(নাজমা আক্তার বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। তিনি ১৯৫৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।শিল্পী হিসেবে বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশে সংবর্ধনা পেয়ে তিনি শিল্প-বোদ্ধাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।এছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছেন এবং গ্রীস, ফ্রান্স, নেপাল, ভুটান, ভারত প্রভৃতি দেশের আন্তর্জাতিক পেইন্টিং সিম্পোজিয়ামে যোগ দিয়েছেন।তাঁর অর্জিত পুরস্কার সমূহ হলো- শিল্পাচার্য স্বর্ণপদক, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্মৃতি পরিষদ (২০১৮), কবি আবদুল হাই মাশরেকী স্বর্ণপদক (২০১৭), আন্তর্জাতিক মিক্সড মিডিয়া প্রদর্শনী, বুলগেরিয়া, সোফিয়া (২০১৬), রশীদ চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, বার্ষিক প্রদর্শনী, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৯), মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার (১৯৮১), বার্ষিক প্রদর্শনী, তৎকালীন ঢাকা সরকারি আর্ট কলেজ(১৯৮২)।২০২০ সালে কলকাতার প্রখ্যাত চিত্র সমালোচক মৃণাল ঘোষ ‘নাজমা আক্তার-এর ছবি : মূর্তের অমূর্ত রূপ’ রচনা করে তাঁর শিল্পকর্মের বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন।)
সবাইকে শুভেচ্ছা। আমি শিল্পী নাজমা আক্তার। আমার শিল্প শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি শুরু করি ঢাকা আর্ট কলেজে, বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। আমার সাবজেক্ট ছিল প্রাচ্যকলা। প্রাচ্যকলায় বি.এফ.এ এবং এম.এফ.এ পাস করেছি এবং প্রাচ্য রীতিতেই আমি ছবি এঁকেছি অনেকদিন।২০০২ সালের পর আমি প্রাচ্য রীতি থেকে বেরিয়ে এসেছি।পাস করার পর আমি নিয়মিত ছবি আঁকতে পারিনি। অনেক বছর গ্যাপ গিয়েছিল।
ছবি আঁকা আসলে খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়, এটি একটি সাধনার বিষয়।সাধনা ছাড়া কখনো শিল্পচর্চা হয় না। আমার যেহেতু সংসার ছিল, ছোট বাচ্চা ছিল, আমাকে সেখানে অনেক সময় দিতে হতো।আর অবসর সময়ে আমি কখনো ছবি আঁকতে চাইনি। অবসর সময় আসলে ছবি আঁকার সময় নয়।আমি মনে করি ছবি আঁকাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় নিয়েই ছবি আঁকতে হবে।তবে আমি মাঝে-মধ্যে ২/১ টা ছবি এঁকেছি।বিভিন্ন Exhibition -এ অংশগ্রহণ করেছি এবং শিল্পীর খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছিলাম। আর ২০০৩ সাল থেকে আমার ছবি আঁকা নতুন ভাবে শুরু করি।
তখন আমার ছেলের উপর দায়িত্বটা খানিকটা কমে গেছে।বরং তখন ছেলেই আমার দায়িত্ব নিতে শুরু করেছে, আমি তার অনুপ্রেরণায় এবং তার ইচ্ছায় আবার নতুন করে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করি। যেহেতু আমি চাকুরি করি- সে সময়টুকু বাদ দিয়ে প্রতিদিন ৮/১০/১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ছবি এঁকেছি।
সেসময় আমি আমার বিষয় ও ধারা পরিবর্তন করে ফেলি।প্রাচ্যরীতি ছেড়ে বিমূর্ত ধারায় ছবি আঁকা শুরু করি। কারণ শিল্পীরা তো একজায়গায় থেমে থাকে না।তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে পছন্দ করে।আমিও সেই রকমই। ভাবলাম প্রাচ্যরীতিতে তো অনেকদিনই কাজ করেছি এবার একটু অন্যভাবে কাজ করি। সেই অন্যভাবে কাজ করতে গিয়ে যাদের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি, বিমূর্ত ধারায় বাংলাদেশে তাঁরা কাজ করছেন। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়া এবং শিল্পী মনিরুল ইসলাম অন্যতম। শিল্পী মনিরুল ইসলামের স্টুডিওতে গিয়ে তাঁর কাজ দেখেছি এবং তাঁর অনেক প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
মূলত তাঁর কাজ দেখেই আসলে আমি বেশি অনুপ্রাণিত হই।বিমূর্ত ধারায় কাজ করার জন্য তিনিই আমাকে উৎসাহ প্রদান করেন। আমি চেষ্টা করতে থাকি এবং শিল্পচর্চায় নিয়োজিত হই।নিজেকে একটা অবস্থানে আনার চেষ্টা করি। সেজন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
বর্তমানে আমি যে ছবি আঁকি সে ছবিগুলোর বিষয় এবং যা কিছু আমি করি সব আমার অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত। আমি আমার অবচেতন জগৎটাকে চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করি। শিল্প তো আসলে এক ধরনের উপস্থাপনা, নিজেকে মেলে ধরা। সেই কাজটা আমি আমার ছবির মাধ্যমে করি। যদিও এই কাজটা সহজ নয়।কারণ নিজের মনের গহীনে কি রয়েছে সেটা উদ্ধার করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব, তবু নিজেকে জানার চেষ্টা সব মানুষের মধ্যেই থাকে, আমার মধ্যেও আছে। শিল্পীদের মধ্যে এই খোঁজাটাই তাদের শিল্পকর্মের অবয়বে ধরা দেয়।
আমি আমার ছবিতে দুটো জিনিস খোঁজার চেষ্টা করেছি- সেগুলো হলো স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষা। কারণ কাল প্রবাহে অতীত স্মৃতি হয়ে জমা থাকে আর ভবিষ্যৎ নানা আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। এই দুই কালকে ধরতে চাওয়ার মধ্যেই শিল্পীর বর্তমান। আমি মনে করি দৈনন্দিন জীবনে যেটুকু অভিজ্ঞতা সেগুলোই স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়। আমার ছবিতে ওই অভিজ্ঞতার স্মৃতিগুলো নতুন করে ফিরে আসে। পুরাতনের মধ্য দিয়ে আমি নতুনকে খুঁজে পাই, তখন আমি নতুনভাবে উৎসাহ বোধ করি।
রসবোদ্ধারা লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, আমার বিমূর্ত শিল্পকর্মগুলোর প্রত্যেকটা আলাদা। ছবিগুলো প্রত্যেকটা একটার মতো আরেকটা নয়।কারণ অভিজ্ঞতা আমাকে সবসময় নতুন কিছু দেয়। আমি মনে করি শিল্প কখনো দুটি হয় না, একটিই হয়। যার দুটো শিল্পকর্ম এক হয়; তার অভিজ্ঞতা তাকে নতুন কিছু দিচ্ছে না। সোজা কথা তিনি পারছেন না বলে রিপিট করছেন। আমি আমার কোনো ছবি রিপিট করি না। কারণ আমার নতুন কিছু আঁকতে ভালো লাগে।
আর বিমূর্ত শিল্পে অনেক সময় কোনো মূর্ত চিত্রকল্পের খোঁজ না মিললেও নানা রঙ ও রেখায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটে। স্মৃতি হয়ে যেসব ছবি মনে জমা থাকে সেগুলোকেই নানা উপায়ে ভেঙে ভেঙে বিমূর্তের নানা আকারে আবির্ভাব ঘটে। অন্যদিকে আকাঙ্ক্ষাও অনেকটা বিমূর্ত বিষয়। তাই মনের এই দুটি সঞ্চয়কে ক্যানভাসে তুলে আনার চেষ্টা করি। আর শিল্পী যখন ছবি আঁকেন তাদের একটা দর্শন থাকে, সেই দর্শন থেকেই তারা চিত্র নির্মাণ করেন। অন্তত আমি তাই মনে করি।আবার অনেক সময় নির্মিত চিত্রকলা থেকেই দর্শকরাও খুঁজে নেন দর্শন। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সবশেষে লালনের একটি গানের কথা স্মরণ করতে চাই।লালন তাঁর একটি গানে বলেছিলেন- ‘‘মন এমন আজব কারখানা সেথায় ডুবলে পরে রতন পাবি- ভাসলে পরে পাবি না।’’ আমার চিত্রকর্মের মাধ্যমে আমি কতটুকু ডুবতে পেরেছি, কতটুকু ভেসে আছি সেটা বিচার করার ভার দর্শকের উপরই থাকল। দর্শকরাই বলতে পারবেন ভালো। আর এই ছবি আঁকার জন্য আমি বিভিন্ন প্রদর্শনী করেছি। আমি মোট ১০টি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৪টি বাংলাদেশে আর ৬ টি দেশের বাইরে করেছি। ১ টি মালয়েশিয়াতে, কলকাতায় ২ টি, ত্রিপুরায় ১ টি, বার্লিনে ১ টি, আর একটা আমি লন্ডনে আমার শেষ Exhibition করেছি ২০১৫ তে। তারপর আমি অনেক গ্রুপ Exhibition-এ অংশগ্রহণ করেছি। একক চিত্র প্রদর্শনী করাটা আসলে অনেক কষ্টের। যেটা বলা দরকার সেটা হলো, আমরা এখন একটি Exhibition করতে যাচ্ছি। কোভিট-১৯ এখন সারা বিশ্বেই মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে।সেজন্য শিল্পীরা বসে নেই, শিল্পীরা ছবি আঁকছেন। Exhibition করছেন। Exhibition- এর কৌশলটা শুধু বদলে গেছে। এখন আমাদের যে Exhibition টা হবে সেটা অনলাইনে হবে। Art Family সেটা আয়োজন করেছে।
আমি Art Family এর একজন মেম্বার।গত ১২ বছর ধরে Art Family এর সঙ্গে যুক্ত আছি। আমাদের অনলাইনে এই Exhibition টা হবে।আমি আশা করছি দর্শকরা অনলাইনে সেই Exhibition টা দেখবেন। আর এতোক্ষণ আমার কথা যারা শুনেছেন, তাদের আমি আবারও শুভেচ্ছা জানাই এবং Art Family- এর যারা আয়োজক তাদেরকেও আমার অভিনন্দন।
(নাজমা আক্তার, চিত্রশিল্পী)