৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার, রাত ১১:৩৪
নোটিশ :
Wellcome to our website...

কড়ির সাত-কাহন

রিপোর্টার
মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৪ অপরাহ্ন

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

ক) ছোটবেলায় কড়ি (Courie) নিয়ে অনেক খেলেছি। তখন দাদী-নানীদের কাছ থেকে শুনেছি যে, এককালে কড়ি নাকি টাকার মতো বিনিময়ের মাধ্যম ছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এ যাবৎ ছোট বড় মিলে ২৭টি সভ্যতার উদ্ভব হয়েছে। এই সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হচ্ছে কৃষি বিপ্লব। আর কৃষি বিপ্লবকে বলা হয় মানব ইতিহাসের প্রথম বিপ্লব। আবার এটিকে নবোপলীয় বিপ্লবও বলা হয়ে থাকে। আর এই নবোপলীয় যুগেই কৃষকের সাথে জেলে, পশু-পাখী শিকারী, কামার, কুমার, মিস্ত্রী, কারিগর, ইত্যাদির বিনিময় প্রথা চালু হয়। অবশ্য কৃষকের হাতে উদ্ধৃত্ত শষ্য থাকায় এবং একে অন্যের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পেশার লোকদের পরস্পর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে লেনদেন তথা বিনিময় প্রথা চালু হয়। আর এই বিনিময় পদ্ধতি ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হয়, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে এই ধরনের পণ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। কারণ কোন পেশার লোকের চাহিদাকৃত পণ্যের ব্যাপারে তাদের পন্য বিনিময় করতে চাইলে, তা অন্য পেশার লোকের সেক্ষেত্রে চাহিদা নাও থাকতে পারে। তখন বাস্তবতার তাগিদে বিশেষ ধাতু বা মূল্যবান পাথর বা অন্য কোন জিনিস বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে উঠে আসে। যতদূর জানা যায় এই মাধ্যম নবোপলীয় যুগেই শুরু হয়। তখন বিনিময় মাধ্যমে হিসেবে জীবের খোলা হিসেবে কড়ি এবং ম্যালাকাইটের কথা জানা যায়। (আর ম্যালাকাইট হলো এক রকমের আকরিক তামা, রজন, ল্যাপস লাজুলি ও অবসিডিয়ান, যা কাঁচের মতো দেখতে এক ধরনের পদার্থ)। শুধু তাই নয়, বিনিময় মাধ্যম হিসেবে এর সাথে যোগ হয় পদ্মরাগ মনি ও নীলকান্ত মনি সহ অন্যান্য মূল্যবান পাথর। অবশ্য এ সব কিছুর নিজস্বতার আড়ালে অন্তমুর্খী মূল্যমান আছে বিধায় সেই যুগে এটি বিবেচনার মধ্য আনা হতো। এক্ষেত্রে উদহারণ হিসেবে উল্লেখ্য যে, মিশরীয়রা ম্যালাকাইট চোখে লাগানোর সুর্মা হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও আত্মার আলৌকিকতার উপর বিশ্বাস করতো। এ সূত্র ধরে ম্যালাইকাইট গুড়া করা শিলটিকে জীবজন্তুর মূর্তির মতো তৈরী করতো। তাছাড়া জীবের খোসা বা খোলা হিসেবে কড়ি ব্যবহারও প্রণিধানযোগ্য। এক্ষেত্রে মনে করা হতো কড়ির অলৌকিক শক্তি আছে বিধায় এটি ধারণ করলে জমি সুফলা সহ অন্যান্য কাজে সফল হওয়া যায়। সেই সময় এশিয়া ও আফ্রিকাসহ প্রায় অঞ্চলে মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন বেশ গুরুত্ব পায় এবং একই সাথে কালের পরিক্রমায় স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, ব্রোঞ্জ, ইত্যাদি ধাতুসহ মূল্যবান পাথরও একই ভাবে বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে যোগ হতে থাকে। অবশ্য এই বিনিময় মাধ্যম খ্রষ্টাপূর্বাব্দ ৪০০০ থেকে ৩০০০ খৃষ্টাপূর্বাব্দ বলে অনুমান করা হয়। সময়ের পরিক্রমার নানা সভ্যতার ক্রমবিকাশের মাধ্যমে সবকিছু পরিবর্তনের সাথে সাথে বিনিময় মাধ্যমও পরিবর্তন হতে থাকে। এই সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সোনা ও রূপার বাট বিনিময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো। এর মধ্যে হাজার হাজার বছর পার হয়ে যায় রাজতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই সময়ে বিনিময়ের ব্যাপারে উদ্ভুত নানা সমস্যা নিরসনপূর্বক ধাতব মুদ্রার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। উল্লেখ্য যে, গ্রীক বীর আলেকজান্ডার কর্তৃক পারস্য সম্রাজ্য দখলের মধ্যে দিয়ে পারস্যে ও গ্রীক বংশীয় সভ্যতার সংমিশ্রণে গঠিত শংকর সভ্যতার সৃষ্টি হয়। আর এটি পূর্ববর্তী মিশর, ব্যাবিলনীয়, কালাডীয় এসেরীয়, লিডীয় ও উত্তর প্যালেস্টাইন সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ সময় লিডীয়দের মুদ্রার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সংযোজনের মাধ্যমে মুদ্রা ব্যবস্থা সংস্কার সাধন করা হয়, যা পরবর্তীকালে পশ্চিম এশিয়া সহ বিভিন্ন স্থানে গৃহীত হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, কালের পরিক্রমায় একই সাথে একের উপর এক আবিষ্কার ও পদ্ধতি প্রবতির্ত হতে থাকে। তখন সিন্ধু সভ্যতার ওজন ছিল ১৬ ভিত্তিক, যেমন- ১৬, ৬৪, ১৬০, ৩২০, ৬৪০, ইত্যাদি। আমাদের দেশে দশমিক পদ্ধতি আসার আগে এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ আনায় ১ টাকা ব্যবহৃত হতো। যতদূর জানা যায়, ব্রিটিশ আমলের আগ পর্যন্ত ধাতব মুদ্রার সাথে সাথে কড়ির প্রচলন ছিল, যা মঙ্গল কাব্যতে বিশেষভাবে উল্লেখ আছে। যাহোক, তারপর কড়ির ব্যবহার কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অর্থনীতির “গ্রেসাম ল” অনেকাংশে প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান হয়। তৎপর অর্থনৈতিক দিয়ে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে বিহিত মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণমান এবং কাগজী মুদ্রা এর বিষয়টি প্রনিধানযোগ্য। এখন আর স্বর্ণমান নেই। কেবল কাগজী মুদ্রার প্রচলন বিশেষ জায়গা জুরে বসেছে। বর্তমান বিশে^ ছোট বড় মিলে ২৩০ দেশের কারেন্সী হিসেবে ডলার, পাউন্ড, রুপি, রিয়াল, দিনার, মার্ক, ইয়েন, টাকা, ইত্যাদির ন্যায় ১৮০টি মুদ্রা প্রচলিত আছে। সেই কড়ির আর দেখা নেই। এদিকে ভার্চুয়াল মুদ্রার আওতায় অল্ট কয়েন, বিটকয়েন, রিপল, ড্যাশ, লাইট কয়েন, মোনেরো, জিক্যাশ, প্রভৃতি অদৃশ্যমান সাংকেতিক মুদ্রারও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর সপক্ষে প্রথম দিক দিয়ে নেতিবাচক কথা বলা হলেও বর্তমানে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
খ) সম্মানিত পাঠকবর্গ হয়তো ভাবছেন, কড়ির কথা বলতে যেয়ে এ সব অপ্রাসঙ্গিক কথার অবতারনার আবশ্যকতা আছে কি? হ্যাঁ, আপনাদের চিন্তাধারা কিছুটা ঠিক হলেও পুরোপুরি নয়। কেননা আদিমকালে বিনিময় ব্যবস্থা শুরু হওয়ার অব্যবহিত পর লেনদেনের ক্ষেত্রে ধাতব পদার্থ ও মূল্যবান পাথরের সাথে কড়ির প্রচলন বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য নানা প্রসঙ্গ টেনে আনতে হয়েছে। যাহোক, কড়ি হচ্ছে শামুকেরই এক ভিন্ন প্রজাতির জীব। তবে কড়ি বলতে এই প্রাণীর দেহের শক্ত আবরণ বা খোলকে বুঝায়। এটি ছোট হলেও দেখতে উজ্জল এবং কিছুটা মুক্তার রং বলে প্রতিভাত হয়ে থাকে। তাছাড়া এটি চকচকে মসৃণ ও দৃষ্টিনন্দন; অনেকটা পোর্সালিনের ন্যায় চিত্তাকর্ষক। বস্তুত পোর্সালিন শব্দটিও এসেছে অতি প্রাচীন ইতালীয় ভাষার পোর্সিলানা থেকে, যাব অর্থ হলো কড়ি। যাহোক, এই কড়ি দেখতে পায় ডিম্বাকৃতির ন্যায়। আর একটি দিক চ্যাপ্টা এবং এই দিকে সারি সারি খাঁচ কাটা মুখ থাকে। সাধারণত এই কড়ি ৫ সেমি. থেকে ১৫ সে.মি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অনেক সময় কড়ির গায়ে দৃষ্টিনন্দন নকশাও থাকে। যতদূর তথ্যাদি নিয়েছি, তাতে জানা যায় যে কড়ি মালদ্বীপের সাগর থেকে আহৃত হতো এবং এখনও হয়ে থাকে। অতীতে এই কড়ির খোল বিনিময়ের মাধ্যমের আওতায় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি। আর মুদ্রা ছাড়াও কড়ি গহনা ও আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো, যা এখনও অব্যাহত আছে। অনেক সময় জুয়া খেলায়ও কড়ি ব্যবহার হতে দেখা যায়। শুধু তাই নয় কড়ি শব্দটি গানের ভূবনেও স্থান করে নিয়েছে। কেননা এটি মধ্যম ও পঞ্চমের মধ্যবর্তী সুর হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে। তাছাড়া কড়ি নিয়ে অনেক গানও রচিত হয়েছে। প্রাচীন তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায় যে, মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার প্রথমে আফ্রিকার দাস ব্যবসায় শুরু হয়। তৎপর এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সভাবতই একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মুদ্রা হিসেবে কড়ির শ্রেণিভিত্তিক মূল্যমান কি রকম ছিল? এ ব্যাপারে সম্যক ধারণার জন্য কড়ির শ্রেণিগত মূল্যমান নিয়ে হিসাবের একটি ছক নিয়ে তুলে ধরা হলো-

৪ কড়ি = ১ গন্ডা ২০ গন্ডা = ১ পন
৪ পন = ১ আনা ৪ আনা = ১ কাহন
৪ কাহন = ১ টাকা (অর্থাৎ ২৮৮৮০ কড়ি)

কড়ি -ফাইল ছবি

আমাদের দেশে অতীতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পাশাপাশি স্বল্প মূল্যমানের আওতায় কড়ির প্রচলন ছিল। মোঘল ও সুলতানি আমলে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিনিময়ের ক্ষেত্রে নয়। সরকারী কর প্রদানের ক্ষেত্রেও কড়ি ব্যবহার করা হতো। এদিকে বিজ্ঞানসম্মত না হলেও কথিত আছে যে, মন্ত্র বলে কড়ি নাকি অলৌকিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে সাপের মাথায় বা উড়ে লক্ষ্য বস্তু চিহ্নিত করে থাকে। তাছাড়া তাবিজ হিসেবে ব্যবহারের রীতি এখনও গ্রাম বাংলায় প্রচলিত আছে। এতদ্ব্যতীত অনেকে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কড়ি এখনও শো-কেসে সাজিয়ে রাখে।
গ) পরিশেষে সম্মানিত পাঠকবর্গের এই মর্মে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, সেই কড়ির যুগ অনেক আগেই যবনিকা হয়েছে। অথচ কড়ি নামটি এখন আমাদের কথোপকথনসহ সাহিত্য ও কালচারে প্রচলিত আছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, অর্থাভাব বুঝাতে আমরা প্রায়ই বলে থাকি যে, “পকেটে টাকাকড়ি নেই” কিম্বা “কপর্দক শূণ্য”। তাছাড়া বলে থাকি যে, “একটি কানা কড়িও নেই” কিম্বা “গাঁটের কড়ি শেষ” ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি, সেই কড়ির প্রচলন না থাকলেও আর্থিক অবস্থা বুঝাতে আমাদের কথোপকথন ও সংস্কৃতিতে মৌখিক বা লিখিত ভাবে কড়ির নামটি সহজে মুছে ফেলা অতটা সহজ নয়। কেননা এটি আমাদের হৃদয়ে গভীরভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে, যা বংশ পরম্পরায় রিলে রেসের মতো চলছে এবং আগামীতেও চলবে বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষভাবে বুঝাতে ব্যাকরণগত দিক দিয়ে “টাকা-কড়ি” শব্দদ্বয়ের আড়ালে অপিনিহিত বা স্বরভক্তি বা কারক অব্যয় বা অনুসর্গ এর মাধ্যমে সমর্থক অর্থবোধক শব্দ হিসেবে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে, যা হয়তো আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।

সহায়ক সূত্রাদি ঃ

১। উইকিপিয়িা
২। বাংলাপিডিয়া।
৩। শেষ পর্যন্ত বুড়া-বুড়ি- মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব
৪। অন্যান্য বই পুস্তক।

বিশিষ্ট গবেষক, অথর্নীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।
Email: abdulbaki85@yahoo.com/www.goonijon.com , ০১৮১৩৩৩৩৩৩৫ * ০১৬৭০৪৫১৪৭৫ * ০২-৪৮১১৯০২৪


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর