।। এনআরবি ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেস্ক ।।
এনআরবি ওয়ার্ল্ডওয়াইড আয়োজিত ১২ ও ১৩ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস স্কয়ার এবং জ্যাকসন হাইটস ডাইভার্সিটি প্লাজায় অনুষ্ঠিত সহস্র কণ্ঠে বিশ্ববাঙালির ১৪৩২ বাংলা বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলা উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে ‘‘বাংলা নববর্ষ স্মারকগ্রন্থ ১৪৩২’’। সদ্য প্রয়াত সংস্কৃতি-সাধক প্রফেসর ড. সন্জীদা খাতুনকে উৎসর্গিত এই প্রকাশনার সম্পাদনা পর্ষদে দায়িত্বে ছিলেন- বিশ্বজিত সাহা(উপদেষ্টা সম্পাদক), নূরুল বাতেন(প্রধান সম্পাদক), ড. মিল্টন বিশ্বাস(সম্পাদক) এবং ফারুক আহমেদ (নির্বাহী সম্পাদক)। শিল্পী আব্দুর শাকুর শাহের প্রচ্ছদ, মাহবুবুল হকের নকশা ও দেওয়ান আতিকুর রহমানের শিল্প নির্দেশনায় এনআরবি ওয়ার্ল্ডওয়াইড প্রকাশিত দৃষ্টিনন্দন স্মারকগ্রন্থের লেখকবৃন্দ নিউইয়র্ক, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং লন্ডন ও সিডনি শহরের বাসিন্দা। উল্লেখ্য, গ্রন্থটি একইসঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে নিউইয়র্ক, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে।
বাংলা বর্ষবরণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি রেজুলেশন বাংলা ও ইংরেজিতে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ‘‘বাংলা নববর্ষ স্মারকগ্রন্থ ১৪৩২’’ অবয়ব উন্মোচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আলবেনিতে গভর্নর অফিস বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় এই উৎসবকে ২৮ এপ্রিল উদযাপন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের অনুরোধে সিনেটর লুইস সেপুলভেদার ১৫ জানুয়ারি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গরাজ্যের আইনসভার অধিবেশনে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি আইনপ্রণেতারা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গভর্নর ক্যাথি হোকুল ২৩৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করেন। ঘোষণাটি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেট-ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়, ১৪ এপ্রিল, অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখকে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি হিসেবে এবং এই রাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন কমিউনিটির মধ্যে সম্প্রীতি দৃঢ় করার লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। সিনেট রেজুলেশনে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড-এর সভাপতি বিশ্বজিত সাহা প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ নিয়ে বলা হয়েছে- For three decades, Muktadhara Foundation, a New York based organization dedicated to the promotion of Bengali culture has celebrated it history and literature by hosting Bangla Festival and Book Fair which has been attended by almost all leading litterateurs of contemporary times; ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের আন্তর্জাতিক মহিমা অর্জনে নেপথ্যের কারিগর এবং টাইমস স্কয়ারে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মূল নেতৃত্বে থাকা বিশ্বজিত সাহার নিরন্তর তাগাদা ও পরামর্শে স্মারকগ্রন্থটি আলোর মুখ দেখেছে।
সূচিপত্রের দিকে তাকালে পাঠকরা দেখবেন স্বীকৃতি অর্জন ও গৌরবের নববর্ষ লেখকদের লেখনির মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষত নিউইয়র্ক সিনেটে পাস হওয়া রেজুলেশনের সূত্রে বেশ কয়েকটি লেখা বাঙালির এই উৎসবকে মহিমান্বিত করেছে। আগেই বলা হয়েছে, ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ স্মারকগ্রন্থে’র সূচনা হয়েছে নিউইয়র্ক সিনেটে পাস হওয়া রেজুলেশনটি ইংরেজি ও বাংলা (অনুবাদ) হুবহু উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটে ১৪ এপ্রিল ‘বাংলা নববর্ষ দিবস’ উদযাপনের প্রস্তাব পাসের ঘটনা নিয়ে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে একাধিক লেখা। শিরোনাম ও লেখকবৃন্দ হলেন- ‘নিউইয়র্কে বাংলা বর্ষবরণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি’-বিশ্বজিত সাহা, ‘নববর্ষ: বাঙালি জতিসত্তার উদযাপন’-সারওয়ার আলী, ‘নববর্ষ : মঙ্গলময় নতুন বছর’- অমর মিত্র, ‘নিউইয়র্কে বাংলা নববর্ষ : প্রবাস-মাটির গভীরে’-সৌমিত্র শেখর, ‘নব আনন্দে জাগো, নব রবি কিরণে’-অজয় দাশগুপ্ত, ‘বাংলা নববর্ষ’-বাঙালি চেতনার নতুন সোপান’-ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ‘অভিবাসীদের বৈশাখী মেলা ও নববর্ষ: বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রগমন’-হাকিম আরিফ এবং ‘মার্কিন মুলুকে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সরকারি স্বীকৃতি আনন্দের শরিকানা বোধ’-মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একইসঙ্গে নিউইয়র্কে উদযাপিত বর্ষবরণকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন- হাসান ফেরদৌস ও শিবলী সাদেক। লেখা দু’টির শিরোনাম হলো-‘টাইমস স্কয়ারে বাংলাদেশ, বাঙালির নববর্ষ’ এবং ‘টাইমস স্কয়ারে বাঙালির প্রাণের উৎসব’। প্রাণবন্ত গদ্য নিয়ে আরো যুক্ত হয়েছেন মহীতোষ তালুকদার তাপস, যিনি ‘টাইমস স্কয়ারে বাংলা বর্ষবরণ ১৪৩২ উদযাপন’ কমিটির সংগীত পরিচালক। এছাড়া শুভেচ্ছা দূত লায়লা হাসান ও লুতফুন নাহার লতার লেখাও উৎসাহ জাগানিয়া। মূলত আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা ১৪ এপ্রিল গৌরবের, অহঙ্কারের- এই থিমের উপর লিখেছেন এঁরা সকলেই। বলাবাহুল্য, হাসান ফেরদৌস, শিবলী সাদিক, বিশ্বজিত সাহা, মহীতোষ তালুকদার তাপস, হাকিম আরিফ টাইমস স্কয়ারে উদযাপিত নববর্ষ নিয়ে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। অন্যদিকে সৌমিত্র শেখর, আসাদুজ্জামান, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, লায়লা হাসান, লুতফুন নাহার লতা লিখেছেন গৌরবান্বিত ১৪ এপ্রিলের অর্জন নিয়ে; বিশেষত সিনেট রেজুলেশনকে ফোকাস করে। এছাড়া বাংলা নববর্ষের ‘ভেতর-বাহির’ অনুসন্ধানে নিবিষ্ট থেকেছেন বেশ কয়েকজন। যেমন, আবুল কাসেম ফজলুল হকের লেখা ‘বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য’ ।
কোনো কোনো লেখায় স্মৃতিময় হয়ে উঠেছে নববর্ষ উদযাপনের বর্ণনা। রামেন্দু মজুমদার, সরওয়ার আলী, দীপেশ চক্রবর্তী, অমর মিত্র, পবিত্র সরকার- প্রমুখ স্বদেশ ভূমিতে উদযাপনের মধুর বিবরণ পেশ করেছেন। সাব-অল্টার্ন তাত্ত্বিক দীপেশ চক্রবর্তী নিঃসন্দেহে প্রাণের টানে ও বাংলা নববর্ষের প্রতি অনুরাগে শত ব্যস্ততার মধ্যেও লেখা দিয়েছেন ‘বাংলা নববর্ষ’ শিরোনামে।
প্রবাসে অবস্থানের কারণে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব নিয়ে নিজের অনুভূতি ও প্রত্যাশা আত্মপ্রকাশ করেছে অজয় দাশগুপ্ত, শামীম আজাদ, মনিজ রহমান, সেলিম জাহানের লেখায়। শিশির ভট্টাচার্য ও অদিতি ফাল্গুনী ইতিহাসের আলোকে বাংলা নববর্ষকে বিবৃত করেছেন। অন্তত দু’টি লেখায় নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি যাপনের বিশ্লেষণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অভিব্যক্ত। লেখকবৃন্দ হলেন-রফিকউল্লাহ খান এবং ইমতিয়ার শামীম। হাসনাত আবদুল হাই কিছুটা সেই পথেই হেঁটেছেন।
গ্রন্থভুক্ত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ নিঃসন্দেহে ভিন্নমাত্রার। রয়েছে অন্য সকলের লেখা থেকে আলাদা অভিদ্যোতনা। তাঁর পর্যবেক্ষণ ও প্রজ্ঞা মিশ্রিত বয়ান সত্যিই অনন্য। সরল গদ্যের কারুকার্যে গভীর কথা আছে তাঁর লেখায়। নির্মলেন্দু গুণের ক্ষুদ্র পরিসরের লেখা আত্মকথনমথিত; নববর্ষের সঙ্গে তাঁর জন্মদিনের আলিঙ্গনে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। মফিদুল হকের গদ্যে সাংস্কৃতিক জাগরণে নববর্ষ পালনের গুরুত্ব প্রকাশিত। আন্দালিব রাশদী কিছু কৌতুক হাস্যে বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করে তুলেছেন। তেলবাজের মহিমা অঙ্কনে তাঁর অসাধারণত্ব লক্ষণীয়। ইতিহাস ঐতিহ্যের রেফারেন্সগুলো চমকপ্রদ। কবি বিমল গুহ তাঁর লেখায় নববর্ষ যে বাঙালির উৎসব তার স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন।
‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ স্মারকগ্রন্থে’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো- ‘‘ক্রোড়পত্র : সন্জীদা খাতুন’’। ২৫ মার্চ তাঁর মহাপ্রয়াণের পর বিশ্বজিৎ ঘোষের একটি লেখা এবং ‘সনজীদা খাতুন : এক রবীন্দ্র তপস্বীর জীবন রেখা’ শীর্ষক সংকলন দিয়ে সাজানো হয়েছে এই ক্রোড়পত্রটি। সন্জীদা খাতুনের ‘বাঙালির অন্তরের নববর্ষ’ প্রবন্ধটিও এ অংশে সংযুক্ত। এখানে নববর্ষ উদযাপনের ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ। ‘ছায়ানট’কেও এই লেখায় খুঁজে পাওয়া যাবে। আগেই বলা হয়েছে, ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ স্মারকগ্রন্থ’ উৎসর্গও করা হয়েছে মহান এই ব্যক্তিত্বের অবদানকে স্মরণে রেখে।
শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় এবং নিউইয়র্কের লেখক অভীক সানোয়ার রহমান। ভিডিও বার্তায় কথা বলেছেন যথাক্রমে- অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, চেয়ারম্যান, বাংলা একাডেমি। গৌতম দে, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কলকাতা। অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমদ, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। স্বপ্নময় চক্রবর্তী, কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, কথাসাহিত্যিক, পশ্চিমবঙ্গ। রথীন্দ্রনাথ রায়, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী, পশ্চিমবঙ্গ। বিশ্বজিত সাহা, মহীতোষ তালুকদার তাপস, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, ড. আসাদুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লায়লা হাসান, কবি লুতফুন নাহার লতা, কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ।
বার্তাগুলোর মধ্যে রথীন্দ্রনাথ রায়, বিশ্বজিত সাহা, মহীতোষ তালুকদার তাপস, লায়লা হাসান ও কবি লুতফুন নাহার লতা ‘টাইমস স্কয়ারে বাংলা বর্ষবরণ ১৪৩২ উদযাপন’ কমিটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বেশ কয়েকজনের বক্তব্যের শ্রুতিলিখন লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের পরিশ্রমলব্ধ কথামালা সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি প্রাণের অফুরন্ত আবেগে নিজস্ব কথনভঙ্গিতে নববর্ষের তাৎপর্যকে তুলে ধরেছেন।
বিষয়বস্তু, অঙ্গসজ্জা ও পরিপাট্যে ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ স্মারকগ্রন্থ’ অনন্য প্রকাশনা। সমৃদ্ধ লেখাগুলোয় নববর্ষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উদযাপনের অনুপুঙ্খ বিবরণ দৃশ্যমান। অলঙ্করণ ও আলোচিত্রসমূহও বিষয় কেন্দ্রিক। সব মিলে স্মারক গ্রন্থটি টাইমস স্কয়ার ও জ্যাকসন হাইটস উৎসবের অন্যতম স্মারক হিসেবে পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে। গ্রন্থটি ইতিহাসের স্মারক হিসেবেও সংগ্রহ করা যেতে পারে।