* অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস *
অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান (জন্ম: ১৯৫৮) বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক গদ্য সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা ও কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাঁর রচনা গভীর দার্শনিকতা, চিরাচরিত আখ্যানের উপর বি-নির্মাণ সমালোচনা এবং জটিল পশ্চিমা তত্ত্বের সফল সমন্বয়ের জন্য বিখ্যাত। এই প্রবন্ধে তাঁর বহুমুখী অবদান, বিশেষত বাল্টার বেনিয়ামিনের ‘অরা’ (Aura) তত্ত্বের আলোকে কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যিক আধুনিকতার ব্যাখ্যা, ২০০৫ সাল থেকে সাধু ভাষার শৈলীগত নিরীক্ষা এবং মুসলিম নেতৃত্বের কাছে বাংলার প্রতি অবজ্ঞার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক ভাষ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একই সাথে, তাঁর কিংবদন্তিতুল্য মেধার প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবহার এবং এর ফলে সৃষ্ট ‘অপ্রকাশিত প্রতিভার উপাখ্যান’ আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধ সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ লাভ করেছেন।
১.
সলিমুল্লাহ খান একাধারে অধ্যাপক, লেখক, আইনজ্ঞ, দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক। তাঁর মেধা এবং অসাধারণ স্মরণশক্তি তাঁকে ‘জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া’র মর্যাদা দিয়েছে, যিনি বহু হাজার বছরের ইতিহাস, অজস্র বই ও লেখকের নাম অনায়াসে মনে রাখতে পারেন। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি এবং নিউ ইয়র্কের দ্য নিউ স্কুল থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে তাঁর সুসংগঠিত একাডেমিক ভিত্তি রচিত হয়। বাঙালি চিন্তকদের মধ্যে আহমদ ছফা ও অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা ও অকুণ্ঠ প্রশংসা তাঁর বিনয় ও জ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে প্রকাশ করে।
২.
সলিমুল্লাহ খানের প্রবন্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জটিল তাত্ত্বিক কাঠামোকে দেশীয় সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা।
দার্শনিক ও তাত্ত্বিক সমন্বয়: তাঁর প্রবন্ধে কার্ল মার্ক্স, জাক লাকঁ, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদা এবং ফ্রঁৎস ফানঁর মতো পশ্চিমা দার্শনিকদের চিন্তা সফলভাবে বাংলা গদ্যে একীভূত হয়েছে। তিনি বৈশ্বিক তত্ত্বগুলোকে বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মানকে উন্নত করেছেন।
বি-নির্মাণ(Deconstruction) সমালোচনা: প্রচলিত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্যিক আখ্যানের ভিত্তি ও অন্তঃস্থ ক্ষমতার সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি নিয়মিতভাবে বি-নির্মাণ (deconstructive) পদ্ধতির ব্যবহার করেন।
বি-নির্মাণ সমালোচনার সৃজনশীল দিক: অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্যতম মৌলিক শক্তি হলো তাঁর বি-নির্মাণ সমালোচনা (Deconstructive Criticism) পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ। এই পদ্ধতি তাঁর লেখাকে কেবল সমালোচনামূলক করে তোলে না, বরং একে নব-নির্মাণ ও সৃজনশীল অনুসন্ধানের পথে চালিত করে।
চিন্তাধারার ভিত্তি পুনঃস্থাপন: পুনরুক্তি হলেও বলা যায়, সলিমুল্লাহ খান প্রচলিত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্যিক আখ্যানের অনমনীয় ভিত্তি এবং অন্তঃস্থ ক্ষমতার সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নিয়মিতভাবে Deconstructive পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এই চ্যালেঞ্জের উদ্দেশ্য পুরনোকে কেবল ভেঙে দেওয়া নয়, বরং আখ্যানের কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসঙ্গতি, নীরবতা এবং প্রান্তিক কণ্ঠস্বরগুলোকে উন্মোচন করা। এর মাধ্যমে তিনি প্রচলিত জ্ঞানের স্থিতাবস্থা ভেঙে দেন এবং পাঠকের জন্য নতুন চিন্তার দুয়ার উন্মোচন করেন।
যুক্তির গভীরে প্রবেশ: তাঁর এই পদ্ধতি প্রথাগত আলোচনার গভীরে প্রবেশ করে সুপ্ত ক্ষমতা কাঠামোকে দৃশ্যমান করে তোলে। এটি পাঠককে শেখায় কীভাবে কোন বক্তব্য বা ধারণার ভেতরের দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তাগুলো কাজ করে। ফলে, তাঁর সমালোচনা অন্ধ আনুগত্যের বিপরীতে মুক্ত বিচার-বুদ্ধি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে।
নতুন জ্ঞানের উৎসমুখ: সলিমুল্লাহ খানের এই কৌশল বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে একটি সাহসী ও ফলপ্রসূ ধারা তৈরি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, শক্তিশালী প্রবন্ধ রচনার জন্য কেবল ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়; কাঠামোগত প্রশ্ন উত্থাপন এবং ধারণার পুনর্বিন্যাস অত্যাবশ্যক। তাঁর প্রবন্ধগুলি এইভাবে একটি সৃজনশীল উপায়ে সমাজ ও সংস্কৃতিকে পুনর্পাঠ করার আমন্ত্রণ জানায়।
রাজনৈতিক অর্থনীতি ও ঔপনিবেশিকতা: তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু হলো বিশ্বায়ন, নব্য-উদারতাবাদী অর্থনৈতিক নীতি এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদের প্রভাবের তীব্র সমালোচনা। স্বাধীনতা ব্যবসায় গ্রন্থে তিনি ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী উত্তরাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমা চিন্তাধারাকে বিশ্লেষণ করেন।
ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ: বেহাত বিপ্লব ১৯৭১ গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কৌশলগত ও রাজনৈতিক দিক বিশ্লেষণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের তিনটি মূল নীতি—”সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার”-এর উপর গুরুত্বারোপ করেন।
৩.
সাহিত্য সমালোচনার অভিনবত্ব: নজরুল ও বেনিয়ামিনের ‘অরা’ তত্ত্ব
সলিমুল্লাহ খানের সাহিত্য সমালোচনার সবচেয়ে নতুন এবং প্রভাবশালী সংযোজন হলো জার্মান দার্শনিক বাল্টার বেনিয়ামিনের ‘অরা’ (Aura) তত্ত্বকে ব্যবহার করে কাজী নজরুল ইসলামের আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করা।
• মহিমার অবসানে আধুনিকতা: বেনিয়ামিন তাঁর তত্ত্বে বলেছেন, প্রযুক্তিগত পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকর্মের ঐতিহ্যগত ‘মহিমা’ বা ‘অরা’ (ঐতিহ্য ও অনন্য উপস্থিতি) বিলীন হয়, যার ফলস্বরূপ আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। সলিমুল্লাহ খান এই তত্ত্বের আলোকে দেখান, নজরুলের সঙ্গেই আধুনিক বাংলা কবিতার জন্ম, কারণ নজরুলের কবিতা সেই মহিমাকে ভেঙে দেয়।
• ‘আমার কৈফিয়ৎ’ ও অভিজ্ঞতা: তিনি যুক্তি দেন যে, নজরুলের কবিতা ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এর মাধ্যমে কবি প্রচলিত ‘চিরকেলে বাণী’ এবং ‘অমর কাব্য’ ধারণাকে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। সলিমুল্লাহ খান এটিকে ফ্যাসি-নন্দনতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে দেখেন এবং জোর দেন যে, নজরুল মনে করতেন: ‘অলৌকিক প্রতিভা বা জিনিয়াস নহে, অভিজ্ঞতাই শিল্পের জননী’। এই বক্তব্য আধুনিকতার পক্ষে এক জোরালো অবস্থান।
• রবীন্দ্র-নজরুল তুলনামূলক পাঠ: তিনি রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনার (যেখানে ‘জাদুকর’ দূর থেকে বস্তুকে দেখেন, যা ‘অরা’ যুক্ত) সঙ্গে নজরুল ও আধুনিকতার (যেখানে ‘শল্যচিকিৎসক’ কাছে এসে বস্তুর ভিতরটা দেখেন, যা ‘অরা’ বিহীন) দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখান। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের ‘চিরন্তনতা’ অথবা ‘সমগ্রতা’র ধারণা ইউরোপে প্রচারিত ফ্যাসি-চিন্তার কাছাকাছি।
৪.
রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাষ্য: মুসলিম নেতৃত্ব ও বাংলার অবজ্ঞা
বাঙালি মুসলিম সমাজের ভাষাভিত্তি, মনন এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের বিশ্লেষণ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।
• বাংলার প্রতি অবজ্ঞা: তিনি মন্তব্য করেন, “মুসলমান নেতৃত্বের কাছে এখন বাংলাও অবজ্ঞার শিকার”, যা বাঙালি মুসলমানের উর্দুপ্রীতি এবং ইংরেজিপ্রীতির সঙ্গে তুলনীয়। এই প্রবণতাকে তিনি নেতৃত্বের ভাষাগত অনীহার প্রতিফলন হিসেবে দেখেন।
• সাম্প্রদায়িকতার উৎস: তাঁর মতে, “হিন্দুর বর্ণপ্রথা থেকেই সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি হয়েছে,” এবং এই বর্ণাশ্রম প্রথা থেকেই মুক্তির আশায় বহু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
• বাঙালি মুসলিমের দুর্ভাগ্য: তিনি মনে করেন, বাঙালি মুসলমানের দুর্ভাগ্য ইউরোপীয় উপনিবেশের সাথে উদ্ভূত হয়নি; বরং ইংরেজ শাসনের অধীনে হিন্দু অভিজাতরা নতুন মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হওয়ায় বাঙালি মুসলমানরা সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে তিনি স্বীকার করেন, বাঙালি মুসলমানের দুর্ভাগ্যের উৎস তাদের দোষও বটে।
• পরিচয়: তাঁর মতে, “বাঙালি হচ্ছে ভাষা ও এলাকার পরিচয়, মুসলমান হচ্ছে বিশ্বাস ও মূল্যবোধের পরিচয়।”
৫.
কর্মজীবন, ভাষাশৈলী ও অপ্রকাশিত প্রতিভার উপাখ্যান
সলিমুল্লাহ খান একাধারে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, গবেষক, দার্শনিক ও আইনবিদ হিসেবে পরিচিত। তাঁর কর্মজীবন, ভাষাশৈলী এবং প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
• ভাষাগত নিরীক্ষা: ২০০৫ সাল থেকে তিনি বাংলা সাধু ভাষায় লেখালেখি করে আসছেন, যা আধুনিক বাংলা গদ্যে এক বিরল শৈলীগত স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছে।
• কর্মজীবন: তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (আইবিএ), স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি হয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সেন্টার ফর এডভান্সড থিওরির পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র প্রফেসর হিসিবে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন।
• প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবহার: তাঁর মতো অনন্য প্রতিভার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ না হওয়াকে অনেক সমালোচক ‘একটি বড় ক্ষতি’ বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শিক্ষকতায় নিয়োগ না দিয়ে তাঁর মেধা ও সক্ষমতাকে বুঝতে ও মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর মতো এত বড় জ্ঞানী মানুষের আসল গুণ, শিক্ষা দেবার ক্ষমতা, কিছুটা ‘আধাপেশাদারী কায়দায় খরচ হলো’—যা রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত।
• গ্রন্থপঞ্জি ও স্বীকৃতি: তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বেহাত বিপ্লব ১৯৭১, আদমবোমা, স্বাধীনতা ব্যবসায়, আহমদ ছফা সঞ্জীবনী এবং ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা। প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ লাভ করেন।
৬.
সলিমুল্লাহ খান বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রচলিত চিন্তাকে প্রশ্ন করার এবং বৈশ্বিক তত্ত্বকে দেশীয় প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণের ধারা তৈরি করেছেন। তিনি একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন চিন্তক, যিনি শাসকের মনোভাবে চলেন না, বরং অতীতের অনেক বৈরী সময়কে মোকাবেলা করেছেন নিজস্ব মেধায় ও বিচক্ষণতায়। তাঁর প্রবন্ধগুলি বুদ্ধিবৃত্তিক কঠোরতা, দার্শনিক অনুসন্ধিৎসা এবং ভাষাগত নিরীক্ষার এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত, যা তাঁকে সমসাময়িক বাংলা গদ্যের ইতিহাসে এক ‘স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর’ এবং বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
(লেখক : অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস, সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)