ফারিয়া ইয়াসমিন
জলবায়ু পরিবর্তন আজকে বিশ্বের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ সেই হুমকির মধ্যে দশটি দেশের মধ্যে একটি। আমাদের সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘন ঘন শিকার হচ্ছে। সারা বিশ্বে অবশ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। এরমধ্যে আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড় বিভিন্ন সময়ে ক্ষয়ক্ষতির কারণ হচ্ছে। প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। অতি সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের হাত থেকে ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করেছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। কেবল আম্ফানের হাত থেকেই নয়, এর আগে ১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৮ সালে বুলবুল ও ২০১৯ সালের ফণী এবং এ বছর আম্পানের গতি থমকে দিয়েছে সুন্দরবন। না হলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতো। ঘূর্ণিঝড়ের সুন্দরবনে আঘাত করে দুর্বল হয়ে পড়ে। মায়ের আঁচলের মতো প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও বার বার ভয়াল ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করছে। তাই প্রকৃতির এই বিরূপ বিপর্যয় থেকে আমাদের বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। আর বাংলাদেশ রক্ষা করতে হলে আগে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমিয়েছে সুন্দরবন। এর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও ৩ থেকে ৪ ফুট কমিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি।
ঝড়টি ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার গতিবেগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত করে। আর এটি বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় আঘাত করে ঘণ্টায় ১৫১ কিলোমিটার গতিবেগে। কিন্তু তার আগেই সুন্দরবন এর শক্তি কমিয়ে দেয়। ফলে এই ঝড়ে যে পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে উপকূলের মানুষ ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে।
সুন্দরবন না থাকলে কলকাতা শহরে ঘূর্ণিঝড় আম্পান যে তাণ্ডব চালিয়েছে, একই পরিণিত হতো আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর। এতে পশ্চিবঙ্গে প্রায় ৮০ জন এবং বাংলাদেশে অন্তত ২১ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢাকায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার, আর কলকাতায় ছিল ১১২ কিলোমিটার। তাই সুন্দরবন না থাকলে ঢাকাতেই ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতি নিয়ে ঝড়টি চলে আসত।
তবে ওই ঝড়ের কারণে সুন্দরবনের বেশ ক্ষতি হয়েছে। বন বিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার মতো এবারও সুন্দরবনের মিষ্টি পানির উৎস ৬৫টি পুকুর, বন বিভাগের ১৮টি টিনের তৈরি ফাঁড়ি, ২৮টি জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছও ভেঙে পড়েছে। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ছয় মাস আগে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ফলে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের। এর মধ্যে স্থাপনা বা অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি আট লাখ টাকা। আর ১৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে গাছের। তবে বন্য প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয়নি। গত ২০ মে উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে সুন্দরবনের ক্ষতি নির্ধারণে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর আগে গত নভেম্বরে আঘাত হানা বুলবুলে সুন্দরবনের ক্ষতি হয়েছিল এক কোটি ১৩ লাখ টাকার।
বন বিভাগের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সুন্দরবনের ভেতরে ১২ হাজার ৩০০টি গাছের ক্ষতি হয়েছে। এসব গাছ উপড়ে গেছে। যার মধ্যে ১০ হাজার ৫০০ গাছ হলো গড়ান। এক হাজার ৮০০ গাছ কেওড়া এবং এক হাজার ২০০ গাছ হলো গেওড়া। এসব গাছ সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে। তবে বাগেরহাট অংশে তেমন ক্ষতি হয়নি।
জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপিসহ পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ম্যানগ্রোভ বন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে তা এক যুগ ধরে বলে আসছে। ভারত, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়ায় এ নিয়ে বিস্তর গবেষণাও হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ ৫-১০ গুণ বৃদ্ধি পেত।
বিশাল প্রাণ সমষ্টি নিয়ে গঠিত সুন্দরবন এক অবিচ্ছিন্ন প্রাণসত্তা। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন যে, বনের একটি একক পরিবর্তন হলে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।কিছু স্বার্থান্বেষী
মানুষের কারণে সুন্দরবনের অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কয়েক দশক পরে সুন্দরবনের প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে সুন্দরবনের প্রাণীকুল ধ্বংসের মুখে। মানুষসৃষ্ট কারণেই সুন্দরবন ধ্বংস হচ্ছে। অবাধে বৃক্ষ নিধন, পশু শিকার, মানুষের। পরিবেশ বিরোধী কার্যকলাপে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। সম্প্রতি শ্যালা নদীতে তেল ট্যাংকার দুর্ঘটনার কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে সুন্দরবনের পরিবেশ। নানা দুর্যোগের আঘাতে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্ৰস্ত হলেও সুন্দরবনের উত্তরে অবস্থিত জনপদ তুলনামূলক ভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রশস্ত উপকূলীয় ম্যানগ্ৰোভ বনসম্পন্ন এলাকা বনবিহীন উপকূলীয় এলাকা অপেক্ষা জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় প্রভূত ভূমিকা পালন করে।
সুন্দরবন ঢাল হয়ে আমাদের দেশকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করছে। সুন্দরবন যেভাবে বাংলাদেশকে রক্ষা করে চলছে আমরা সেভাবে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে পারছি না ক্রমেই ধ্বংস করে চলেছি এই বন সেই সাথে হুমকির মুখে ফেলছি নিজেদের জনজীবন। সুন্দরবন আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা কেউ সুন্দরবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছি না। যদি সুন্দরবনের ওপর এরূপ ধ্বংসলীলা চলতে থাকে আমাদের জনজীবন যেমন হুমকির মুখে পড়বে পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রবাদ আছে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝেনা । সুন্দরবন আছে বলেই আমরা এর মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারছি না । বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতির প্রভাব মে কতটা ভয়াবহ হবে তা ক্রমেই আমরা সবাই বুঝতে পারছি। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত আন্তঃসরকারী প্যানেলের (আইসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে । সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততার অগ্ৰাসন বাড়বে। সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে এবং বিশাল এলাকাজুড়ে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা হবে। সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির নিচে নেমে যাবে , অনাবৃষ্টি ,অতিবৃষ্টি, করা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস অতিমাত্রায় বেড়ে যাবে।
লন্ডন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্রাফট কয়েক বছর আগে ১৭০ টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়ে যে ১৬ টি দেশকে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
সুন্দরবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আমাদের এখনই এটি রক্ষা করতে যথার্থ উদ্যোগ গ্ৰহন করতে হবে। মনে রাখা দরকার সুন্দরবন প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। তাই এটা ধ্বংস করে আরেকটা সুন্দরবন তৈরি করা সম্ভব নয়।
(লেখক : ফারিয়া ইয়াসমিন, শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।)