অ) ১৯৮৪ সালের কথা মনে পড়ে। ঐ বছরের মার্চ মাসে যখন ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্যে বিমানে রওয়ানা হই এবং ইংলিশ চ্যানেল পাড় হয়ে যখন হিথরো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের মাটির উপরে বিমান উড়তে থাকে। তখন বেশ কতগুলো স্থানে মোটা মোটা চিমনী দিয়ে সাদা ধোঁয়া বের হতে দেখি। এ ব্যাপারে এয়ার হোস্টেসকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি যে, এগুলো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই সময়ে ভাবতে থাকি যে আমাদের দেশে কোন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। যদিও পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে পাবনার ঈশ^রদী উপজেলাধীন পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে একটি পারমাণবিক চুল্লী করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, তাও মৃত ও অপরিকল্পিতভাবে পড়ে আছে। সেই ৩৮ বছরের আগের কথা এখনও ঠিক মনে আছে। কিন্তু বর্তমানে রূপপুর আনবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, এই কেন্দ্র আগামী বছরের প্রথম দিকে উৎপাদনে যাবে এবং দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা দশ ভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে বলে জানা যায়।
এ ব্যাপারে এই প্রবন্ধের স্বার্থে বিদ্যুৎ নিয়ে কিছুটা কথা বলা আবশ্যক বলে মনে করি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, প্রত্যেকটি পদার্থ অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত, এদেরকে পরমাণু বলে। প্রত্যেক পদার্থের পরমাণুতে, নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন বিদ্যমান। আর নিউক্লিয়াসের মধ্যে দুই ধরণের কণা থাকে- প্রোটন ও নিউট্রন। উল্লেখ্য যে, পদার্থ সৃষ্টিকারী প্রায় কণাসমূহের (ইলেক্ট্রন ও প্রোটন) মৌলিকত্বসহ এর বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্মই হচ্ছে আধান বা চার্জের আওতাভুক্ত। আর ইলেকট্রনের আধান ঋণাত্মক এবং প্রোটনের আধান ধনাত্মক হিসেবে বিদ্যমান। কিন্তু নিউট্রন নিরপেক্ষ বিধায় এতে কোনো আধান নেই। একটি প্রোটনের আধানের পরিমান ইলেকট্রনের আধানের সমান হয়ে থাকে। তাই একটা গোটা পরমাণুতে কোনো বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় না। মূলত বিভিন্ন পদার্থের পরমাণুতে প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এদিকে দু’টি ভিন্ন বিভবের বস্তুকে যখন পরিবাহী তার দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। তখন নি¤œ বিভবের বস্তু থেকে উচ্চ বিভবের বস্তুতে ইলেকট্রন প্রবাহিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বস্তুদ্বয়ের মধ্যে বিভব পার্থক্য শূন্য না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রবাহ বজায় বা চলতে থাকে। আর কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি বস্তুদ্বয়ের মধ্যে বিভব পার্থক্য বজায় রাখা যায়, তাহলে এই ইলেকট্রন প্রবাহ নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। ইলেকট্রনের এই নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহই হলো তড়িৎ বা বিদ্যুৎ। সাধারণত ঘর্ষণের ফলে এক বস্তু থেকে অপর বস্তুতে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয়। ইলেকট্রনের মৌলিক ও বৈশিষ্ট্যমূলক ধর্ম হচ্ছে আধান বা চার্জ , যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সেহেতু ঘর্ষণে বস্তু আধানগ্রস্ত বা চার্জিত হয়ে থাকে। আর আধানের প্রকৃতি ও প্রবাহকে বলা হয় তড়িৎ বা বিদ্যুৎ, যা ইতিপূর্বেই বলেছি। এদিকে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ছয়শত বছর পূর্বে গ্রিক দার্শনিক থেলিস সর্বপ্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে সোলেমানী পাথর বা অ্যাম্বারকে (পাইন গাছের শক্ত আঠা) রেশমি কাপড় দিয়ে ঘষলে এগুলো ছোট ছোট কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করে থাকে। কিন্তু আকর্ষণ করার মূল কারণ বুঝতে সময় লেগে যায় পাক্কা দুই হাজার বছরেরও বেশী। উল্লেখ্য যে, অ্যাম্বার এর গ্রিক ভাষায় নাম ইলেকট্রন আর এটি থেকে ইলেকট্রিসিটি বা তড়িৎ তথা বিদ্যুৎ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। অবশ্য এই সূত্র ধরে ১৬০০ খৃস্টাব্দে রাণী এলিজাবেথের গৃহ চিকিৎসক উইলিয়াম গিলবার্ট গবেষণার পর ঘর্ষণজনিত বিদ্যুতের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের নাম ইলেকট্রিসিটি কথাটি প্রবর্তন করেছেন বলে জানা যায়। আর একটি কথা, আমরা যে ঋনাত্মক এবং ধনাত্মক কথা বলি সে ব্যাপারে স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক বেঞ্জামিন ফ্যাঙ্কলিনের কাছে ঋণী। তাছাড়া বিদ্যুৎ নিয়ে যাদের অবদান কভু ভুলবার নয়। তাঁরা হলেন আলেকজান্ডার ভোল্টা, মাইকেল ফ্যারেডে, ওহম, কার্শপ, কুলম্ব, লেঞ্জ, টেসলা, জন সিল্ভা, আলভা এডিসন, উনস্টোন, প্রমুখ। যাহোক, বর্তমান এই আধুনিক বিশে^ বিদ্যুৎ বিভিন্ন মাধ্যমে উৎপন্ন করা হয় যেমন- কয়লা, তেল ও গ্যাস পুরিয়ে তাপ সৃষ্টি করে; জল বিদ্যুৎ; সূর্যকিরণ তথা সোলার বিদ্যুৎ; বায়ু চালিত পাখার মাধ্যমে বিদ্যুৎ; রাসায়নিক বিদ্যুৎ যেমন ব্যাটারী; সমুদ্রে ঢেউতে বিশেষ ধরনের বেলুন রেখে বিদ্যুৎ এবং সর্বোপরি আলোচনার বিষয়বস্তু পারমাণবিক শক্তির দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন।
আ) এখন শুধু পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়ে সম্মানিত পাঠক পাঠিকার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছি। আর সংগত কারণেই এ ব্যাপারে গোড়ায় চলে যাই। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ১৭৮৯ সালের দিকে বিজ্ঞানী মার্টিন হেনরিখ ক্ল্যাপরথ ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেন। এটি যে কত বড় আবিষ্কার তা বলে বুঝানো যাবে না। কেননা মানুষ যখন বিশ^কে আরও গতিশীল করার জন্যে শক্তি (ঊহবৎমু) এর ব্যাপারে চিন্তিত। ঠিক তখনই এটি একটি বড় নিয়ামক হিসেবে দেখা দেয়। যাহোক, এটি ইউরেনাস গ্রহের নামানুসারে নামকরণ করা হয়। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয় ১৮৪১ সালে। আর এই বছর বিজ্ঞানী ইউজিন পেলিকট ইউরেনিয়াম টেট্রাক্লোরাইড থেকে প্রথম ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেন। এদিকে ১৮৬৯ সালে যখন দিমিত্রি মেন্ডেলিভ পর্যায় সারণি আবিষ্কার করেন। তখন ইউরেনিয়াম ভারী মৌল হিসেবে বিশ^বাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানেই শেষ নয়। কেননা ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন।
এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, বিষয়টি জটিল বিধায় আসুন আমরা পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্য কিছুটা খোলাখুলি আলোচনা করি। পূর্বেই আলোকপাত করেছি যে, প্রত্যেক পদার্থ পরমাণু নামক অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। সব মৌলের পরমাণুতে থাকে ইলেকট্টন, প্রোটন এবং নিউট্রন। নিউট্রন ও প্রোটন পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। আর ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের বাইরে অবস্থান করে। পরমাণু সামগ্রিকভাবে কোন চার্জযুক্ত থাকে না। নিউট্রন চার্জবিহীন, তাই পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান সমান থাকে। কেননা প্রোটন ও ইলেকট্রনের আধান বিপরীতধর্মী। এদিকে একই মৌলের বিভিন্ন পরমাণুর কয়েক প্রকারের ভর হতে পারে। ভর হলো প্রোটন ও নিউট্রনের সর্বমোট সংখ্যা। কিন্তু যে সব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান। অথচ ভর ভিন্ন হয়, সে সব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোপ বলা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্যের জন্যই আইসোটোপের সৃষ্টি। এদিকে একই মৌলের সব আউসোটোপের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম একই হয়ে থাকে। অবশ্য কতিপয় পরমাণু থেকে যে প্রতিভাসের সৃষ্টি হয় তার নাম তেজস্ক্রিয়তা। এক্ষেত্রে ইউরোনিয়াম, থোরিয়াম, প্লুটুনিয়াম, ইত্যাদি হলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ। আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে বা বিভাজন করে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকে পারমাণবিক শক্তি বলে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রমাণ করেন যে, পদার্থ ও শক্তি প্রকৃতপক্ষে অভিন্ন অর্থাৎ পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং শক্তিকে রূপান্তরিত করা যায় পদার্থ। এ সূত্রে স ভরবিশিষ্ট কোনো পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার পরিমাণ ঊ = সপ২; এক্ষেত্রে ঈ = আলোকের বেগ (৩০০০,০০০শস/ংবপ)। এ প্রেক্ষাপটে ফিশন এর কথা এসে যায়। মূলত ফিশন হলো বিভাজন বা ভাঙ্গন। একটি ভারী পরমাণুকে দ্রæতগ্রামী নিউট্রন দ্বারা ভেঙ্গে হালকা ভরের একাধিক পরমাণু ও শক্তি উৎপন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে (ঘঁপষবধৎ ঢ়ড়বিৎ ঢ়ষধহঃ)। যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয় তাদের ফিসাইল পদার্থ বা পারমাণবিক জ¦ালানী বলা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহার হয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটোপ। মজার ব্যাপার হলো যে, তেজস্ক্রিয় কিছু আইসোটোপ আছে, যেগুলো বিশেষ অবস্থায় নিজেরাই নিজেদের পরমাণুকে ভেঙ্গে তাপশক্তি বিকিরণ করে। সাধারণত ইউরেনিয়াম ২৩৫ পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন ও ১৪৩ টি নিউট্রন থাকে। এরই পরমাণুতে বাইরে থেকে একটি নিউট্রন ঢুকিয়ে দিলে আইসোটোপ ইউরেনিয়াম-২৩৬ এ পরিণত হয়। এই আইসোটোপটি নিজের অস্তিত্ব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। তাই এর পরমাণুটি ভেঙ্গে দুটি পরমাণুতে পরিণত হয়। ভেঙ্গে যাওয়ার সময় পরমাণুটি প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে দুটি অতিরিক্ত নিউট্রনকে মুক্ত করে দেয়। উক্ত মুক্ত নিউট্রন দুটি আবার ইউরেনিয়ামের নতুন দুটি পরমাণুকে ভেঙ্গে প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন করে চারটি নিউট্রনকে মুক্ত করে দেয়। এই ভাবে চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর অস্তিত্ব থাকবে। আর এই ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বলা হয় চেইন রিয়েকশন।
দ্বিতীয় পর্ব
ই) আসলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া বাতাসে পাখা ঘুরানো, সৌর বিদ্যুৎ ও ব্যাটারী চালিত রাসায়নিক বিদ্যুৎ ব্যতীত সব একই। এক্ষেত্রে জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। আর এটা পানির ¯্রােতই হোক কিম্বা তাপ দিয়ে বাষ্পই করেই হোক, তার সাহায্যে করা হয়ে থাকে। সহজ কথা হলো তাপে পানিকে বাষ্প করে টারবাইনের মাধ্যমে জেনারেটর সচল বা চালানো বা ঘুরানো হয়ে থাকে। যাহোক, আনবিক শক্তির মাধ্যমে তাপ সৃষ্টি করে কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়; সেই বিষয়টি নি¤েœ তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছি।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পারমাণবিক শক্তিকে ব্যবহার করে তাপ উৎপন্ন করা হয়। আর তাপ দিয়ে পানিকে বাষ্প করে টারবাইন এর মাধ্যমে জেনারেটরকে সচল করা হয়। যেমনটি পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হয়ে থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে চেম্বারে নিউক্লিয়ার ফিসন করা হয় বা পোড়ানো হয়, তাকে রিয়্যাকটর বলে। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রিতভাবে রিঅ্যাকশন বা বিক্রিয়া সংঘটিত করা হয়। এভাবে এই বিক্রিয়া চলার প্রাক্কালে প্রচুর পরিমাণ তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। আর নিয়ন্ত্রণ না করলে এটা চেইন রিঅ্যাকশনে পরিণত হতে পারে। এই ফিশন বা বিক্রিয়ার ফলে কিছু ভর হারিয়ে যায়। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সূত্র অনুসারে হারিয়ে যাওয়া ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ফিশন বা বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে এই শক্তির পরিমাণ ২০ কোটি ইলেকট্রন ভোল্ট-ইভি। আর ১ গ্রাম ইউ-২৩৫ এর সব কয়টি নিউক্লিয়াস ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে ফেলা হলে প্রায় ২৪ মেগাওয়াট ঘন্টা শক্তি পাওয়া যায়।
এবার দেখা যাক, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কীভাবে কাজ করে সেটার দিকে নজর দেই। এ ব্যাপারে উল্লেখ্য যে, রিয়েক্টরের মধ্যে ইউরেনিয়াম দন্ড সম্বলিত জ¦ালানি থাকে। ফিশন বা বিক্রিয়া শুরু হলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। আর বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কন্ট্রোল রড ব্যবহার করা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লীতে এই ইউরেনিয়ামে দন্ডগুলো বিশেষভাবে সজ্জিত থাকে। চুল্লীগুলো বিভিন্ন ধাপে খুব শক্ত ও প্রশস্ত কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়, যাতে তেজস্ক্রিয়তা বাইরে আসতে না পারে। ফিশনের পরিমাণ তথা চেইন রিয়েকশনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যাডমিয়াম দিয়ে নির্মিত নিয়ন্ত্রক রড ব্যবহার করা হয়। কারণ ক্যাডমিয়াম মুক্ত নিউট্রনকে সহজেই চুষে নেয়। আর চুল্লীর তাপমাত্রাকে কমাতে বা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধরে রাখতে এই নিয়ন্ত্রক পাইপ দিয়ে ইউরোনিয়াম দন্ড বা রডকে ঢেকে দেওয়া হয়। আর সম্পূর্ণ রিয়েক্টরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয় পানি। মজার ব্যাপার হলো যে, রিয়েক্টরের তাপে এই পানি বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প দিয়েই টারবাইনের সাহায্যে জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। মূলত তাপকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। এরপর এই বাষ্পকে প্রবাহিত করে টারবাইনের সাহায্যে জেনারেটর ঘুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সংগত কারণেই দক্ষতা বৃদ্ধি ও খরচ কমানোর জন্য টারবাইনে ব্যবহারের পর বাষ্পকে বায়ুমন্ডলে ছেড়ে না দিয়ে তা রিসাইকেল করা হয়। এক্ষেত্রে কন্ডেন্সার দিয়ে বাষ্পকে ঠান্ডা করে পানিতে পরিণত করা হয়। এরপর এই পানি আবার রিয়েক্টরে প্রেরণ করা হয়। অবশ্য বারংবার রিসাইকেলের ফলে কিছু পানি ঘাটতি হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে মেকাপ ট্যাংকে রাখা পানি দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা হয়।
ঈ) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে লক্ষণীয় জরুরী বিষয় হলো এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কেননা পারমাণবিক শক্তি যেমন শক্তিশালী তেমন ভয়াবহ। আর অতীতে সংঘটিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা জানি। এটা সত্য যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিয়েক্টরে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তাপশক্তি বৃদ্ধি পেয়ে নিউক্লিয়ার বোমার মতো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। কারণ পারমাণবিক বিক্রিয়া হঠাৎ করে সম্পূর্ণভাবে থামিয়ে দেয়া যায় না। কেননা কোন কারণে রিয়েক্টর বন্ধ করে দিলেও কয়েকদিন পর্যন্ত রিয়েক্টরের ভেতর উচ্চ তাপমাত্রা বিদ্যমান থাকে। তাই রিয়েক্টর বন্ধ করে দিলেও পাম্প চালিয়ে এতে পানির প্রবাহ সচল রাখা হয়। এই পানির প্রবাহ যদি কোনোভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে রিয়েক্টরের তাপমাত্রা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলশ্রæতিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা হয়। কোনো কারণে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে এর সীমনার ভেতর যে অঞ্চল থাকে এবং বিস্ফোরণস্থলের যত কাছে হবে সেখানে তেজস্ক্রিয় দূষণের মাত্রা ও প্রভাব তত বেশি হয়ে থাকে। কারণ বিস্ফোরণস্থলের কাছাকাছি এলাকায় তুলনামূলক বেশি তেজস্ক্রিয় দূষণের ফলে সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে আসা মানুষদের চুল পড়ে যায়; রক্তের শে^তকণিকা কমে যায়; থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা হ্রাস পায়; ইত্যাদি নেতিবাচক অবস্থা দেখা দেয়। আর শে^তকণিকা কমে যাওয়ায় ফ্লু জাতীয় রোগে সহজেই আক্রান্ত হয়ে পরে মানুষ। এতদ্ব্যতীত শরীরে তেজস্ক্রিয় দূষণের কারণে দূষিত অংশের কোষের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফলে টিউমার ও ক্যান্সার এর উৎপত্তি ঘটতে পারে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাথে সাথে যে বিকিরণ নির্গত হয়। সেটি মূলত মারাত্মক গামা রশ্মি, নিউট্রন এবং আয়নাইজড বস্তুকণার বিকিরণ। যতক্ষণ বিস্ফোরণের আওতায় পারমাণবিক বিক্রিয়া চলে, ততক্ষণ বিকিরণ স্থায়ী হয় বিধায় উদ্ভুত অগ্নিকুÐের দ্বিগুণ ব্যাসের বৃত্তাকার অংশে প্রাণঘাতী এই মাত্রাতিরিক্ত বিকিরণ আঘাত হেনে থাকে। আর এই বিকিরণে আক্রান্ত মানুষদের কয়েক ঘণ্টা থেকে ৭ দিনের মধ্যে অকাল মৃত্যু হয়।
তৃতীয় পর্ব
উ) এবার চলুন আমাদের দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কিছু কথা বলি। উল্লেখ্য যে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন শেষ পর্যায়ে। হয়তো আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সংযোজনপূর্বক বিদ্যু সরবরাহ শুরু হবে। এই সুবাদে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বিশে^ ৩৩তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এটি রাশিয়ার রোমাটস স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত হচ্ছে। সংগত কারণেই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গোড়ার ইতিবৃত্ত জানা আবশ্যক বলে মনে করি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান আমলের ১৯৬১ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৬২ সালে ২০০ একর জমি (পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ) এবং ৩২ একর জমি (আবাসিক এলাকা) এর জন্য অধিকরণ করা হয়। ১৯৬৮ সালে ভূমি-উন্নয়ন, সাবস্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের আংশিক কাজ করা হলেও দুভার্গ্যভাবে ১৯৬৯ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়। তৎপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই একই স্থানে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে দু:খজনক ঘটনাসহ কয়েক বছর কেটে যায়। ১৯৭৭ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার পেপসি সোফরাটস প্রতিষ্ঠানকে ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য নিয়োগ দেয়। এক্ষেত্রে ১৯৮৭ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানি কর্তৃক দ্বিতীয়বার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। তখন প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি যৌক্তিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ স্টাডিতে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এদিকে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া কর্তৃক ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এর মধ্যে সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ নিউক্লিযার পাওয়ার অ্যাকশান প্লান-২০০০ অনুমোদিত হয়। ইতোমধ্যে অর্থাৎ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প জোর বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। ২০১০ সালে ১ মে বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়া ফেডারেশন সরকারের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়। ২০১০ সালের ২১ মে বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থার বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর হয়। ১০ নভেম্বর ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে রূপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২ অক্টোবর ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের সাংগঠনিক কাজ উদ্বোধন করেন। ৪ নভেম্বর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অনুকূলে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের নকশা ও নির্মাণ লাইসেন্স দেয়া হয়। ৩০ নভেম্বর ২০১৭ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১নং ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য যে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব নিয়ম মানা হয় এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করা হয়। রিঅ্যাক্টের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রভৃতি কাজে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্বাচিত পারমাণবিক চুল্লিতে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য অনুসৃত হয়। যেমন- ফুয়েল পেলেট, ফুয়েল ক্লাডিং, রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল, প্রথম কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং এবং দ্বিতীয় কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং। আর ২০২৪ সালের মধ্যেই প্রকল্পের দুটি ইউনিটের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ দুটিতে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। আর এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি এবং প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত। একক প্রকল্প হিসেবে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রকল্প। এই প্রকল্প পরিবেশবান্ধব ও আর্থিকভাবে লাভজনক। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার পর এই প্রকল্পের স্থায়িত্ব হবে প্রায় ১০০ বছর।
ঋ) কথাই বলে সাবধানের মার নেই। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে এতটুকু গাফিলতি ও ত্রæটির জন্যে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে। এদিকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুঘর্টনার কারণে উদ্ভুত ক্ষয় ক্ষতি ও বিপর্যয় পরিমাপের জন্যে যে স্কেল ব্যবহার করা হয় তাকে ওঘঊঝ বলা হয়ে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুকিপূর্ণ হলেও বিশে^র উত্তরোত্তর শক্তি (ঊহবৎমু) এর চাহিদার প্রেক্ষিতে দিন দিন এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। বস্তুত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাথমিক স্থাপনার খরচ বেশি হলেও পরবর্তীতে ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। তাছাড়া এর দীর্ঘস্থায়িত্ব তো প্রশ্নাতীত। যাহোক, বর্তমানে এ বিশে^র ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। আর এই বিদ্যুতের পরিমাণ সারাবিশে^ উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় শতকরা বার ভাগ। এদিকে আরও ১৪টি দেশে ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এতদ্ব্যতীত ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো কিছু দেশে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে, যার মধ্যে আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ রয়েছে, যা কম কথা নয়?