১৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের মধ্যে সহনশীলতা দিবসের রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। সহনশীলতা হলো এক ধরনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তা অন্য মানুষের অবাধ অধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। সমাজে নানামুখী অসংগতির কারণে মানুষ সহনশীল থাকতে পারছে না। মূল্যবোধের অভাবেও মানুষ অধৈর্য হয়ে নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়মে লিপ্ত হচ্ছে। এর থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণে বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ পর্যায়ে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কায় ইউনেসকো ‘সহনশীলতা’ দিবস উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক প্রস্তাবে বিভিন্ন দেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়। লক্ষ্য ছিল শিক্ষা, প্রচারসহ বিভিন্ন উপায়ে সহনশীলতার নানা দিক সবার কাছে তুলে ধরা। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ১৬ নভেম্বর ইউনেসকোর ২৮তম অধিবেশনে ‘সহনশীলতার মৌলিক নীতি ঘোষণা’ গৃহীত এবং প্রতিবছরের ১৬ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেসকো ঘোষিত এই আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হচ্ছে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ভেতর সহনশীলতা শিক্ষার মাধ্যমে পৃথিবীর সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের সুষম ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন নিশ্চিত করা।
ধর্মে ধর্মে বিভেদের পরিবর্তে সম্প্রীতি ও শোষণমুক্ত সুষম সমাজ; অসত্য, অমঙ্গল ও অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মঙ্গল কামনায় উজ্জীবিত হতে হবে। একত্রে গাইতে হবে জীবনের জয়গান, মতামত ব্যক্ত করতে হবে সাম্প্রদায়িক হানাহানিমুক্ত সুন্দর সমাজ সৃজনের পক্ষে। দেশে দেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার জন্ম হয়েছে, তা থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণ জরুরি। উগ্রবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করতে হলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য তথা সহনশীলতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। এশিয়ার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার দুই বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারবার। এর পশ্চাতে আছে কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ সচেতন মানুষকে ব্যথিত করে। প্রতিটি ধর্মের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেন। আর এর জন্য দরকার সহনশীল আচরণ। এই সহনশীলতার অর্থ ধৈর্য, সহ্য, সহিষ্ণুতা, সহনীয়তা, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতেও বলা হয়েছে ধৈর্য বা সহনশীলতা প্রদর্শন করতে এবং সৃষ্টিকর্তার সাহায্য চাইতে। যাঁরা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেন তাঁরাই মহান। প্রকৃতপক্ষে মানবধর্মের কথার মধ্যেই আছে সহনশীলতার মৌল ভিত্তি। মানবতা, বহুমাত্রিক ঐতিহ্য-পরম্পরা, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও সাম্যচিন্তা আমাদের এশিয়ার সমাজব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা। অসহিষ্ণু পৃথিবীর ধর্মীয় মৌলবাদিতা দূর করার জন্য মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। আর এর জন্যই দরকার বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে সহনশীলতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা।
সহনশীলতা বা পরমতসহিষ্ণুতা সব ধর্মের আহ্বান হলেও, একদল মানুষ সব সময়ই এর বিপক্ষে আছেন। যাঁরা প্রচলিত ধর্ম পালন করেন, তাঁরাও এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন—এমন কথা বলা যাবে না। যাঁরা প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করেন না বলে আত্মম্ভরী ঘোষণা দেন, তাঁরাও এ ক্ষেত্রে শান্তি ও মৈত্রীর কোনো বাতাবরণ নির্মাণ করতে সক্ষম হননি। ফলে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ সর্বদা লেগেই আছে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা এ সুযোগটাই গভীরভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগিয়ে সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব ও বিরোধটাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজের এই অপপ্রবণতা তথা অপশক্তির বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগ্রত করার জন্য সহনশীলতার অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন। ভারতবর্ষ তথা বাঙালি সমাজে একই সঙ্গে কীর্তন, কথকতা, যাত্রাগান, বাউল, সুফি, দরবেশ, খ্রিস্টান সাধু-সন্ন্যাসীর জীবনাচার—সবই বিরাজমান। এ জন্য এখানে ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর বড় নয়, বড় করে তুলতে হবে মনুষ্যত্ববোধ। বিভিন্ন ধর্মের মূল নির্যাস থেকে আমরা জেনেছি প্রচলিত ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে মানবধর্ম বড়। পরমত বা অন্য ধর্মকে সম্মান জানান, সংস্কারমুক্তি ও প্রচলন-প্রথার বাইরে গিয়ে জীবনযাপন ও মানবমুক্তির বাণী গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দিন-রাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে লোভীর ভেদজ্ঞান সৃষ্টির প্রয়াস—এসব দূর করতে হবে। মানুষের ধর্মকে বড় করে দেখতে হবে। মানুষের কল্যাণ, সমাজের মঙ্গল চিন্তা হবে মুখ্য। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সব মানুষের কল্যাণ কামনা আমাদের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত। ধর্মের নামে বিশ্বজুড়ে সহিংসতার অবসানকল্পে মানবতার ওপর জোর দিতে হবে। আর ধর্মীয় জীবনে বিশ্বাসীদের মানবিক বিকাশে সহনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। দায়বদ্ধতা, সাহস ও উদারতা দিয়ে বাঙালি সমাজে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব। ধর্মের ভিন্নতা ঈশ্বরেরই দান এবং সেই পরিচয় সবাই মেনে নিয়েই বেঁচে থাকে। ভিন্নতার মাঝে ঐক্যের সুর বাজে প্রাণে। হিন্দু ধর্মের মৌল ভিত্তিতে ক্রিয়াশীল আছে সহনশীলতার বাণী; কবির-নানক-বুদ্ধের দর্শনেও আছে মানবমৈত্রীর কথা। পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মও তো মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীর কথা বলেছে।
সহনশীলতা একটি সামাজিক মূল্যবোধ। এটি লালন করলে রাষ্ট্রীয় জীবনে হানাহানি বন্ধ করা সম্ভব। ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণ, বিচিত্র বিশ্বাসীদের একত্রে বসতি, সামাজিক সংহতি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্যও সহনশীলতার চর্চা দরকার। বিশ্বে বর্ণ এবং সাংস্কৃতিক, জাতিগত বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করছে অপরাজনীতি—অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে মারাত্মকভাবে। আর এসব অপব্যাধি দূর করার জন্য ‘আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস’ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা প্রয়োজন। তবে আমাদের সমাজে সহনশীলতার ধারণাটি শতাব্দীপরম্পরায় গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। এখানে মনুষ্যত্ববোধ তথা মানবধর্ম অসাম্প্রদায়িক চেতনারও মূল কথা। কারণ এখানে সমাজের প্রত্যেক মানুষের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা প্রতিটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের জীবনাচারের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com