ড. মিল্টন বিশ্বাস
সম্প্রতি পাঠকের সামনে এসেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত প্রথম গল্প ‘আলোকিত অন্ধকার’। কবি আসাদ মান্নানের বিশ বছর বয়সের রচনা এটি। কয়েকটি পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশের পর ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে গল্পটির ব্যতিক্রমী বুনন, অসাধারণ সমাপ্তি বিস্ময় উদ্রেক করেছে। বিবরণে প্রতীকী সংশ্লেষ এবং জাদুবাস্তবতার মিশেলে আত্মগত উন্মোচন হিসেবে আখ্যানে পুরো দেশের কথা তথা মুক্তিযুদ্ধের কথা আছে।
মূলত ‘আলোকিত অন্ধকার’ পাঠকের কাছে অভিনব গল্পকথনের অনন্য নজির হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সূচনা থেকে প্রতিটি বাক্যে গীতময়তা ও কাব্যিক শব্দ বিন্যাসে কবিতার সংরাগ উচ্চকিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বহুরৈখিক ব্যঞ্জনাময় এই প্রতীকী গল্পে বিষয়ের চিরায়ত আবেদন পাঠককে মুগ্ধ করেছে। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে শিল্প নির্মিতিতে গল্পকার নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে যে পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন সে সম্পর্কে ‘বাংলা সাহিত্য গবেষণা কেন্দ্র’কে বলেছেনÑ‘আমি বেসিক্যালি কবিতার মানুষ। কবিতা নিয়ে কাজ করি। কবিতার বাইরে আমার খুব একটা বিচরণ নেই। খুব সীমিত আঙ্গিকে আমার প্রিয় মানুষদের নিয়ে হয়তো কিছু কিছু গদ্য লিখেছি কিন্তু একটি গল্প লিখেছিলাম। এটিকে বলা যেতে পারে আমার একমাত্র গল্প। এর আগে আমার কোনো গল্প লেখা হয়নি। পরে একটি গল্প লিখেছিলাম। কিন্তু যে গল্পটির কথা আমি বলছি, এই গল্পটি বলা যেতে পারে অলৌকিকভাবে আমার মধ্যে এটি কাজ করেছে। আমি এখন কবিতার দ্বারা খুবই আক্রান্ত এবং জীবনানন্দ দাশ দ্বারা অবশ্যই বলব। আমি একটি কবিতা লেখা শেষ করলাম যে ‘সুন্দর দুঃখিনী থাকে’। এই কবিতাটি লেখার পর এটিও আমি ভাবলাম, বাংলাদেশ পরিষদের উদীয়মান লেখকদের জন্য প্রতিবছর যে প্রতিযোগিতার আহবান করে সেখানে আমি পাঠাবো। সঙ্গে সঙ্গে ভাবলাম যে একটি গল্প দিয়েই দেখি না। তখন এই গল্প লেখার পরিকল্পনা করলাম। তখন মাসটি ছিল আগস্ট মাস। শোকের মাস তখন। যদিও সরকারিভাবে সেটি তখন (১৫ আগস্ট) সরকারের ক্যালেন্ডারে ছিল না এভাবে। কোন গুরুত্বপূর্ণ তারিখ নয়, সে সময় দুঃসময়ের। বঙ্গবন্ধুর নামটা মুছে ফেলা হয়েছে সবখান থেকে। সেই সময়ে এই গল্পটায় আমি হাত দিলাম। অনেকটা কবিতার মতো। শেষ করে ফেললাম।
এটি একটি প্রতীকী গল্প। ভাষা পুরো কবিতার মতন, স্ট্রাকচারও। এটিকে আধুনিক কবিতা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। এখানে ৩ টি ক্যারেক্টার আছে। একটি ক্যারেক্টার আমি নিজে, একটি আমাদের জাতির পিতা, মাঝে মাঝে তিনি আসতেন, আরেকটা অদৃশ্য, অশরীরী ক্যারেক্টারÑ সেটি হচ্ছে সাহস। যে সাহসকে আমি সঙ্গে পেতে চাই দুঃসময়ে। এই তিনটি ক্যারেক্টার নিয়ে গল্পটি দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে আমি একটা দুঃসময়ের মধ্যে ছিলাম। আমার ঘর আমার কবর। যে নদীর কথা বলছি তা ত্রিশলক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে প্লাবিত। অথচ পদ্মা নদী আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যেখানে বাঙালি সেখানেই নদী। বাঙালির জীবন নদী ছাড়া হয় না। যেহেতু আমি দ্বীপের মানুষ। জন্মসূত্রে নদী এবং সমুদ্রের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক। কাজেই পদ্মাও এখানে সে হিসেবে এসেছে। আমাদের সমস্ত কষ্টকে ধারণ করে আছে এই পদ্মা। আমাদের সমস্ত অর্জনের সঙ্গেও এই পদ্মা জড়িয়ে আছে, সৌন্দর্যের সঙ্গেও। নদী ছাড়া তো বাংলাদেশের সৌন্দর্যের রূপটা ফুটে ওঠে না। কাজেই দেখা গেল পদ্মার যে জল, আমার কাছে মনে হয় রক্তের মত। ত্রিশলক্ষ মানুষের রক্ত মিশে আছে এই জলের মধ্যে। কারণ জলগুলো লাল হয়ে গেছে। সেখানে একটি কুমিরকে আমি দেখলাম। কুমিরটি এখানে একটি অশুভ প্রাণির প্রতীক। এখানে আমার স্বাধীনতাকে একটি গাছ হিসেবে আমি দেখেছি, একটি বৃক্ষের মতো। যেটাকে আমি লালন করছি। আমার সে স্বাধীনতাকে এই কুমিরটা একদিন নিয়ে যায়। সেই গাছটিকে আবার দেখি পিতা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন। এইভাবে এই গল্পের কথাটা আমি লিখেছি। দীর্ঘদিন এটির কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই এজন্য যে, আমি আবার এসব বিষয়ে খুবই বেখেয়ালি। একটি লেখা হয়ে গেলে আর মনে থাকে না। তবে এটাকে গুছিয়ে নিয়ে যে সুন্দরভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হবে এ বিষয়টি আমার কাজ করেনি।…
১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি আগস্টের ১৫/১৬ তারিখে গল্পটি আমি লিখেছি এবং প্রকাশ হয়েছিল একমাত্র জায়গায় সেটি ‘অন্তরে অনির্বাণ’ বাংলাদেশ পরিষদের সংকলনটিতে।’
কবির বক্তব্যানুসারে গল্পটির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। বিরূপ বিশ্বের মাঝে দাঁড়িয়ে কবি বিদ্রোহ করেছেন নিজের ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাঁর নিজের কথায়Ñ‘জাতির পিতাকে ওরা নিষিদ্ধ করে রাখে। কোথাও কোনো নামগন্ধ নেই মহান পিতার। সামরিক জান্তার কব্জায় পুরো দেশ ও রাষ্ট্রযন্ত্র। ঠিক সেই সময়ে ২০ বছর বয়সী এক অর্বাচীন বালক ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসের ১৫-১৬ তারিখে কবিতার একটা ঘোরের মধ্যে এই গল্পটা লেখে। গল্প হলো কি না জানি না। তবে পিতাকে বুকে তুলে রাখি গভীর বেদনায়, ভালোবাসায়। গল্পটা ৪৩ বছর আগে লিখা। একটা স্বীকৃতিও পেয়েছিল। বহুদিন গল্পটা আমার কাছে ছিল না। চট্টগ্রামের একজন নাট্যজনের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে কতজন কত গল্পই না লিখছেন! আমিও না হয় আমার হারানো গল্পের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি! কথাশিল্পী আবুল ফজলের ‘মৃতের আত্মহত্যা’র আগে লিখা হয়েছে এ গল্পটি। প্রথম প্রকাশকাল: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮। সংকলনÑ ‘অন্তরে অনির্বাণ’। সম্পাদক : তোফায়েল আহমদ। বাংলাদেশ পরিষদ, ঢাকা। বি: দ্র : জীবনে আর কোনো গল্প লিখতে পারিনি। দায়ী : কবিতা নামক এক হিংস্র নারী।’
কবি আসাদ মান্নানের এ গল্পটি পুনঃআবিষ্কারের আগে মনে করা হতো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গল্প কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল রচিত ‘মৃতের আত্মহত্যা’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর সাহিত্য সাময়িকী ‘সমকালে’ জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুবছর পর। এতোদিন আমরা বলে এসেছি, ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গল্প লেখার মাধ্যমে আবুল ফজল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম সাহিত্য প্রতিবাদের সূচনা করেন। কিন্তু ‘মৃতের আত্মহত্যা’ পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯৭৭ সালের ১৫-১৬ আগস্ট আসাদ মান্নান মাত্র বিশ বছর বয়সে রচনা করেন ‘আলোকিত অন্ধকার’ নামক কাব্যভাষার অনন্য আখ্যান। যদিও এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রচনাকালের দিক থেকে ‘মৃতের আত্মহত্যা’র আগে রচিত ‘আলোকিত অন্ধকার’ অল্প বয়সে রচিত হলেও এই গল্পের ভাষা ও বর্ণনায় কাব্যিক উদ্ভাসন ও অন্তিম বাক্যের শাণিত বিন্যাস স্বতন্ত্র আবহ সৃষ্টি করেছে। এ গল্পে পঁচাত্তর-পরবর্তী পটভূমি ব্যবহৃত হয়েছে। নির্ঘুম জীবনের স্মৃতি তাড়িত বেঁচে থাকা ও বঙ্গবন্ধুকে অদৃশ্যের ভেতর দৃশ্যময় করে ঘটনা তুলে ধরার পদ্ধতি নাটকীয়।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাহিত্য রচিত হওয়ার তাগাদা ছিল কবি আসাদ মান্নানের ভেতর। একই সময় তিনি জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কবিতাও লেখেন। আগস্ট ট্র্যাজিডির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা কবিতাটি একই বয়সে লেখা। ‘আগস্ট ট্র্যাজেডি : প্রথম এলিজি দ্বিতীয় কবিতা’(আগস্ট ২৮, ২০২০) প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছেন-‘তখন মাত্র ১৭ বছর ৯ মাস বয়সী এক কিশোর আমি। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর আমি এতটাই শোকাহত হয়েছিলাম যে, পরের দিন ১৬ আগস্ট কার্ফিও আক্রান্ত বিদ্যুতহীন রাতে- কবি নয়, একজন নবীন কবিতা কর্মী হিসেবে পিতাকে নিবেদন করে পেন্সিলে কাঁচা হাতে একটি দীর্ঘ কবিতা–‘সহসা আগুন জ্বলে যমুনার জলে’ লিখেছিলাম। এটি আমার তো বটে, আগস্ট ট্র্যাজিডির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা কবিতা।…লেখার পর অনেকটা ভুলে যাই এ কবিতার কথা। কালচক্রে ভাগ্যক্রমে ১৯৭৮ সালে কবিতাটি পেয়ে যাই। এ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ওই সালে আগস্ট মাসে- চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত কবি মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী সম্পাদিত ‘এপিটাফ’ নামক একটি ক্ষুদ্র সংকলনে। আমি সচরাচর যে আঙ্গিক ও ছন্দে কবিতা লিখে আসছি তা থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাব্য কলা ও করণে এটি হয়তো খুব উঁচু নয়। কিন্তু এর একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।’ এরপর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে তিনি রচনা করেন ‘সবুজ রমণী এক দুঃখিনী বাংলা’।এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন- ‘আমার সবুজ রমণী এক দুঃখিনী বাংলা’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখা আমার প্রথম এলিজি- দ্বিতীয় কবিতা। প্রায় দীর্ঘ ৫ মাস ধরে ভেবেছি কবিতাটি কিভাবে লিখব। একটা খসড়াও করেছিলাম। তারপর ১৯৭৬ সালে ১৫ আগস্ট সম্ভবত সোমবার রাতের বেলায় কবিতাটি চূড়ান্ত করি। এ কবিতার জন্য আমাকে ১৯৭৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের একজন শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি হিসেবে ‘বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হয় দেশব্যাপী একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। ১৯৭৮ সালে এ কবিতাটি আমাকে দ্বিতীয় বারের মতো “বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার ” এনে দেয়।
এছাড়া ১৯৯৪ সালের ৭ই মার্চ একটা দুর্বিসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনিসহ অপর ২ জন তরুণ সরকারি কর্মকর্তা ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দিবসটি উদযাপন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কামাল চৌধুরী ও মোহাম্মদ সাদিক। তিনি সেখানে ‘সবুজ রমণী এক দুঃখিনী বাংলা’, ‘সুন্দর দক্ষিণে থাকে’ ও ‘সহসা আগুন জ্বলে যমুনার জলে’ কবিতা তিনটি আবৃত্তি করেন। ‘সহসা আগুন জ্বলে যমুনার জলে’ শিরোনামের এ কবিতার অবিস্মরণীয় কয়েকটি পঙক্তি এরকম- ‘স্বদেশেী কুত্তার পিঠে বিদেশী শকুন/বেশ্যার ছেলের হাতে ইতিহাস খুন/আগুন লেগেছে তাই যমুনার জলে/আগে আগে হনুমান রাম পিছে চলে/সীতাকে হরণ করে রাক্ষস রাবণ/টুঙ্গিপাড়ায় হবে বঙ্গভবন।’
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু রূপায়িত হয়েছেন নানামাত্রায়, স্মরণীয় ও শ্রদ্ধার অর্ঘ্য প্রদানের আবেগ থেকে। সেখানে কবি আসাদ মান্নানের এই কবিতাগুলো ইতিহাস নির্মাণের উপাদান হিসেবে গুরুত্ব বহন করবে।
বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা ও তার আদর্শকে ধারণ করায় ‘আলোকিত অন্ধকার’ গল্পের কথকের জীবনের ওপর ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে। সেই রক্তাক্ত ভোররাত্রির কাহিনি ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যেন তিনি। এখানে ইতিহাসের এক অবিনশ্বর কণ্ঠস্বর শ্রুত হয়েছে। যে কণ্ঠস্বর বলে চলেছেন হত্যা থেকে, রক্ত থেকে বেশি মূল্যবান জীবন। জীবনের কথা বলেছেন লেখক। ঘটনাবিন্যাস, চরিত্রায়ণ ও বর্ণনায় লেখকের আবেগের প্রকাশ ঘটেছে। হিংসা-বিদ্বেষ কিংবা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের মনোভাব থেকে এর জন্ম নয়। প্রতীকী পরিচর্যায় শেষ পরিচ্ছেদটি লক্ষণীয় যেখানে মানচিত্রের কথা আছে। ‘মানচিত্রটা আপনি আমার হাতে দিয়ে হাওয়ার সাথে মিশে গেলেন। এর পর বহুদিন আপনার সাথে দেখা নেই। আজ এ দুঃসময়ে আমার ঘরে এলেন। কিন্তু ভাঙ্গা ঘর, ঘরে চাল নেই। চোখে শুয়ে আছে অনন্ত স্বপ্নের মতো আপনার প্রদত্ত মানচিত্রটা; চারদিকে ফুলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকারÑ হাসছে। চলুন, অন্ধকার আপনাকে দিয়ে আসি।’
মূলত প্রতীক ও সাংকেতিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত আসাদ মান্নানের ‘আলোকিত অন্ধকার’ গল্পটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একটি অনুধ্যানের গল্প। আপাতদৃষ্টিতে কোনো নিটোল কাহিনি কিংবা বলা চলে প্রথাগত ঘটনাধারা এখানে নেই। তবে এর ভেতরে রয়েছে ফল্গুধারায় প্রবাহিত এদেশের অন্তঃগূঢ় ইতিহাস। গল্পটি পড়লে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, পাকিস্তানি হায়েনা এগুলোই মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপলব্ধির গল্প, অনুভবের গল্প এটি। এটি পড়ার সময় বাক্যগুলোর গতিশীল অভিব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হবে, মনে হবে চিত্রের পর চিত্র নদীর ঢেউয়ের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। শব্দ, উপমা, চিত্রকল্পগুলো অসাধারণ, চিন্তার গভীরতায় ঋদ্ধ। লেখক প্রতীকের আড়ালে গভীর অনুচিন্তনে বর্ণনা করে গেছেন, শব্দচয়ন আর বয়ান কৌশল প্রশংসনীয়।
কথক, শ্রোতা আর বাবা- তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে তৈরি হওয়া গল্পটিতে শ্রোতার কোনো ভূমিকা না থাকলেও কথক তাকেই অবলীলায় বলে গেছেন নিজের অনুভবের কথা। আর এই শ্রোতা হলো সাহসের অপর নাম। বাবার সাথে কথকের যে ঘটনাধারা সে কথাই কথক শ্রোতাকে বলেছেন। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে কথক বাবার কাছে শান্তির ঘুমের জন্য স্বাধীনতা চেয়েছেন। বাবা তাঁর স্বাধীনতার স্বরূপ একটা গাছের চারা বের করে দেন। যে চারাটি অদ্ভুত ধরনের গুণ ধারণ করে। বাবা পাকিস্তানি হায়েনার প্রতীক কুমিরের পিঠ থেকে স্বাধীনতার প্রতীক চারাটি অনেক কষ্ট করে উদ্ধার করে আনেন। এখানে চারা গাছটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক যা ৫৬ হাজার বর্গ মাইল জুড়ে বিরাজ করছে আর কুমির পাকিস্তানি হায়েনার দল। পদ্মা নদীকে আনা হয়েছে মাতৃরূপে যেখানে চারাগাছটি নিয়ে সুখে ছিল জনগণ। কিন্তু সেই নদীতে কুমির আবির্ভূত হয়। সেখান থেকে চারাগাছটি আনতে গিয়ে তিরিশ লক্ষ লোকের রক্তে পদ্মার জল হয়েছে রক্তিম। এভাবে বাবা অনেক সংগ্রামের পর কুমিরের কাছ থেকে কথককে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। স্বাধীনতা পেয়ে কথকের আনন্দ ও সুখ এসেছিল কিন্তু তাও তিরোহিত হয়। কারণ বিরোধীদের কাছে সে স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই। বিরোধীরা এখনো বলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে থাকলেই ভালো হতো।
স্বাধীনতাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন কবি আসাদ মান্নান। সুন্দর কথামালা আর কাব্যিক উপস্থাপনায় অভিনব একটি গল্প। গল্পটি যেন কাব্যকথা- এখানে প্রতীকগুলোর মাঝে দেশ ও বঙ্গবন্ধুর কথা পরিষ্কার বোঝা যায়। বস্তুত ‘আলোকিত অন্ধকার’-এ কবিতা ও গল্পের লালিত্যময় মেলবন্ধন ঘটেছে। আকর্ষণীয় বর্ণন-প্রকৌশলের জন্যও এটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমরা মনে করি।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)