ড. তাপস কুমার বিশ্বাস
বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) বয়ঃসন্ধিকালীন যৌন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার এবং সবার জন্য লিঙ্গসমতা নিয়ে নির্মিত ‘শাহানা কার্টুন’ শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সম্প্রতি মাউশি থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে উদ্যোগটি সময় উপযোগী এবং প্রশংসনীয়। কারণ, বয়ঃসন্ধিকালীন এই সময়ে শিশুদের উক্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা খুব জরুরি। এটাকে জীবন দক্ষতা হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে।
বিশেষ করে, আমাদের দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে বিগত দিনে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ক পাঠের যথার্থ ঘাটতি বিদ্যমান ছিল। খুবই আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি সরকার ঘোষিত নতুন শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্কে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক এ সমস্ত বিষয়াদি প্রাধান্য পাবে এটি নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। তবে বয়ঃসন্ধিকালীন যৌন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার এবং সবার জন্য লিঙ্গসমতা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য শুধুমাত্র ‘শাহানা কার্টুন’ শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমেই সীমিত না রেখে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত পাঠ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়বস্তু নতুন এবং স্পর্শকাতর একটি বিষয়। যেকোনো নতুন এবং স্পর্শকাতর বিষয় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাই কিছু বাড়তি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাসহ সার্বিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে পরিপূর্ণভাবে শিক্ষণ-শিখনে অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আমাদের পারিবারিক জীবনের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, সেখানেও একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই।
আমাদের দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে বিগত দিনে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ক পাঠের যথার্থ ঘাটতি বিদ্যমান ছিল। খুবই আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি সরকার ঘোষিত নতুন শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্কে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে…
বিদ্যালয়সহ নিজের পারিবারিক পরিমণ্ডলেও বয়ঃসন্ধিকালীন সঠিক শিক্ষা থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। যেটি তাদের জীবনে অনিবার্য। সেই শিক্ষাটি সঠিকভাবে না পাওয়ার কারণে তারা অনেক ভুলভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা পরবর্তীতে তার মানসিক বিকাশেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিভাবেই, বিদ্যালয় ও পরিবার সব জায়গাতেই বয়ঃসন্ধিকালীন যৌন ও প্রজনন শিক্ষা সঠিকভাবে না পাওয়ার মূল কারণ সামাজিক কুসংস্কার, খোলামেলাভাবে এগুলো আলোচনা করার পরিবেশ না থাকা এবং এ সকল বিষয়াদি জনসম্মুখে প্রকাশে কিছুটা লজ্জা বোধ।
সামাজিক সংস্কারের কারণে, অভিভাবক যেখানে এগুলো এড়িয়ে যান, সেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নে যে চ্যালেঞ্জ থাকবে তা বলাই বাহুল্য। যেহেতু বাংলাদেশের সমাজে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক খোলামেলা আলোচনা অনেকটা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ একটি বিষয়, তাই এসব বিষয়বস্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান করা হলে সামাজিকভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধা যে আসবে না, সেটিও গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতির সাথেও বিষয়টি মেলানোর সম্ভাবনা ও দেখা দিতে পারে।বিশেষ করে, মাদরাসা পর্যায়ে এগুলোকে আরও বেশি করে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাধ্যমিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠ বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাই এ বিষয়ে সঠিক করণীয় নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। যৌন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ক ধারণা লাভ করা যেহেতু জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়, সুতরাং, এ বিষয়টি শিশুদের সঠিকভাবে শেখানোর জন্য পরিবার এবং বিদ্যালয়ই হচ্ছে সবচেয়ে উপযোগী স্থান।
বিদ্যালয়ে এ বিষয় শেখানোর জন্য পরিবার ও সমাজকে সম্পৃক্ত করাও প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এছাড়াও শিক্ষক ও অভিভাবকদের উক্ত বিষয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তা না হলে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
সমাজের সর্বস্তরের জনগণসহ শিক্ষক এবং অভিভাবক যদি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠের বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারেন, তাহলে তা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ অনেকাংশেই লোপ পাবে।
শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত মিটিং-এর ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সংকোচ আছে সেটি সহজেই দূরীভূত হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাজিকভাবে প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা করা।
যত বেশি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠের বিষয়ে প্রচার করা যাবে তত তাড়াতাড়ি বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সফলভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সর্বপ্রথমে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের ধ্যান-ধারণা ও মানসিকতা যদি আধুনিক না হয় তবে তা বাস্তবায়ন দুরূহ হবে। কারণ শিক্ষকরা শুধু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকই নন, তারা সেই সমাজের একজন সক্রিয় প্রতিনিধি এবং সচেতন মানুষ।
শুরুতেই অনেক বেশি এবং খোলামেলা কথাবার্তা না বলে ধীরে ধীরে শ্রেণিভিত্তিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটা সহজ ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
যেকোনো সমস্যার জন্য প্রথমে শিক্ষকদেরই জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং শিক্ষকদের খুবই ভালোভাবে এ বিষয়ে তৈরি করতে হবে, যেন তাদের মধ্যে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকে। এর বাইরেও সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ শিক্ষাক্ষেত্রে সুপারভিশনে কাজ করছেন এরকম সকল স্তরের কর্মকর্তাদেরকেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে।
শুরুতেই অনেক বেশি এবং খোলামেলা কথাবার্তা না বলে ধীরে ধীরে শ্রেণিভিত্তিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যাতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটা সহজ ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এছাড়াও মূল্যায়ন ব্যবস্থাতেও উক্ত বিষয়ের জ্ঞান ও দক্ষতাকে সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।
সর্বোপরি, একথা বলা যেতে পারে যে, একটি দেশের সরকার যদি আন্তরিকভাবে ভালো কোনো উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেন এবং তা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে চান এবং তার জন্য প্রচার, প্রচারণার এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করেন, তাহলে যত স্পর্শকাতর বিষয়ই হোক না কেন, তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো সমস্যা হবে না।
ড. তাপস কুমার বিশ্বাস ।। অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়