ড. আলো ডি’রোজারিও
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের হাত হতে রক্ষা পেতে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ ক্রমান্বয়ে গৃহে অবস্থান করছেন স্বইচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে। বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদের গৃহ নেই তারা থাকছেন কোথায়? ইতালীর রাজধানী রোমে এক পুলিশ রাস্তায় হাঁটাচলারত এক ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে পরামর্শ দিলেন গৃহের ভেতরে যেতে। ঐ ব্যক্তি উত্তর দিলেন, ‘রাস্তাই আমার গৃহ’।
এই ভাইরাস হতে সুরক্ষার একটি ভালো উপায়, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া। কোন কোন শরণার্থী শিবিরে যেখানে এক হাজার মানুষের জন্য একটি মাত্র পানির ট্যাপ, তারা বারবার হাত ধুঁবেন কীভাবে? আফ্রিকার কোন কোন দেশে যারা এক কলসী পানি সংগ্রহ করতে ১০ বা ২০ মাইলের বেশি হাঁটেন, তারা হাত ধোঁয়ার জন্য এত পানি পাবেন কোথায়? আর এত পানি খরচ করা কী ঠিক, যেখানে পানি-সংকট চরম?
প্রশাসনের ঘোষণাকৃত গৃহের অভ্যন্তরে থাকার নিয়ম ভেঙে নদীতে গিয়ে চিংড়ির পোনাধরারত এক জেলেবোনকে এক সাংবাদিক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, আপনি চিংড়িপোনা ধরতে আসলেন কেন? না এসে কী উপায় আছে আমার, নয় জনের সংসার, যে খাবার পেয়েছি তা তো চার দিনেই শেষ হয়ে যাবে, বাকী ছয় দিন খাব কী? জেলেবোন উত্তর দিলেন। যেকোন দুর্যোগে আমাদের দেশে খাদ্য সহায়তা দিতে সাধারণত পরিবারপ্রতি একই পরিমাণে খাদ্য-সামগ্রী দেয়া হয়। একক পরিবারে ২-৩ জন থাকতে পারে, আবার ৫-৬ জন বা বেশিও থাকতে পারে। পরিবারের প্রকৃত সদস্য সংখ্যার প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য সহায়তা কবে থেকে এবং কীভাবে শুরু করা যায়? পরিবারের শিশু, স্তন্যদানকারী মা, গর্ভবতী মা, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের আলাদা আলাদা খাবারের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করলে খাদ্য সহায়তার প্যাকেজে নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ প্রদান আবশ্যিক করা কী আশু প্রয়োজন?
নানাকারণে আমাদের কয়েক লক্ষ বাংলাদেশী ভাইবোন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ অধিবাসী রয়েছেন। তারা বর্তমান করোনা ভাইরাস সংকটে না পারছেন কাজ করতে, না পারছেন খাবার যোগাড় করতে, অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা নেয়াটাও তাদের পক্ষে সহজ হচেছ না। তারা দেশে ফিরতে চাইছেন। দেশে থাকা তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন ভীষণ উদ্বেগে ও উৎকন্ঠায়। মানবিক কারণে কবে এবং কীভাবে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে?
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আমাদের সতর্ক করেছেন এই বলে যে করোনা-সংকট দীর্ঘায়িত হলে দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে। খাদ্য-সুরক্ষার ব্যবস্থা জোরদার করতে তাই তিনি আহবান জানিয়েছেন, প্রতি খণ্ড জমি চাষের আওতায় আনতে ও বাড়ির আশেপাশের কোন জমি খালি না রেখে সবজি চাষ করতে। তাঁর এই অত্যন্ত বাস্তব আহবানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে আমরা কতজন এগিয়ে এসেছি?
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একজন মানুষের মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিচয় মিলে অন্যের বিপদে-আপদে, দুর্যোগে-দুর্বিপাকে ও দুঃখ-কষ্টে এগিয়ে আসে কী না, তা দেখে। এটা খুবই আশার ও প্রশংসার বিষয় যে ইতোমধ্যে অনেক ব্যক্তি, সংগঠন, এনজিও এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান মানবিক সহায়তা দেয়া শুরু করেছেন বা শুরু করতে যাচ্ছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের সবাইকে। আরো অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়াবেন, এই বিশ্বাস রাখি।
আমাদের যা যা নেই তা তা পেতে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা চালাই, সদা ব্যস্ত থাকি। যা যা আছে, সেসবের জন্য দিনে কতবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেই বা অন্যের উপকারার্থে আমার সম্পদ হতে দান করি? করোনা ভাইরাস আমাদের বলছে : থামো, নিজের দিকে তাকাও, অন্যের দিকেও তাকাও; ভাবো, নিজের কথা ভাবো, অন্যের কথাও ভাবো; নিজে ভালো থাকো, অন্যকেও ভালো রাখতে চেষ্টা করো। আসুন, আমরা সবাই একে অপরকে ভালো রাখতে আন্তরিকতা সহকারে হাত বাড়াই।
আমরা বীরের জাতি। প্রায় খালি হাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। অতীতে যেকোন দুর্যোগ অসীম সাহসে মোকাবেলা করে অতি অল্প সময়েই আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। বর্তমান এই করোনা সংকট কাটিয়ে উঠার বিশ্বাস, মনোবল, সামর্থ ও সম্পদ আমাদের আছে। আমাদের সাহসী, বিচক্ষণ ও আত্মবিশ্বাসী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধাপে ধাপে অনেক প্রণোদনা, সাহায্য-সহায়তা, উপায়, উপদেশ, নির্দেশনা ও কৌশলের ঘোষণা দিয়েছেন। সম্মিলিত সহযোগিতায়, সততা ও স্বচছতায় তাঁর নেতৃত্বে এই করোনা ভয় আমরা অচিরেই করবো জয়।
(আলো ডি’রোজারিও, পিএইচডি, সভাপতি, কারিতাস এশিয়া , সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কারিতাস বাংলাদেশ)