সুইটি বাণী বণিক
আজ ২৯ জুন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।এই উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শুরু করা যেতে পারে। ‘আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাইনি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।’ এখানে নিহিত রয়েছে কবির মহত্ত্ব। সৃষ্টির দুরূহ পথে চলার প্রত্যয়।
২.
কে বাংলা সাহিত্যকে প্রথম নাটক ও প্রহসনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন? কে প্রথম বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করে বাংলা কবিতার এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন? কে চিরাচরিত বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের জনক? এসব প্রশ্নের উত্তরে একজনের নামই আসে- মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তিনি আজও হয়ে আছেন এই সাহিত্যকে আলো করে থাকা এক অনন্য নক্ষত্র। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি এ সাহিত্যে এনেছিলেন ভিন্ন চিন্তা, কল্পনা ও সৃষ্টির এক সুবিশাল ঢেউ। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন বাংলা কবিতার জগতে চিরকালই এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাংলায় নাটক ও প্রহসন লেখার সূচনা করে তিনি এই সাহিত্যকে সবসময়ের জন্য তার কাছে ঋণী করে গেছেন। তার লেখনীর দ্বারা সৃষ্ট সেই পথ ধরে পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে যুক্ত হয়েছে কবর, রক্তাক্ত প্রান্তর ও নেমেসিসের মতো কালজয়ী নাটক, গাভী বৃত্তান্তের মতো প্রহসন।
মায়ের বুক জুড়ে বেড়ে উঠতে থাকেন মধুসূদন। জমিদারকন্যা হওয়ার সুবাদে মায়ের জ্ঞানচর্চার সুযোগ ঘটেছিলো। তাই মায়ের কাছেই হয় মধুসূদনের পড়ালেখার প্রথম পাঠ। মায়ের হাত ধরেই পরিচিত হন নিজ ধর্ম, দেব-দেবী, রামায়ণ, পুরাণ কিংবা মহাভারতের সাথে। কিন্তু গৃহশিক্ষা অচিরেই শেষ হয়ে যায় মধুসূদনের, পরবর্তী শিক্ষা হয় পাশের গ্রামের এক ইমাম সাহেবের কাছে।
ছোটকালেই আরবি, বাংলা ও ফারসি ভাষায় বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন মধু। জ্ঞানলাভ করেন সংস্কৃত ভাষাতেও। এক্ষেত্রে বলে রাখতে হয়, মোট তেরোটি ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। মাত্র তেরো বছর বয়সে যশোর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসতে হয় তাকে, ভর্তি হন স্থানীয় এক স্কুলে।
১৮৬১ সালের জানুয়ারি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এর আগেই ১৮৬০ সালে তার ‘পদ্মাবতী’ নাটক প্রকাশিত হয়। একইসময় বাংলা ভাষায় প্রথম আমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ প্রকাশিত হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে পাদ্রী জেমস লং সাহেবের ভূমিকা সম্বলিত ‘বাই এ নেটিভ’ ছদ্ম নামে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে তিনি
খ্যাতিমান হন। জুলাইতে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড ও ‘আত্ম বিলাপ’ কবিতা এবং ব্রজাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ পায়। আগস্ট মাসে বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম ট্র্যাজেডি ‘কৃষ্ণকুমারী’ প্রকাশিত হয়। কিছুদিনের জন্য ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই বছরেই কবি প্রখ্যাত সাহিত্যিক কালি প্রসন্ন সিংহের বাসভবনে অমিত্রাক্ষর ছন্দের মহাকাব্য রচনার জন্যে বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা লাভ করেন এবং মহাকবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।
৩.
বাঙালির সাহিত্য অর্জনের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখব প্রায় একশ’ বছর আগে শশাঙ্কমোহন সেন যে-কথা বলেছিলেন তা আজও সত্য। বিস্তারিত কাব্যক্ষেত্রে, বিশেষত মেঘনাদবধ কাব্যে, মধুসূদন যে ক্লাসিক বা ধ্রুপদী আভিজাত্য সৃষ্টি করেছিলেন তা আজও অনধিগম্যই থেকে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা একটি বচনাতীত সৌন্দর্যের রোমান্টিক কাব্য, রোমান্টিকতায় তার তুলনা কেবল কালিদাসের ‘মেঘদূত’। কিন্তু অনির্বচনীয় মাধুর্য সত্ত্বেও এ কাব্যে ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের সেই অসাধারণ আভিজাত্য নেই। অবশ্য, তার প্রয়োজনও নেই; কারণ দু’জনের কবি-ধর্ম আলাদা। একজন জন্ম রোমান্টিক, অপরজন কবিতার সেই পথের পথিক যা ক্লাসিকাল (অবশ্য তার মধ্যে রোমান্টিকতাও মিশে রয়েছে)। সাহিত্য চারিত্র্যের এই ভিন্নতার কারণেই রবীন্দ্রনাথ তার প্রথম জীবনে মধু-কবির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারেননি, ‘ভারতী’তে এই মহাকবির অযৌক্তিক সমালোচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মেঘনাদ বধ-এর গগনস্পর্শী আভিজাত্য ও ঋজুতা এবং মধুসূদন যে এমন এক উত্তমর্ণ যার ঋণ বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবে না তা উপলব্ধি করে লিখেছিলেন, “তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দ বোধ করিয়াছেন। এই শক্তির চারিদিকে প্রভূত ঐশ্বর্য; ইহার হর্ম্যচূড়া মেঘের পথ রোধ করিয়াছে; ইহার রথ-রথি-অশ্ব-গজে পৃথিবী কম্পমান; যে অটল শক্তি ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মাঝখানে বসিয়াও কোনমতেই হার মানিতে চাহিতেছে না, কবি সেই ধর্মবিদ্রোহী মহাদম্ভের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া যে-শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।” ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মধ্যেও যে অটল শক্তির কথা কবি বলেছেন, তা কি কেবল রাবণ, মধুসূদন নিজেও কি নন?
বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও কাব্য সাধনা শুরুর অব্যবহিত আগে মধুসূদনের জীবনে বিরাট সব ভূকম্পন ঘটেছিল। তার পিতৃ-মাতৃ-বিয়োগ, প্রথম স্ত্রী রেবেকাকে মাদ্রাজে ফেলে রেখে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে হেনরিয়েটাকে গ্রহণ, পিতৃ-সম্পত্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, এক কথায় জীবনের টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই মধুসূদন বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতার দীক্ষা দেওয়ার জন্য এগিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার মতো যোগ্যতা একাধারে বিরাট কবি প্রতিভা এবং সেই প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য বিশ্বসাহিত্যের মহত্তম কবি প্রতিভাদের সঙ্গে পরিচয় আর কারো ছিল না।
৪.
বিশপস কলেজে থাকার সময় (১৮৪৩-৪৭) তিনি গ্রিক, হিব্রু ও ল্যাটিন শিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষার মিলটন, শেকসপিয়র, বায়রন প্রমুখ কবিরা ছিলেন তার মনের নিত্যসঙ্গী। কেবলমাত্র এরাই নন, হোমার, ভার্জিল, ওভিদ, টাসো ও দান্তেকেও তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে ও পরে আর কি কেউ এরকম বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে সচেতনভাবে সাহিত্য-সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছেন? আমরা অনেকেই জানি, তিনি হঠাৎ করে বাজি ধরে অমিত্রাক্ষর রচনা করে বাংলা কবিতার পয়ার ও লাচারীর বদ্ধ-জলাভূমির বাঁধ ভেঙেছিলেন। এই সত্য অনুধাবন করা দরকার, ঐ কাজ কোনো দিনই তার পক্ষে করা সম্ভব হতো না যদি না তিনি বিভিন্ন ভাষায় কবিতার ধ্বনিগৌরবে তার কানকে সিদ্ধ ও ঋদ্ধ করতেন! গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত প্রাচীন আর্যভাষা। ইংরেজি ও বাংলা এই ভাষাসমূহেরই দুহিতা। বাংলা ছাড়া আর চারটি ভাষায় যদি অন্তমিল অপরিহার্য না হয়, তাহলে বাংলায় কেন তা হবে? এই বোধই মধুসূদনকে প্রেরণা জুগিয়েছিল অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধ্বনিগৌরব বাংলায় প্রতিষ্ঠা করতে। মনে রাখা প্রয়োজন, এর আগে তিনি ইংরেজি অমিত্রাক্ষরে কাব্য ও কবিতা রচনা করে এই ছন্দের অন্তর্নিহিত ধ্বনি ছন্দকে আত্মস্থ করেছিলেন। সুতরাং বাংলা কাব্য তার পায়ের শৃঙ্খল-ভাঙার জন্য, তার সাহিত্য-গগনকে আগুনের পরশমণিতে আলোকিত করার জন্য যে-প্রমিথিউসের অপেক্ষা করেছিল, শশাঙ্কমোহন যথার্থই বলেছেন, সেই প্রমিথিউস মধুসূদন। এই আগুন-জ্বালানোর জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েই মধুসূদন এগিয়েছিলেন। জীবনের সব ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বিপর্যয়ের মধ্যেও তার সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব অবিচল ও স্থিতধী ছিল।
বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর মতো মহৎ রোমান্টিক চেতনার কবিতা রচিত হলেও, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগের ধর্মবোধ ও চরিত্র-সৃষ্টির কৃত্রিম বেড়াকে অতিক্রম করতে পারেনি। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, অমিত সম্ভাবনায় ভাস্বর, স্বাধীনতা বোধে উজ্জীবিত যে-মানুষ, সে-মানুষের পরিচয় আমরা প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যে মাঝে মাঝে পাই। ইউরোপের রেনেসাঁস সাহিত্য সে-বোধকে আরও নানা বর্ণচ্ছটায়, নতুন জীবনবোধে, নারী-পুরুষের সম্পর্ককে দেহাতীত প্রেমের অমর্ত্য-চেতনায় উৎকণ্ঠিত ও আলোড়িত করে অন্য এক স্তরে নিয়ে স্থাপন করেছিল, বাংলা সাহিত্যকে সেই স্তরে উন্নীত করার যোগ্যতা ও প্রস্তুতি একমাত্র মধুসূদনেরই ছিল। রেনেসাঁসের মহৎ কবি- দান্তে মার্লো পেত্রার্ক শেক্সপীয়র ও মিল্টনের কাব্যের আভিজাত্য ও চিত্ত সমুন্নতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করতে না পারলে তা কোনোদিনই সম্ভব হতো না।
যে কবি জন্মে ছিলেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে, কিন্তু জীবন কাটল কবির দীনতার চরম কষ্টে।
৫.
দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল… সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবির জন্ম ভিটায় শ্বেত পাথরে তাঁর এই কবিতার পঙক্তি নজরে পড়লেই কবিভক্ত ও পর্যটকদের ক্ষণকাল দাঁড়াতেই হয়।
সাগরদাঁড়িতে গেলে বারংবার ঘুরে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হয় কবির জন্ম ভিটা। যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ নদ। যে নদ দেখলেই আপনার মনে পড়বে প্রকৃত প্রতিভাবানের কথা।
(লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, আইনজীবী, এম এ বাংলা)