২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, রাত ১২:৩৯
নোটিশ :
Wellcome to our website...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় চিত্রকল্প

রিপোর্টার
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন

 রেজওয়ান আহমেদ

There are pictures in poems and poems in pictures. – (চীনা প্রবাদ)।

২০২০ সাল চলছে। গত দু’দশকে প্রযুক্তির প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে এ ভূখণ্ডে। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি তারাই বোধকরি ফিল্ম ক্যামেরার সর্বশেষ সাক্ষীদল। এর পরের প্রজন্মের কাউকে যদি বলা হয় একটা ফিল্ম দিয়ে সর্বোচ্চ আটত্রিশটা ছবি তোলা যেত, তারা বিশ্বাস করতে পারবে না সঙ্গত কারণেই। আমার একমাত্র মেয়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে কিছুদিন আগেই। আর বছরপাঁচেক পর তাকে যদি সে ইতিহাস বলি, সে খিলখিল করে হেসে ফেলবে বলেই আমার ধারণা। তার জন্মের কয়েকমিনিট পরেই তার কাঁথাজড়ানো মুখশ্রী আমার সামনে মুচকি হাসি দিল আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোনের পর্দায়। ছবিটা তোলাও হয়েছিল ফোন ক্যামেরায়ই। এখনকার বাচ্চারা জন্ম নিয়েই বাবা-মায়ের অ্যান্ড্রয়েডটিকে খেলনা সামগ্রী বানায়। এদের হাসিখিলখিল মুখ তাই অ্যান্ড্রয়েডের পর্দায়ই শোভা পাওয়া স্বাভাবিক। আমাদেরটা যেমন পেত শক্ত কাগজের ফটোগ্রাফে, লেমিনেট না করলে নষ্ট হয়ে যাবার ভয় থাকত!

এ ত গেল ক্যামেরার ছবির কথা। মনের ভেতরে থাকতে পারে না ছবি? স্থির কিংবা চলমান? আমাদের ধ্বনিসংবেদী প্রত্যঙ্গ – ঠোঁট এবং কান বোধকরি আমাদের কল্পনাশক্তিকে উসকে দেয়। ফলে মনের ভেতর একটা ছবি ভেসে ওঠে – আমরা তা অনুভবও করতে পারি। যে চীনা প্রবাদটা দিয়ে লেখা শুরু করেছি, সেখানে Picture শব্দটি থাকলেও এক্ষেত্রে Image শব্দটি সঙ্গত কারণেই অধিক যুতসই। আমরা দেখি এখন মোবাইল হাতে থাকলেই সকলে ক্লিক-ক্লিক ছবি তুলে ফেলে। তাই বলে কি সবার তোলা ছবি ছবি হয়? সুদক্ষ আলোকচিত্রীমনন খাটিয়ে যেমন একটা ভালো কম্পোজিশনের ছবি তোলা সম্ভব, তেমনি প্রকৃত অর্থেই যারা সুকবি, তাদের লেখায় আমাদের হৃদয়ে উল্লেখিত Image ব্যাপারটা ফুটে ওঠে। একে বাঙলায় ‘চিত্রকল্প’ বলা যেতে পারে। চিত্রকল্প হচ্ছে হৃদয়ের ভাষা। শুধু হৃদয়ের ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বলা ভালো – এটা একটা আন্দোলন। চিত্রকল্প আন্দোলনের ইতিহাস আমাদেরকে ১৯১৪ সালে নিয়ে যায়। এ সময় আমেরিকায় প্রকাশিত হয় Imagist Anthology. তবে এর আগে থেকেই কবিতায় Image তথা চিত্রকল্পের ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবার্ট ফ্রস্টসহ অনেক কবির কবিতায় এরূপ Imaging লক্ষণীয়। বাঙলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় দুর্দান্তভাবে ব্যবহৃত চিত্রকল্প। বলে রাখা ভালো Imaging বলতে Strong Mental Picture নির্দেশিত। আধুনিক কবিতায় Invisible and Abstract অর্থাৎ অদৃশ্য ও বিমূর্ত চিত্রকল্পের হরদম ব্যবহার দেখা যায়। সঙ্গত কারণে আলোচনার আওতা রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ রাখছি।

“হেথা হতে যাও পুরাতন,

হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।

আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি,

বসন্তের বাতাস বয়েছে।…”

এ অংশে পাতাঝরা মৌসুম শীতের শেষে বসন্তের আগমনী শোনানোর আড়ালে রয়েছে নবযৌবনকে স্বাগত জানানোর ইঙ্গিত।

“অধরের কানে যেন অধরের ভাষা,

দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে -…”

কানে-কানে কথা বা কানে-মুখে কথা শব্দবন্ধ দুজনের মধ্যে ফিসফিস আওয়াজে ব্যক্তিগত কথোপকথন বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এ অংশে ব্যাপারটিকে চিত্রকল্পে সাজাতে দুই হৃদয়ের লেনাদেনার সমান্তরালে চুম্বনের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিগত পরিবেশে মানব-মানবীর ওষ্ঠাধরের সংযোগস্থল রচিত হয় চুম্বনেই। হৃদয়সংযোজনও বাকি থাকে না আর।

“… অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি -…”

গ্রামের খোলা প্রান্তরের ধূলোয় আকাশ মিশেছে। আকাশসমান কপাল যদি কারো হয়, তবে তার থেকে ভাগ্যবান বোধকরি কেউ হয় না। বিশ্বসংসারে এত বড়লোক যিনি, তিনি কেন কারো কাছে মাথা নোয়াবেন? চুমু খাবেন পায়ে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটিকে গ্রাম্য মহৎহৃদয়জননীর পায়ে লুটানো সন্তানের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলতে চাচ্ছেন।

“…ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী

আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।…”

মানুষের নিজের পরিচয়ের চেয়ে তার কর্ম এবং কর্মফলই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সোনার তরীতে তাই জীবন ও কর্মেরই জয়জয়কার। শুধু দেহের কোনো পারাপার হয় না।

“… ওমা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে

আমি কী দেখেছি মধুর হাসি!”

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের অংশবিশেষ। একটা লালনগীতির সুর অনুসরণে লেখা দীর্ঘ গীতিকবিতাটির দশ লাইন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত। এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাঙলার পথ প্রান্তর, যাপিত জীবন, ঋতুচক্রসহ সবকিছুর প্রাঞ্জল বর্ণনাত্মক গানটি। এদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অগ্রহায়ণ মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটা কৃষিপ্রধান। নবান্ন উৎসব এবং জাতীয় কৃষি দিবস ১ অগ্রহায়ণ। তাই অগ্রহায়ণে ক্ষেতভরা ফসল হলে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। প্রকারান্তরে হাসে বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত এবং শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন‌।

“ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর –

যা-কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা ব্যাটাই চোর।…”

এ অংশে কৃষ্ণ নামের ততোধিক কৃষ্ণগাত্রবর্ণের এক অসহায় ভৃত্যের ওপর গৃহকর্ত্রীর নিদারুণ মানসিক অত্যাচারের চিত্র মেলে।

জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রাঙ্কণেও পারদর্শী ছিলেন। শুধু পারদর্শী নয়। বিশেষ পারদর্শিতাই ছিল তাঁর। পোর্ট্রেট এঁকেছেন, এঁকেছেন অদ্ভুত সব কাল্পনিক প্রাণীর ছবি। প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে শুরু করে অতিপ্রাকৃত ছবি এমনকি ন্যুডও এঁকেছেন। চিত্রকল্প সৃষ্টির পাশাপাশি আড়াই হাজারের বেশি ছবি এঁকে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যে উচ্চতায় কেবল একজন সব্যসাচী সাহিত্যশিল্পীর পক্ষেই পৌঁছানো সম্ভব।

(উদ্ধৃত লাইনগুলোর উৎসকবিতাসমূহ – পুরাতন, চুম্বন, দুই বিঘা জমি, সোনার তরী এবং পুরাতন ভৃত্য।)

(লেখক – শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ৩য় সেমিস্টার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর