ড. আলো ডি’রোজারিও
ভূমিকা : স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন, কাজ ও মানবিকতা আমাদের সকলের ভালোভাবে জানা ও অন্যকে জানানো দরকার যেন আমরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হই এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে পারি। বাল্যকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্ভীক, অমিত সাহসী এবং মানবদরদী। সেসাথে তিনি ছিলেন রাজনীতি ও অধিকার সচেতন। গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই বিশ্বনেতার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল: বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে উদ্ধার করা; ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে সকলের উন্নত জীবন নিশ্চিত করা। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক অবদান যে মহামানবের তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব শতবর্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে জানা ও জানানোর প্রয়াসে আমার এই লেখা।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম : আমরা জানি, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমাদের এই বাংলাদেশে এক বিশ্ব-মহানায়ক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয় গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে, ছয়
ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান দায়রা আদালতের সেরেস্তাতার
হিসেবে সরকারী চাকুরি করতেন, মায়ের নাম মোসাম্মৎ সায়েরা খাতুন। বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা একসময়
এলাকার বড় জমিদার ছিলেন, কিন্তু তাঁর জন্ম হয় মধ্যবিত্ত পরিবারে। বঙ্গবন্ধুর নামকরণ করেন তাঁর নানা
আবদুল মজিদ এবং তাকে খোকা বলে ডাকা হতো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মাতৃ-পিতৃভক্ত পুত্র, ভাইবোনদের প্রতি
ছিল তার গভীর ভালোবাসা।
বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়া: প্রথমে বঙ্গবন্ধু ১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। এর দুই বছর পরে তাঁর আব্বা তাঁকে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে ভর্তি হন, তখন এই স্কুলটির বেশ সুনাম ছিল। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা হতেই নানা রোগে ভুগতে থাকেন, সাত বছর বয়সে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন, এরপর দেখা দেয় তাঁর চোখের সমস্যা, আর এসব রোগের কারণে তাঁর লেখাপড়া কয়েক বছর বন্ধ থাকে। অসুস্থতার কারণে লেখাপড়ায় পেছনে পড়ে যাওয়ায় ১৯৪২ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তিনি পাঠ্যপুস্তক-বহির্ভূত ছাত্র কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নিতেন এবং সংগঠক হিসেবে ভালো ভূমিকা রাখতেন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কলকাতা, সেখানে ভর্তি হন ইসলামিয়া কলেজে (যার বর্তমান নাম, মৌলানা আজাদ কলেজ)। এই কলেজ হতে তিনি ১৯৪৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঐ বছরে দেশবিভাগের সময় তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হলেও পড়াশুনা সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, তখন হতেই তিনি মানুষের অধিকার আদায়ে প্রথমে ছাত্র রাজনীতি ও পরে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিতে দিনরাত পরিশ্রম করা শুরু করেন, তাঁর কারাবরণের অধ্যায়ও তখন হতেই শুরু।
বঙ্গবন্ধুর জীবন–যাপন: উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ’শেখ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে।’ প্রাবন্ধিক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত লিখেছেন, ’বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে এবং তাদের সম্পদ ছিল জমিজমা’ (দৈনিক সমকাল, ১৭ মার্চ ২০২০)। নিজ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিনয়ী ভাব স্পষ্ট করেছেন আমাদের সামনে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সত্যিকারের বিনয়ী। কিন্তু অন্যায়, অসত্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের একটি উদাহরণ হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত সমর্থন দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৮ সালের ঐ আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে, পরে আন্দোলনকারী ২৭ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ঘোষণা দেয়, বহিষ্কৃত ছাত্ররা যদি ’আর আন্দোলন করবো না’ মর্মে মুচলেকা দেয়, তবে তাদের বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা হবে। তখন একে একে ২৬ জন ছাত্রই মুচলেকা দেন, বঙ্গবন্ধু মুচলেকা দেন নি, কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন, ফলে আর ছাত্রত্ব ফিরে পাননি। বঙ্গবন্ধুর জীবন-যাপন, পোশাক-আশাক ও খাওয়া-দাওয়া ছিল সাধারণ বাঙালী মধ্যবিত্তসুলভ, যা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও পাল্টে যায় নি। সকালের নাস্তায় খিচুরি আর ডিম ভাজি যে তাঁর পছন্দের খাবার, একথা তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হতেন, তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। গোপালগঞ্জে তাঁর এলাকায় এক সময় খাদ্যাভাব দেখা দেয়, ফলে অনেক লোকের অনাহারে তিন কাটাতে হয়। তিনি এটি সহ্য করতে না পেরে তাদের ধানের গোলাঘর উন্মুক্ত করে সবাইকে সেখান থেকে ধান নিয়ে যেতে সুযোগ করে দেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে, তাঁর সহমর্মী ও সমব্যথী হৃদয় কতই না বড় ও উদার ছিল। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আমাদের ভাল-মন্দ জানতে ফোন দিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও কন্ঠশিল্পী মি. সাইমন গমেজ। কথায় কথায় তিনি জানালেন বঙ্গবন্ধুর সাথে তার দেখা-সাক্ষাতের কথা। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সাথে দেখা করতে মি. সাইমন গমেজ একাধিকবার তাঁর ধানমন্ডীর বাড়ীতে যান। মি. সাইমন গমেজ জানান, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করা তখন খুব সহজ ছিল কারণ বঙ্গবন্ধু সব ধরনের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সময় দিতেন সকাল আটটা থেকে শুরু করে। তিনি সবার কথা ধৈর্য্য ধরে শুনতেন ও সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতেন।
বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা ও মানবিকতা: বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা কেটেছে মধুমতি নদীর পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা গ্রাম, টুঙ্গিপাড়ায়। তিনি তাঁর শৈশব থেকেই এই গ্রামের নিরন্ন মানুষের চিনতে ও তাদের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। বর্তমান লেখায় উপরে আমরা পড়েছি, বঙ্গবন্ধু একবার তাদের গোলাঘর উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন যেন খাদ্যাভাবে কষ্টে থাকা তাঁর গ্রামবাসী খাদ্য নিয়ে যেতে পারেন। আর একবার তিনি স্কুল হতে ফেরাকালে মাঝপথে দেখলেন, একজন অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ শীতে থরথর করে কাঁপছে, কিছু একটা করার জন্য তাঁর মনটা কেঁদে উঠলো, ক্ষাণিক ভেবে তিনি তাঁর গায়ের চাদর খুলে বৃদ্ধকে দিয়ে দিলেন। আরো পরের ঘটনা, তখন বর্ষাকাল চলছিল, তুমুল বৃষ্টির দিনে বঙ্গবন্ধু একটি নতুন ছাতা নিয়ে স্কুলে গিয়ে দেখলেন, তাঁর এক বন্ধু ছাতা নেই বলে স্কুলে আসতে আসতে ভিজে গেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর নতুন ছাতাটি সেই বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনভর বঙ্গবন্ধু এমনিতরো মানবিক কাজ অনেকবার করেছেন।
ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক সাহসের কাজও বঙ্গবন্ধু করেছেন। উপরে উল্লেখ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সমর্থনদান ছিল একটি সাহসিক কাজ। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্কুলজীবনে যেসব সাহসের কাজ করেছিলেন তার একটি এখানে উল্লেখ করছি: তখন বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুলে পড়তেন। একদিন স্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে তারা চলে যাচিছলেন, তাদের বিদায় দিতে সাথে ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কয়েকজন ছাত্রসহ বঙ্গবন্ধু তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান ও অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেন, বৃষ্টির সময় স্কুলের হোষ্টেলের ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে, তাতে ছাত্রদের সবকিছু ভিজে যায়, পড়াশুনায় ব্যঘাত হয়, ঘুমাতে অসুধিা হয়। মাননীয় পরিদর্শকদ্বয় স্কুলছাত্রের সাহসী ভূমিকা দেখে খুবই খুশী হন এবং এই বলে প্রতিশ্রুতি দেন যে নিজস্ব তহবিলের অর্থে হোষ্টেলের ছাদ মেরামত করে দিবেন।
বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা ও মানবিকতার বহু ঘটনা ও গল্প তাঁর নিজের লেখা আত্মজীবনী এবং তাঁকে নিয়ে লেখা তাঁর সহকর্মীদের প্রবন্ধ-নিবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি। বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণও আমাদের জানান দেয় যে তিনি কী মাত্রায় সাহসী ছিলেন। মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য সাধারণ। তিনি বলতেন, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি, আমার জনগণ আমাকে ভালোবাসে। যারা তাঁর সাথে একত্রে কাজ কাজ করেছেন, তারা তাদের লেখায় ও বক্তৃতায় স্বীকার করেন, এটা কথার কথা ছিল না। নেতাকর্মী ও পরিচিতজনদের প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। প্রত্যেকের সুখ-দু:খের কথা তিনি শুনতেন এবং শত ব্যস্ততার মধ্যেও সবসময় আন্তরিকতাসহকারে উদ্যোগ নিতেন সেসব সমস্যা সমাধানের।
উপসংহার: বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে বলেছিলেন, বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্র ও তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে সন্তান তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না সে সন্তান বাঙালি হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর এই কথা আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে শিশুদের জন্য, আরো বেশি প্রযোজ্য। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ, সাহস ও মানবিকতার কথা জেনে শিশু, তরুণ ও ছাত্রসমাজসহ আমরা সকলে গৌরববোধ করবো, অনুপ্রাণিত হবো ও উদ্বুদ্ধ হবো দেশপ্রেমে ও দেশের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হতে, এটাই কামনা।
( লেখক : ড. আলো ডি’রোজারিও, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কারিতাস বাংলাদেশ, প্রেসিডেন্ট, এশিয়া কারিতাস)