৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, দুপুর ১:২৮
শিরোনাম :
শিরোনাম :
সলিমুল্লাহ খানের ‘‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’’ ।। জগন্নাথে ফেঁসে যাচ্ছে ‘সিসিডিবি’ এনজিও ।। ।।নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলার দ্বিতীয় দিন।। নিউইয়র্কে ৩৪তম আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলার বর্ণাঢ্য উদ্বোধন ।। নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইমেলা : বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা ।। ড. নূরুন নবীর পদত্যাগ এবং মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের নীতিগত অবস্থান বিশ্বসভায় বাংলাদেশ ও বাঙালির জয়গান ইসিটি : ধর্মীয় ঐক্য, সামাজিক উন্নয়ন ও গবেষণার এক অনন্য যাত্রা ।। ইসিটি’তে ‘‘পবিত্র বাইবেল ও আইনের দৃষ্টিতে নির্যাতিতদের করণীয়’’ শীর্ষক আলোচনা সভা ।। ।। অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ রেমিট্যান্স ফেয়ার ২০২৫ ।। বর্ণিল সাজে সেজে উঠেছে ডাইভার্সিটি প্লাজা নববর্ষের অনন্য স্মারক গ্রন্থ
নোটিশ :
Wellcome to our website...

সলিমুল্লাহ খানের ‘‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’’

রিপোর্টার
শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ০১:২৮ অপরাহ্ন

মিল্টন বিশ্বাস।।
জনপ্রিয় চিন্তক, লেখক-গবেষক, অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান রচিত ‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু অনালোকিত ও উপেক্ষিত বিষয়ের বিতর্ক পুনরায় পাঠকের ভাবনার আকাশে রেখাপাত ঘটনারো জন্য প্রণীত। প্রথাগত সাহিত্য-সমালোচনার পথ পরিহার করে লেখক নিজস্ব অনুধ্যানে যুক্তি, মনন ও আবেগের নিবিড়তায় নতুন পাঠ উপস্থাপন করেছেন। সলিমুল্লাহ খান গ্রন্থের শুরুতে সরাসরি দেশভাগের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা, সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও ভাষা–সাম্প্রদায়িকতার অনুল্লেখ্যের সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, কবিতার ভাষার মালিকানা ও সাজেশন সরাসরি সামাজিক বিভাজনে অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে। তার মতে, ‘‘…এই বইয়ে সংগৃহীত লেখাগুলির অন্তর্গত প্রস্তাব অনুসারে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ যে সমস্ত কারণে ঘটিয়াছিল তাহাদের পূর্ণ বিকাশ ১৯২০ সালের দশকেই ঘটে। দুঃখের মধ্যে, এই পরিণতির পিছনে অপার্থিব প্রতিভার অধিকারী কবি-চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কি ছিল তাহা আজ পর্যন্ত যথাযথ বিশ্লেষণ লাভ করে নাই।’’ অর্থাৎ আলোচ্য গ্রন্থে তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাটকীয় সময়কে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন, যেসময় ভাষা, সাহিত্য ও সমাজ-রাজনীতির প্রশ্নে গভীর বিভাজন, বিতর্ক ও উত্তেজনার জন্ম হয়েছিল। মূলত গ্রন্থটি প্রধানত বিশ শতকের চল্লিশ দশক অবধি বাংলার সাহিত্য-রাজনীতি ও ভাষাচেতনার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এর প্রতিপাদ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম, এবং তাদের মাধ্যমে জাতিশাসন, সাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষা ও শব্দ ব্যবহারের তর্ক-বিতর্ক।
‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটির সূচিপত্র সজ্জিত হয়েছে-‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়’, ‘ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা: রবীন্দ্রনাথের সাধনা’, ‘নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘জাতির নামে বজ্জাতি’ – এই চারটি প্রবন্ধে। মাত্র আশি পৃষ্ঠায় সলিমুল্লাহ খান কেবল সাহিত্য-ইতিহাস নয়, বরং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ঘিরে জাতি-সঙ্কট, সাম্প্রদায়িক মানস, আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, শ্রেণি-চেতনা, ভাষা ও সংস্কৃতি রাজনীতির প্রশ্নে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও সমকালীন বিশ্লেষণসমূহ উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের ভাষা-রাজনীতি, ‘জাতীয় কবি’–‘জাতীয়তা’ বিতর্ক কিংবা সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে একান্ত জরুরি রেফারেন্স হিসেবে এ বইটি পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে নিঃসন্দেহে। এছাড়া ‘‘সংবর্ধনা’’ অংশে ‘কবির অভিভাষণ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ।। কাজী নজরুল ইসলাম’, ‘বঙ্গ-সাহিত্যে খুনের মামলা।। বীরবল’, ‘আমার কৈফিয়ৎ।। কাজী নজরুল ইসলাম’- অবশ্যই লেখকের উত্থিত বক্তব্যের সমর্থনে সংযোজিত হয়েছে। ‘রচনা পরিচয়’ ও ‘নির্দেশিকা’টিও আলোচ্য গ্রন্থের অপরিহার্য অংশ। সূচিপত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝতে পারা যায় গ্রন্থটি গবেষক, ছাত্র-শিক্ষক, মেধাবী পাঠক- সকলের পাঠ্য; বিশেষত সমকালীন বাংলা চেতনার পরিচয়-সংকট, সাম্প্রদায়িকতা, ভাষা-শিল্প ও ইতিহাস অন্বেষণের অনন্য দলিল হিসেবে সতুন চিন্তার খোরাক দিবে।
গ্রন্থটির শুরুতেই ‘মাৎস্যন্যায়’ ধারণায় শক্তিশালী সর্বদাই দুর্বলদের গ্রাস করে এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অরাজকতা ঠিক কোথা থেকে সমাজে অনুপ্রবেশ করে-তার অনুসন্ধানী ঘটনাক্রম লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পূর্বাভাস এবং সাহিত্যচর্চার রাজনৈতিক রূপান্তর চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে, বিশেষত দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা ও ভাষা বিতর্কের ক্ষেত্রে মাৎস্যন্যায়ের অর্থ ও বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। সলিমুল্লাহ খান সামাজিক অরাজকতা, ভাষার ওপর আধিপত্য ও ‘তথাকথিত’ শুদ্ধতা সংক্রান্ত নির্যাতন-সবকিছুকে মাৎস্যন্যায়ের(strong eats the weak) রূপক দিয়ে অবলোকন করেছেন এভাবে-‘সমাজে যখন অরাজকতা বিরাজ করে, … তখন বলবান লোকেরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকদের সর্বস্ব বলপূর্বক দখল করে নেয়…যদি এরূপ উৎপীড়ন, অত্যাচার, অবিচার চলতে থাকলে তাকে বলা হয় ‘‘মাৎস্যন্যায়’’। … ১৯৪৭ সালের দেশভাগের, … ১৯২০ দশকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নতুন চেহারা ও সাহিত্যিক অঙ্গনে শব্দ, ভাষা, অভিব্যক্তির অধিকার প্রসঙ্গেও তো এই মাৎস্যন্যায় কাজ করেছে।’ ভাষা, সাহিত্য, জাতীয়তা—এসব ক্ষেত্রেই কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ, কখনো এলিট, কখনো কলোনিয়াল মানসিকতা আচরণ করে বড় মাছের মতো। সাম্প্রদায়িকতা আর ভাষার রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে এই স্বার্থ-আগ্রাসী প্রবণতাকেই লেখক সাহিত্যের ‘মাৎস্যন্যায়’ বলেছেন।
এই গ্রন্থের একটি মূল আকর্ষণ ‘রক্ত বনাম খুন’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিতর্ক এবং তা নিয়ে প্রমথ চৌধুরীসহ সমসাময়িক সাহিত্যিকদের আলোচনা-প্রতিবাদ। রবীন্দ্রনাথ, বিশেষত প্রেসিডেন্সি কলেজে দেওয়া প্রবন্ধে, সমকালীন কবিতায় ‘খুন’ শব্দের (নজরুলের ব্যবহৃত) প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেন। নজরুল তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেন এবং ভাষা ও অভিব্যক্তির অধিকারে শেখানোর প্রবণতার সমালোচনা করেন। এই বিতর্কের মধ্যে দিয়ে লেখক সলিমুল্লাহ খান দেখান, কীভাবে ভাষা-শব্দের নির্বাচন একটি সম্প্রদায়গত মনস্তত্ত্ব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘রবীন্দ্র-পরিষদ’–এ দেওয়া বক্তৃতায় আধুনিক কবিদের(আসলে নজরুলের) কবিতায় ‘রক্ত’-এর বদলে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তোলেন। তিনি বলেন, ‘রক্ত’ শব্দেই কবিতার রঙ আসে, কাজেই ‘খুন’ ব্যবহার শুধুই চমক বা তাক লাগানোর আয়োজন। নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী ও অন্যান্য কবিতায় ‘খুন’ শব্দের প্রয়োগ প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, নতুন শব্দ/বিদেশি উচ্চারণ(আরবি-ফারসি) কি কবিতার শুদ্ধতাকে নষ্ট করে? নজরুল তার ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ এবং ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এ রবীন্দ্রনাথের এই আপত্তিকে ‘ভাষার সাম্প্রদায়িকতা’ বলে চিহ্নিত করেন, তাঁর বক্তব্য: ‘বাংলা কবিতার ভাষা শুধুই হিন্দু অভিজাতদের নয়, বরং মুসলিম–জনজীবন, তাদের অভিব্যক্তি, শব্দভাণ্ডারও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ’। নজরুল যুক্তি দেন, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ কবিও বহু বিদেশি শব্দ প্রয়োগ করেছেন- তাতে কোনও চ্যুতি হয়নি শিল্পের। উপরন্তু, ‘খুন’ আর ‘রক্ত’–উভয় শব্দের বাংলা অভিধানে স্থান হয়েছে, কবিতার প্রয়োজনেই তাদের উপস্থিতি। সলিমুল্লাহ খান এই বিতর্ক উপস্থাপন করে বলেছেন-ভাষার শুদ্ধতা কে নির্ধারণ করবে? কারণ সাহিত্যিক আধিপত্যের প্রশ্নে মুসলিম/হিন্দু মাত্রই সংবেদনশীল। তাছাড়া ভাষার চলমান ঐতিহাসিক বিবর্তন তো রয়েছেই। সলিমুল্লাহ খান বলেছেন-‘যারা ভাষায় আধিপত্য চায়, তারা আসলে শিল্পের চেয়ে অধিক রাজনীতিকে মানে’।
এই বিতর্ক সূত্রে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ভাষার রাজনীতি’ প্রসঙ্গে লেখক উদ্দিষ্ট বিষয়কে উন্মোচনের জন্য দেশ-বিদেশের তাত্ত্বিকদের রেফারেন্সে তার বক্তব্য স্পষ্ট করেছেন। গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে, ভাষা-শিক্ষার ওপর ধারাবাহিকভাবে কীভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন এবং আধিপত্যের রাজনীতি খেলা করেছে। লেখক মনে করেন-‘ভাষা-শিক্ষা’র প্রশ্নটি নিছক ভাষা বা সাহিত্য-রুচির বিষয় নয়; বরং এখানেই রাজনৈতিক আধিপত্য এবং জাতিগত বিভাজনের মুখ্য চক্র সক্রিয়। বিশেষত, রবীন্দ্রনাথের ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রসঙ্গে অবস্থানকে লেখক কঠোর নজরে দেখেছেন, অতঃপর ঘটনাটিকে বৃহত্তর পরিচয় সংকট ও বাঙালিত্বের সংকটে পরিণত হয়েছে বলে চিহ্নিত করেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন- সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি-সমস্ত উৎস থেকে বাংলায় শব্দ এসেছে; তাই ‘খাঁটি’/‘সংস্কৃতনিষ্ঠ’ বা ‘আরবিয়ানার’ ভাষা দাবির পেছনেও থাকে এক ধরনের শ্রেণি/সম্প্রদায়গত রাজনীতি।
মূলত ‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা ব্রিটিশরাজ, অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতি-জাতিত্ব ও দেশভাগের সূচনা সম্পর্কে পাঠক নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ খুঁজে পাবেন। সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা সাহিত্যের সামাজিক নেতৃত্ব রয়ে গেলেও, নজরুল সেখানে নতুনের (আধুনিকতার) বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হন, বিশেষত বিদ্রোহ, ধ্রুবমানবিকতা ও সমন্বয়ের কণ্ঠ হিসেবে। নজরুল ও তাঁর সাহিত্য সাম্প্রদায়িক গণ্ডিভেদের ঊর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী কালে তাঁকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের খাঁচায় পুরে ফেলার রাষ্ট্রীয় অভিমত নিয়ে গভীর সমালোচনা করেছেন লেখক। উল্লেখ্য, বঙ্গসাহিত্যে আধুনিকতার ধারা আবাহনে রবীন্দ্রনাথের অদ্বিতীয়তা, সেই সঙ্গে নতুন কাব্য–বিদ্রোহী কণ্ঠকে ধারণ করার অক্ষমতা নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক বিষয়ে আলোচনায় উপস্থাপিত হয়েছে- রবীন্দ্রনাথ—চিরন্তনের সাধনায় স্থিত, শুদ্ধ-রুচি ও রসের ক্লাসিক্যাল বিধানকে ধারণ করেছেন। নজরুল–বিপরীতে দাঁড়িয়ে জনজীবনের ভাষা, দ্রোহ-আবেগ ও নতুন শব্দবলয়কে কবিতায় এনেছেন; এই কারণে তিনি বিদ্রোহী, এবং রবীন্দ্রনাথপন্থীদের দ্বারা উপেক্ষিত বা আক্রমিত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত সলিমুল্লাহ খান নজরুলের কবিতা, ভাষা, শব্দপ্রয়োগ এবং ‘বিদ্রোহ’-ব্যাখ্যায় আজকের দৃষ্টিসমেত আধুনিকতার স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন। পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথের ‘চিরন্তন’ ধারণার মধ্যে গম্ভীরতা, ভাষা-রুচিতে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা, শব্দপ্রয়োগে একচ্ছত্র আধিপত্য- এসবকেই সমালোচনার চোখে দেখেছেন। সলিমুল্লাহ খান দেখিয়েছেন, নজরুলের জাতীয় কবি পরিচয়ের ঢাক পেটা(সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক)-এটি বৃহত্তর মানবতাবাদী নজরুলের প্রকৃত আত্মার সঙ্গে কতটা সাংঘর্ষিক। কীভাবে সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে নজরুল ‘জাতীয়তা’ প্রশ্নে এক চিরস্থায়ী বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন-তিনি কার? কোন জাতির কবি? একক না সর্বজনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ?-এসবই আলোচ্য গ্রন্থে যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধতা ও চিরন্তনবোধ জারি রাখার ইচ্ছা এবং নজরুলের যুগভাষা, বিদ্রোহ ও আধুনিকতা প্রতিষ্ঠার প্রাণচেষ্টা-এই দুই মেরু ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাসে আজও বিপুল অর্থবহন করে। সলিমুল্লাহ খানের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- এসব সাহিত্যিক বিতর্ক শুধু ভাষা–রুচি বা শব্দের অপছন্দ নয়, বরং ভাষা-রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক আধিপত্যের বহুমাত্রিকতার বিতর্ক।
বস্তুত সাহিত্য ও ভাষায় আধিপত্যের দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িকতা বনাম সার্বজনীনতা, আধুনিকতার সংজ্ঞা, ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে সাহিত্য-সমাজের ভূমিকা এবং বাঙালি জাতিসত্তার বর্ণবিভাজন ও অন্তর্লীন সংশয়ে আলো ফেলেছেন সলিমুল্লাহ খান। সাহিত্যে রুচির দখলকে কেন্দ্র করে সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে ভাষা ও সাহিত্যিক অধিকারের প্রশ্নে হামলা করতে পারে এবং ইতিহাসের প্রবাহে তার পরিণাম কী হতে পারে—বইটিতে তা অনুপুঙ্খতার সঙ্গে উত্থাপিত হয়েছে। উপরন্তু নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ—দুজনের বিপরীত অবস্থান ও তাদের পক্ষ-বিপক্ষে সাহিত্যসমাজের প্রতিক্রিয়া বোঝার মধ্য দিয়েই উদ্ভাবিত হয়েছে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের গতিশীল, জটিল ও দ্বান্দ্বিক ধারা।
‘ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটি গবেষণাধর্মী, তথ্য সমৃদ্ধ, টীকা-উদ্ধৃতি, বিতর্ক-বিশ্লেষণ ও অন্তর্দর্শনমূলক ভাষাবিন্যাসে রচিত। সলিমুল্লাহ খানের প্রাঞ্জল অথচ নিবিড় ভাষা, বিনয়ী কিন্তু দরাজ যুক্তি, উচ্চারণে দৃঢ় স্বর এবং প্রচুর ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক রেফারেন্স বইটির পাঠ ও সংলাপ দুটোই সমৃদ্ধ করেছে। বইয়ের বিষয়-বিন্যাস, টীকা, রেফারেন্স সেই সাথে তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য আলাদা প্রশংসা প্রাপ্য। সাবলীল ও নিজস্ব ভাষিকভঙ্গি, তথ্য ও যুক্তি এবং গভীর চিন্তার মিশেলে এই গ্রন্থ বাংলা সাহিত্য-সমালোচনা ও গবেষণার নতুন দৃষ্টান্ত। (ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় ভাষা-শিক্ষার সাম্প্রদায়িকতা (জাতীয় সাহিত্য ৩), সলিমুল্লাহ খান, মধুপোক, ২০১৯, ঢাকা)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর