাইল (ফেসবুক; ইউটিউব; টিকটক) প্রতিবেশি দেশের নেতিবাচক টিভি সিরিয়াল; বিদেশে অধিক সময় স্বামীর প্রবাসী জীবন; একে অন্যের সময় না দেয়া; চাকুরী বা অন্য কাজে জড়িত; নির্যাতন; যৌতুক; মানসিক পীড়ন; বেপরোয়া জীবন; বদমেজাজ; সংসারের প্রতি উদাসিনতা; পুরুষত্বহীনতা; অবাধ্য হওয়া; শারীরিক চাহিদায় অপূর্ণতা; সন্তান না হওয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাছাড়া আধুনিকতার নামে ইদানিং পাশ্চাত্ত সংস্কৃতির আওতায় ডেটিং ও লিভ টুগেদার অনুপ্রবেশ করে পারিবারিক জীবন কাঁপিয়ে তুলছে।
(উ) এই গল্পভিত্তিক প্রবন্ধের শিরোনামে উল্লিখিত ব্যাথাভরা কথাটি (হায়রে তালাকনামা কার দোষে তুই এলি) তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে ফরিদার উক্তি। আর এই বিষয়টি এখন তুলে ধরার জন্য সচেষ্ট হয়েছি।
ষাট দশকের দুঃখ ভরা এই ঘটনা। পাবনা জেলার সাবেক বেড়া থানার অন্তর্গত যমুনার নদীর পাড়ে মধুপুর নামে একটি ছোট জনপদ ছিল। আর এই গ্রামের লোকজন অধিক শিক্ষিত ছিল। অবশ্য এর পেছনে কারণ হলো, এই গ্রামের অদূরেই ছিল হাইস্কুল। তাছাড়া প্রাইমারী স্কুল ও মাদ্রাসা তো ছিলই। প্রায় মেয়েরা ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত পড়তো। তারপর বিয়ে হয়ে যেতো। আর বিয়ের ব্যাপারে বয়সের আদলে নাবালিকা বলে কোন কথা উঠলে তা ধোপে টিকতো না। বলতে গেলে এটিই সেই গ্রামের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন আমি খুব ছোট। কিছুটা হলেও বুঝতে শুরু করেছি। আমাদের পাশের বাড়ীর ফরিদা নামে একটি মেয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর পরেই ঘটা করে বিয়ে হয়ে যায়। আর বিয়ে হয় মধুপুর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে গাজনার বিলের পশ্চিম পার্শ্বে রানীনগর নামে একটি গ্রামের মেট্রিক পাশ ছেলে রেজাউলের সঙ্গে। রেজাউল চাকুরী করতো রেলওয়েতে। তার কর্মস্থল ছিল রাজবাড়ীতে। এদিকে ছেলেটি যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই সুদর্শন। আর ছেলেটি সৌন্দর্যপ্রিয়। কেমন যেন অসুন্দরকে এতটুকু আমল দিতো না।
এবার ফরিদার কথায় আসি। ফরিদার গায়ের রং দুধে আলতা মেশানো। মৃণাল গ্রীবা, বাঁশির মতো নাক এবং এক হারা গড়ন। আর সবে যৌবনের সব রকম বৈশিষ্ট্য ফুটতে শুরু করেছে বলে যে কোন যুবা পুরুষ একবার তাকালে, দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে থাকতে পারতো না। মোটের উপর, ফরিদা যেন স্বর্গের অপসরা বা হৃদয়কাড়া বাড়ন্ত রুপসী বললে এতটুকু অতুক্তি হবে না।
কালের পরিক্রমায় পাঁচ বছর চলে যায়। ফরিদা ও রেজাউলের সংসার সব রকম সুখের আমেজে বেশ ভালই চলছিল। এর মধ্যে ফরিদা খেয়াল করে যে তার মুখমণ্ডলের বাম দিকে কি রকম যেন সাদা দেখা যায়। সে ঐ সাদা স্পটটি উঠানোর জন্য ঘষতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না বরং আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই সকালে আয়নার কাছে দাড়িয়ে পরখ করে, এর বাড়ন্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বড় চিন্তায় পরে যায় ফরিদা। এর মধ্যে সাত দিন চলে যায়। দেখতে পায় যে উক্ত সাদা তো বেড়েই চলেছে। তাছাড়া ডান ঠোঁটের কোনায় আবার সাদা স্পট দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৮ দিন চলে যায় এবং স্থানীয় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বাবুকে দেখিয়ে কোন লাভ হয় না। তখন ফরিদা পত্র মারফত রেজাউলকে বিষয় জানালে, সে বাড়ীতে আসে এবং তাকে রাজবাড়ীতে নিয়ে যেয়ে এমবিবিএস ডাক্তারকে দেখালে, ডাক্তার বলে যে এটি কঠিন শ্বেতী রোগ বা ধবল কুষ্ঠ, যা সহজে ভাল হবার নয়। একথা শোনে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। ফরিদা লক্ষ্য করে যে রেজাউল আগের মতো তার আর তেমন আদর করে না। কেমন যেন উদাসী হয়ে বসে থাকে। এর মধ্যে রেজাউল কয়েকদিন পরে ফরিদাকে তার বাপের বাড়ী মধুপুর রেখে আসে এবং তার হাতে ৮০টি টাকা দেয় এবং বলে যে এদিয়ে পারো তো কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করিও, দেখো ভাল হয় কি না? পাঁচ মাস কেটে যায়। রেজাউল আগের মতো ফরিদার সঙ্গে যোগাযোগ করে না এবং কোন পত্রও দেয় না।
চৈত্র মাসের তীব্র দাহ। আম গাছে গুটি হতে শুরু করছে। সদূরে কোকিল করুন সুরে ডাকছে। সেই সময় পোষ্ট পিয়ন এসে ফরিদাদের বাড়ীতে একটি খাম দিয়ে যায়। তখন ওদের বাড়ীতে কেউ ছিল না বলে সে নিজেই খামটি খুলে দেখে তো হতবাক এবং হাত-পা কাঁপতে থাকে। চোখে-মনে যেন জোয়ারের জল বইতে থাকে। শুধু বলে “হায়রে তালাকনামা কার দোষে তুই এলি”। আর এ কথা বলেই অজ্ঞান হয়ে যায়। যখন চোখ খুলে, দেখে চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। তার মাথায় পানি ঢালছে। আর সেই কাগজটি বাবা হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠানের এক পাশে বসে আছেন। তখন আমি গ্রাম্য হাইস্কুলে পড়লেও ভাল স্কুলে পড়ার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে ফরিদপুর জেলা স্কুল ভর্তি হই এবং সেখানেই থাকি। বেশ কয়েকমাস পরে লোকমুখে শুনি যে দুঃখ, ব্যাথা ও ক্ষোভে ফরিদা আত্মহত্যা করেছে।
পরিশেষে এই বলে শেষ করছি যে, তালাকের পক্ষে যতই যুক্তি তর্ক দেখাই না কেন। তালাক কোন সময় গ্রহণযোগ্য ও শুভ নয়, যা ফরিদা জীবন দিয়ে দেখিয়ে চির বিদায় নিয়েছে।

সহায়ক সূত্রাদি-
০১। উইকিপিডিয়া।
০২। ঙহষরহব ছঁধৎধ
০৩। দৈনিক প্রথম আলো ১৪-০৪-২০১১ইং
০৪। বিবিসি নিউজ বাংলা ২৩-০৮-২০১৭ইং
০৫। দৈনিক কালেরকন্ঠ ০৫-১২-২০১৭ইং
০৬। দৈনিক যুগান্তর ২৮-১২-২০১৭ ও ২৩-০২-২০২১ইং
০৭। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদ্ভুত দেশের পরিস্থিতি।
০৮। লেখকের দেশি-বিদেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা।
০৯। ইত্যাদি।
বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর