সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর : অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও শিক্ষা’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক আলোচনায় উঠে এসেছে, শিক্ষিত তরুণরা শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে যুক্ত হতে চাচ্ছে না। তারা খুঁজছে সেবা খাতের পদস্থ চাকরি।
উপরোক্ত পর্যবেক্ষণটি যিনি তুলে ধরেছেন, তিনি শিল্প খাতের একজন দক্ষ ও খ্যাতিমান উদ্যোক্তা এবং স্বভাবতই ধারণা করা যায়, উল্লিখিত অভিমত তিনি তার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ এটি কোনো অনুমানভিত্তিক কথার কথা নয়; বরং যে কোনো গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফলের মতোই বা কতিপয় বিবেচনায় তার চেয়েও অধিক মাত্রায় নির্ভরযোগ্য। অতএব বলা যেতে পারে, এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কর্মবাজারের একটি অংশের সর্বশেষ প্রবণতা ও পরিস্থিতিরই একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর গত ৫০ বছরে দেশের শিক্ষিত তরুণদের মানসিক গতিবিধি কোনদিকে ধাবিত হয়েছে এবং তাদের বর্তমান মনোকাঠামোটিই বা কিরূপ, সে বিষয়েও একটি ধারণা পাওয়া গেল। তৃতীয়ত, বোঝা গেল এ পরিস্থিতি শিল্প ও কৃষি খাতকে একদিকে যেমন দক্ষ লোকবলের অভাবজনিত সমস্যায় ফেলছে, অন্যদিকে তেমনি তা শিক্ষিত তরুণের পেশা ও জীবিকার জায়গাটিকেও অতৃপ্তি ও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত যা জন্ম দিচ্ছে নানা মাত্রিক সামাজিক অস্থিরতারও।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষিত তরুণরা শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে জড়িত হতে চাচ্ছে না কেন? এসব পেশাকে তারা যথেষ্ট মর্যাদাকর মনে করে না বলে, নাকি এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো কারণ আছে? জবাবে বলব, বাজার অর্থনীতির চলমান ব্যবস্থার আওতায় একটি পেশার মর্যাদা অনেকটাই নির্ভর করে সে পেশার আয়-উপার্জনের পরিমাণ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের ওপর। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বাদাম ব্যবসা করতেন বলে নিশ্চয়ই কেউ তাকে বাংলাদেশের রাস্তায় ফেরি করা বাদাম বিক্রেতার সঙ্গে তুলনা করে তার মর্যাদার স্তর নির্ধারণ করে না (বাদাম বিক্রেতা ফেরিওয়ালার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই এটি বলা)। গোয়ালার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আড়ং, প্রাণ বা ফ্রেশ যখন দুধ বিক্রির সফল উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটায়, তখন নিশ্চয়ই কেউ এটিকে অসম্মানজনক কাজ বলে গণ্য করে না, এমনকি কর্মপ্রার্থী শিক্ষিত তরুণও নয়। বরং যে শিক্ষিত তরুণ কৃষিতে যুক্ত হতে চায় না, সে-ই কৃষিভিত্তিক ওইসব কারখানার করণিক, খাজাঞ্চি বা বিক্রয়কর্মী হওয়ার জন্য প্রাণপাত করে।
একইভাবে অ্যাপেক্স বা বাটা যখন একজন মুচির কাজকেই প্রযুক্তি আর মানবিক দক্ষতার মিশেলে নান্দনিক শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের পাদুকার চাহিদা মেটায়, তখন ওই শিক্ষিত তরুণরা নিশ্চয়ই ওটিকে মুচির কাজ বলে এড়িয়ে যায় না। বরং বাটা বা অ্যাপেক্সের মতো আধুনিক মুচি কারখানায় কাজ পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে, তাদের মানবসম্পদ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মী বা হিসাব শাখায় কাজ পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত তরুণের আগ্রহ গতানুগতিক ধারার করণিক শ্রেণির চাকরির প্রতি এবং বিশেষায়িত ধারার কাজকে বস্তুতই তারা এড়িয়ে চলে।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই-মর্যাদার প্রশ্নে নয়, বরং পর্যাপ্ত কারিগরি দক্ষতার অভাব, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ঘাটতি এবং সৃজনশীল চিন্তার সামর্থ্য না থাকার কারণেই মূলত তারা শিল্পে বা কৃষিতে যুক্ত হতে চায় না। আর এর আরও পেছনের মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষার মানে ঘাটতি। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কিছুতেই এমনসব শিক্ষিত তরুণ তৈরি করতে পারছে না, যারা বিশেষায়িত দক্ষতা নিয়ে শিল্পে কাজ করবে; কিংবা চিন্তার বিকাশকে তারা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারছে না যে, সে তার সৃজনশীল চিন্তাভাবনা দিয়ে কৃষিতে উদ্ভাবনামূলক নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হবে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে শিল্প বা কৃষি দুটিরই প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে চলতে চায়।
অন্যদিকে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় বাংলাদেশের মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের পর থেকেই এ দেশের তরুণদের মধ্যে এক ধরনের ভোগবাদী অস্থিরতা লক্ষ করা যেতে থাকে, যে অস্থিরতার আওতায় তাদের মধ্যে সবকিছু খুব সহজে ও দ্রুত পাওয়ার এক ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়। বস্তুত সবকিছু খুব সহজে ও দ্রুত পাওয়ার ওই আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন হচ্ছে শিল্পে বা কৃষিতে যুক্ত হতে না চাওয়ার প্রবণতা। অবশ্য এটি না চাইলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কী চায় বা কী তাদের পেশাগত (ক্যারিয়ার) লক্ষ্য, সেটিও তাদের নিজেদের (অধিকাংশের) কাছে স্পষ্ট নয় বা মর্যাদাবান পেশা গড়ার জন্য সেটি যে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, সে বোধও তাদের অধিকাংশের মধ্যে নেই। তাদের চিন্তার ভরকেন্দ্রে এখন একটিই তাগিদ-যে কোনো উপায়েই হোক, রাতারাতি শীর্ষে ওঠা চাই।
শিল্প খাতে কী ধরনের বিশেষায়িত দক্ষতাসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন কিংবা এ খাতে জনবলের সর্বশেষ বাজার চাহিদা কিরূপ, সেটিও আমাদের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জানা নেই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে ধাঁচের শিক্ষিত তরুণ তৈরি করছে, ইচ্ছা থাকলেও তাদের পক্ষে ওই জ্ঞান দিয়ে শিল্পে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। অতএব বলা যায়, শিক্ষিত তরুণ যে শিল্পে কাজ করতে চায় না, সেটি শুধু তার অনিচ্ছার কারণেই ঘটছে না; এটি একইসঙ্গে তার দক্ষতার ঘাটতির কারণেও ঘটছে। ফলে শিক্ষিত তরুণকে শিল্পের উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে চাইলে শুধু তরুণের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করলেই হবে না, একইসঙ্গে তাকে শিল্পের উপযোগী করে গড়ে তোলার ব্যাপারেও সচেষ্ট হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নশিপ কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তি মাত্রই জানেন, শ্রেণিকক্ষে অধিত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে হাতে-কলমে প্রয়োগ করে ছাত্রাবস্থায় নিজের প্রায়োগিক দক্ষতা বৃদ্ধির একটি উত্তম উপায় হচ্ছে ইন্টার্নশিপ। ইন্টার্নশিপ একজন শিক্ষার্থীকে কর্মপ্রার্থী হিসাবে নিজের উপযুক্ততা প্রমাণে যেমন সহায়তা করে, তেমনি কর্মরত অবস্থায় নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতেও তা ভীষণভাবে কাজে লাগে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ইন্টার্নশিপের এ গুরুত্বটি বুঝতে চায় না। তারা এটিকে গ্রহণ করে নিছক সনদ পাওয়ার অতি মামুলি শর্ত হিসাবে। এ প্রসঙ্গে অভিজ্ঞতা থেকে বলি, রীতি অনুযায়ী ইন্টার্নশিপের জন্য শিক্ষার্থীকে বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ার পরও তাদের অনেকের কাছ থেকে এ আবদার শুনতে হয়েছে যে, তাকে তার বাসস্থানের কাছাকাছি কোনো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করা যায় কিনা, সেটি যে ধরনের প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন। আবার অনেকের কাছ থেকে এমন অনুরোধও পাওয়া গেছে, ইন্টার্নশিপের জন্য তাকে এরূপ কোনো প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করলে ভালো হয় যেখানে পরিশ্রম কম।
উপরোক্ত পরিস্থিতি এটাই ব্যাখ্যা করে যে, তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ইন্টার্নশিপের ব্যাপারে মোটেও সিরিয়াস নয় বা কী ধরনের, কোন মানের প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করা উচিত, সে বিষয়েও তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। অর্থাৎ পেশা পরিকল্পনার ব্যাপারে তারা অনেকটাই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবিহীন। তবে সনদটি কিন্তু তারা দ্রুতই পেতে চায় এবং রাতারাতি একটি চাকরিও চায়, যদিও সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের ব্যাপারে তারা যথেষ্টই উদাসীন। বস্তুত এরাই পরে পেশা বাছাই করতে গিয়ে দক্ষতা-ঘাটতির সহজ সমাধান হিসাবে উৎপাদনবহির্ভূত অনুদ্ভাবনমূলক ও সৃষ্টিশীলতাবিহীন গতানুগতিক পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে পড়ে, যাদের কথা সানেম সেমিনারের ১৩ ডিসেম্বরের আলোচনায় উঠে এসেছে।
অবশ্য অন্ধ নগরমনস্কতাও শিক্ষিত তরুণদের কৃষিতে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছে। তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে অধিকতর কষ্টকর জীবনযাপন করে হলেও শহরেই থাকতে চায়। শহরের প্রতি তাদের এই মোহাবিষ্টতাকে কিছুটা হলেও হ্রাস করতে পারত কারিগরি ধাঁচের শিক্ষা, যা প্রয়োগ করে তারা কৃষিতে সৃষ্টিশীল নতুনত্ব আনতে পারত। তবে অন্ধ নগরমনস্কতার বিদ্যমান এ ধারা কখনোই এতটা প্রবল হতো না, যদি দেশজুড়ে একটি শক্তিশালী স্বনির্ভর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা কার্যকর থাকত।
সব মিলে শিক্ষিত তরুণ কেন শিল্প ও কৃষিতে যুক্ত হতে চায় না, তার বিভিন্ন কারণের মধ্যে ঘুরেফিরে মূল কারণ দাঁড়াচ্ছে-শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতি কোনোভাবেই শিক্ষিত তরুণকে শিল্প ও কৃষিতে কাজ করার উপযোগী দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে গড়ে তুলতে পারছে না। আর সে কারণেই এ শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে ইতোমধ্যে ১০ লাখ বিদেশিকে এখানে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হয়েছে (প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে)। এ অবস্থায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি শিল্পের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী জনবল তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করতে না পারে, তাহলে চলমান ধারার শিক্ষিত তরুণ দিনে দিনে শিল্প ও কৃষিতে কাজ করার আগ্রহই শুধু হারাবে না, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কর্মবাজার বিদেশিদের জন্য আরও অনিবার্য হয়ে উঠবে।
আবু তাহের খান : লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক