© রেজওয়ান আহমেদ
এক শ্যামবর্ণ, টেকো, ঘর্মাক্ত বাবার কাছে ছেলের আবদার – ব্র্যান্ডের লেদার জ্যাকেট চাই, শীত চলে এলো বলে ৷ আগের সোয়েটারটা এখন আর চলে না৷ বাবার ফোন যখন বাজছিলো তখন তিনি সায়েন্সল্যাব ওভারব্রিজের গোড়ায় সিএনজিওয়ালার সাথে দরকষাকষিতে ব্যস্ত ৷ কিছুক্ষণ আগেই ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশের এসিমার্কেটে দরকষাকষি করে এসেছেন ৷ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও এই মার্কেটটা জীবন্ত ছিল ৷ তখন সবে টানাপাখার যুগ বাসি হয়ে ইলেকট্রিক পাখার প্রচলন হয়েছে ৷ কালো গোলাকার সুইচ, কাঠের সুইচ বোর্ডের ওপর ৷ এখনকার মতো প্লাস্টিকের বহুল প্রচলন তখন ছিল না ৷ দেশি পণ্যের বাজার এখন ত চীনের দখলে চলে গেছে ৷ হয়তো ছেলেটার জন্য চায়নিজ মেম খুঁজতে হবে সময় হলে ৷ আর মেয়ে ত কোরিয়ান সিরিয়ালের পাগল ৷ ওরকমই কোনো এক চোখছোট ছোকরার গলায় ঝুলবে ভাবছে হয়তো সদ্যকেনা এলইডি টিভির সামনে বসা মেয়েটা ৷ আর হাবিব সাহেব এসব ভাবছিলেন নূরজাহান মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে পান চিবুতে চিবুতে ৷ এখন অবশ্য তিনি সিএনজিতে বসে আছেন ৷ ব্রয়লার মুরগির খোপে দেশি মোরগ ৷ দরদর করে ঘামছেন ৷ আচ্ছা, সিএনজিতে কি এরা এসি লাগাতে পারবে কোনোদিন ? লাগালে সেটা কতটুকু হবে সাইজে ? ফোর আর সাইজের ফটো যতটুকু, ততটুকু ? মনে হয় ৷
আজকের রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম ৷ মঙ্গলবারে এইদিককার মার্কেটগুলো বন্ধ থাকে ৷ আজ তো মঙ্গলবার না, অমঙ্গলবারও না নিশ্চয়ই ৷ মানুষজনের ভীড়ভাট্টা কম ৷ ভালোই হলো বেশি ঘামলে আবার জ্বর আসবে কাল ৷ অফিস করতে হবে ৷ চারদিনের ছুটি পঞ্চমদিনে নেয়ার বিলাসিতা দেখানোর নীতি হাবিবুর রহমানের না ৷ তার যা বেতন তার দশ কেন? একশগুণ টাকায়ও এই নীতি বিক্রি করবেন না তিনি ৷ সম্মানটা সবার আগে ৷ সমাজে দশজনের সাথে চলতে হয়, তাই নিজের অনেক সাধ আহ্লাদ সচেতনভাবেই একপাশে জমা করে রাখেন ৷ বাকি থাকে স্ত্রীসন্তান ৷ তাদের খুশি রাখতেই জীবন শেষ করতে চান ৷ অদ্ভুত চিড়িয়া ৷
লঞ্চের ডাল চচ্চড়িটা আসলেই অমৃত ৷ এদের জন্য হলেও একবার সুইজারল্যান্ডে যাওয়া দরকার বরিশালবাসীর প্রতিনিধি হয়ে ৷ তাহলে নোবেল প্রাইজের নতুন ক্যাটাগরি খোলার বন্দোবস্ত হয়ে যেত ৷ হাবিব সাহেবের কেন জানি মনে হচ্ছে ওনার কথা ইউরোপবাসীরা ফেলবে না ৷ লঞ্চেচড়া মানুষগুলো আশ্চর্যরকমের কনভিন্সিং পাওয়ারের ব্যাংক ধারণ করে বুকপকেটের আড়ালে ৷
– ছার, দুয়ার খোলেন, লঞ্চ ঘাডে ভেরচে ৷
– আসছি ৷ কী ব্যাপার ?
– নামবেন না ?
– চইল্লা আসছে ?
– হয় ৷
– আমার বোঝাডা এট্টু নামাইয়া দ্যাও ৷ অ্যাত্তোবড় প্যাকেট নিয়া মছিব্বাতে পড়ছি ৷
– আচ্ছা, সমেস্যা নাই ছার ৷ দেতে আছি ৷
(বাসায় পৌঁছে)
– ছেলে কই ?
– দুমকি ৷ সকালের বাসে গেছে ৷ দুপুরে আইসা পড়বে লোকাল বাসে ৷
– আমি অফিসে যাবো ৷ খাবার রেডি করো ৷ মিটিং আছে ৷ দশটার মইধ্যে থাকা লাগবে ৷ গোসল কইরা আসি ৷
– রেস্ট নেবা না ?
– রেস্ট ? লঞ্চে সারারাত রেস্ট নিছি ৷ আর না ৷ টাকাডা আয় কোন জাগা দিয়া ? আমার দুইআত চলে না জানো না ?
– আচ্ছা খাবার দেতে আছি ৷ আও তুমি গোসল সাইরা ৷
হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে হাবিব সাহেবের ৷
– তোমরা খালি কাজের সময়ই ফোন দ্যাও ৷ কী হইছে বলো তাড়াতাড়ি ৷
– তোমারে ব্র্যান্ডের লেদার জ্যাকেট আনতে কইছি ৷ তুমি এডা কী আনছো লোকাল ? তুমি পইরো এডা ৷ আমি আগেরডাই পরমু ৷
– হ্যাঁ ? (মুখের ওপর ফোন রেখে দেয় ছেলেটা) ৷
হাবিব সাহেব কনফারেন্স রুমে ঢুকতে যেয়ে হঠাৎ চৌকাঠে পা আটকে মুখ থুবড়ে পড়েন ৷ সবাই মিটিং ফেলে ছুটে এসে তাকে ধরে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় ৷ এ ব্যর্থতা সবার নয়, তাঁর একার, যা আর কোথাও নেই । ছেলের জেদের কাছে নিজেকে কখনো কখনো শিশুরও শিশু হয়ে যান তিনি । সারাজীবনের এ ব্যর্থতাটা একবাক্যে প্রকাশ করে দেয় অবুঝ ছেলে – আমি আগেরডাই পরমু ৷
ইউরোপবাসীরা কথা শুনবে কী করে ? মধ্যবিত্ত হাবিব সাহেবদের যে মাঝেমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়াটাই নিয়ম ৷
হেলথ এইড থেকে ফোন আসে ছেলেটার কাছে ৷ জরুরি অনেকগুলো নাম্বার ব্যাকআপ করে রেখেছিলেন হাবিব সাহেব ছেলের মোবাইলেই ৷ স্পষ্ট মনে পড়ে ছেলের – সেদিন হোহো করে হেসে বলেছিলো – আব্বা তুমি পারোও ৷ হাসপাতালে কোনোদিন যাওয়া লাগছে আমাগো ? না লাগবে কহনো ? খালি খালি সেটের মেমোরি নষ্ট করতে লাগজো ৷ ধুর !
সেদিনের সেই ধুরের জবাব আজ যেন রিংটোন হয়ে বাজছে ছেলেটার ফোনে৷ অপারেশন থিয়েটারের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে ফোনটা করেছিলেন হাবিব সাহেবের কলিগ ৷
কী এমন কথা হয়েছিলো তখন যে একছুটে ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো লাইন কাটতে না কাটতে ? বাবার টানেই কি তার এমনতরো পরিবর্তন ? অপারেশন থিয়েটারের সামনের জটলাটা ঠিক কী বোঝাতে চাইছে ? অপারেশন টেবিলেই বা কী ঘটেছিলো ? অথবা হাবিব সাহেবের ভাগ্যে ?
আমরা এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনা ৷ তবে আমরা জানি হাবিব সাহেবরা সন্তানের এমন পরিবর্তন না দেখে যেতে পারেন না ৷ অবশেষে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারার অযোগ্য পিতা পৃথিবীতে একটিও নেই ৷
(গল্পকার – শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়)