‘উত্তরগণতন্ত্র ও লিংকনের পিপল’ (২০১৯) বইটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরামের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের তথ্যবহুল ও বহুল আলোচিত বই। তিনি কুমিল্লা জেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। স্কুল জীবনেই লেখালেখি শুরু করেন। লেখাপড়া শুরু কুমিল্লা’তে হলেও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে বি.কম ও এম.কম ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন সরকারি চাকরি দিয়ে শুরু করলেও অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি এ বই ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই লিখেছেন। ‘কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ’, ‘বাজারজাতকরণ’, ‘বাজারজাতকরণ নীতিমালা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয় ভাবনা’, ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও বাংলাদেশ’ ইত্যাদি । ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দেশ ভ্রমণ ও অনেক গুণী মানুষের সাথে কাজ করেছেন তিনি।
গুণী এ লেখক তাঁর এ বইতে রাজনীতি ও শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন ভাবে আলোচনা করেছেন। যা অন্য কোনো লেখকের লেখায় দেখা যায় না। এদিক দিয়ে তিনিই প্রথম এ ধরনের বই লিখেছেন যা সময়ের সাথে, মানুষের জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িত। পেশায় অধ্যাপনা হলেও তিনি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। সেহেতু টেলিভিশনে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে টকশোতে আলোচনা করেন সেই কারণে রাজনৈতিক ভাবনার প্রভাব তাঁর এ বইতে দেখা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়ন করার তার যে প্রয়াস তাও স্থান পেয়েছে এতে। এ বই পাঠ করার পরে জ্ঞান যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি দেশ বিদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসাও জাগ্রত হয়। যারা দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
এ বইতে যে প্রবন্ধগুলো আছে তা তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। যেমন রাজনীতি, সমসাময়িক নির্বাচনি এবং শিক্ষা। সর্বোপরি বাংলাদেশের উন্নয়ন। এখানে আছে মানুষের কল্যাণের কথা, দেশের কথা। দেশকে সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাঁর যে ভাবনা সেগুলোই তিনি সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। বইটিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এলেও সার্বিকভাবে বৈশ্বিক চিত্র প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনৈতিক ক্যাটাগরিতে পড়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। যেমন, উত্তরগণতন্ত্র ও আসন্ন নির্বাচন, জোট ও ক্ষমতার রাজনীতি, লিংকনের পিপল ও জনগণের নির্বাচন, উন্নয়নশীল বাংলাদেশ ও আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, বিএনপির আদর্শ ধর্মাশ্রয়ী ধর্মান্ধতা ও ভারত বিরোধী রাজনীতি এবং রাজনীতির রিকনসিলিয়েশন : প্রস্তাবনা ও বাস্তবতা ইত্যাদি।
‘উত্তরগণতন্ত্র ও আসন্ন নির্বাচন’ প্রবন্ধে গণতন্ত্র কি এবং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা এবং আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞার আলোকে বাংলাদেশে কোন ধরনের গণতন্ত্র বিরাজ করছে তা আলোচনা করেছেন। লেখক আলোচনা করে বলেন যে, প্লেটো ও লিংকনের গণতন্ত্র আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশে আছে সনাতন গণতন্ত্র। সেখানে সভা, সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ ও অবরোধকেই গণতান্ত্রিক কর্মসূচি মনে করা হয়। কিন্তু এগুলো কখনো গণতান্ত্রিক দেশের কাম্য নয়। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র আছে তা হলো দুটি আদর্শের ধারা। যার একটি বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার পক্ষের অপরটি হলো জামায়াত ও বিএনপির ধর্মাশ্রয়ী আদর্শ। এটা ভ্রান্ত গণতন্ত্র।
‘জোট ও ক্ষমতার রাজনীতি’ প্রবন্ধে লেখক বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। সেখানে ক্ষমতা থাকলে সবই হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিকে তিনি ‘ওয়ে অব গেইনিং পাওয়ার’ বলেছেন। আর সে পাওয়ার পেতে জোট বেধে এক হয়ে নির্বাচন করছে। একেই তারা মনে করে ক্ষমতায় আসার একমাত্র উপায় বা পন্থা। এখানে কিছু রাজনৈতিক দল এক হয়ে প্রয়োজনে বিপক্ষকে নিঃশেষ করতেও দ্বিধা করে না। যার ফলে বিএনপি জামায়াত আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে বার বার হামলা চালায়। জোটের রাজনীতি এ অঞ্চলে পূর্ব থেকেই চলে আসছে একথাও জানান তিনি।
‘রাজনীতির রিকনসিলিয়েশন : প্রস্তাবনা ও সম্ভাবনা’ প্রবন্ধে বলেন রাজনীতির রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উন্নয়ন করা সম্ভব। আর রাজনৈতিক উন্নয়ন হলে দেশে উন্নয়ন হবে। রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন হলো মিলিয়ে দেখা। অতীতের সাথে বর্তমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মিলিয়ে পার্থক্য নিরূপণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেই রাজনীতির রিকনসিলিয়েশন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তিকে শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার কথা বলেন। আর এটা করতে পারলে রাজনীতির রিকনসিলিয়েশন হবে অন্যথায় নয়।
‘ম্যাজিক নাম্বার ১৫১ ও মনোনয়ন’ প্রবন্ধ তিনি ১৫১ সংসদীয় আসন সংখ্যাকে ম্যাজিক নাম্বার বলেছেন। ১৫১ টি আসন পেলেই বাংলাদেশে সরকার গঠন করা যায়। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৫১ টি আসন পেতে দলগুলো যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেভাবেই হোক ১৫১ টি আসন পেতে চায়। এজন্য সংসদীয় অঞ্চলগুলোতে বেশি জনপ্রিয় ও দক্ষ প্রার্থীকে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উৎসব চলে কিন্তু উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন কবে হয় তা জানাই যায় না।
‘লিংকনের পিপল ও জনগণের নির্বাচন’ প্রবন্ধে দেখাতে চেয়েছেন যে, লিংকনের বা প্লেটোর গণতন্ত্র এখন আর নেই। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের অনেক দেশেই এ গণতন্ত্র দেখা যায় না। দেখা যায় সব মানুষই নির্বাচন সম্পর্কে জানে না বা জ্ঞান রাখে না। আবার মিডিয়া যেভাবে প্রচার করছে সেভাবেই জনগণ নির্বাচন সম্পর্কে জানতে পারছে। অর্থাৎ মিডিয়াই নির্বাচনের একটা অংশ এবং মিডিয়ার কথাই জনগণ সত্য বলে মেনে নিচ্ছে। অশিক্ষিত জনগণ নির্বাচন সম্পর্কে কিছুই বোঝে না। মানুষের কথাই তারা সত্য বলে মেনে নেয়। এমন জনগণ লিংকনের জনগণের মধ্যে পড়ে না। লিংকন যে জনগণকে সরকার বলেছেন তারা সবাই শিক্ষিত সচেতন জনগণ, যে জনগণ মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
এ গ্রন্থে লেখক বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আগামীর রাজনীতি হবে সচেতন শিক্ষিত মানুষের রাজনীতি। শিক্ষা যে দিন দিন পণ্য হয়ে যাচ্ছে তা থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় কি? শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের উপায় এবং উন্নয়নের পথে বাঁধা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। মেধাবীরাই রাজনীতি বদলাবে, শিক্ষা পণ্যের বিশ্বায়ন, মেধা কোটা পরিবর্তনের সময় এসেছে, সময়োপযোগী শিক্ষা : সংকট ও সম্ভাবনা ইত্যাদি প্রবন্ধে তিনি শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছেন ।
‘শিক্ষা পণ্যের বিশ্বায়ন’ প্রবন্ধে লেখক শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।তিনি পণ্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, ‘পণ্য হচ্ছে তাই, যা মানুষের কাজে লাগে’। শিক্ষা মানুষ আহরণ করবে এবং তা বিতরণ করবে। কিন্তু বর্তমানে মানুষ শিক্ষা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছে। জ্ঞানীরা শিক্ষা বিতরণ নয় অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে। আবার বড় বড় ডিগ্রি এখন টাকা দিয়ে ক্রয় করা যাচ্ছে। বর্তমানে মানুষ মনে করে সার্টিফিকেট থাকলেই জ্ঞানী হওয়া যায়।তাই দামি দামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানুষ সার্টিফিকেট কিনছে।বর্তমানে পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বই পড়ানো হয় এবং জ্ঞান দান করা হয় । তাই টাকা খরচ করে এখন দূরে গিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য মানুষ প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। কিন্তু মানুষ যদি সার্বিক শিক্ষা নেয় তাহলে তার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কোন দরকার হয় না।
‘মেধাকোটা পরিবর্তনের সময় এসেছে’ প্রবন্ধে লেখক যোগ্যতা অনুযায়ী মানুষকে কাজে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন।তিনি বলেন কোটা আন্দোলনকারীরা মোটেও মেধাবী নয়। যদি তারা মেধাবী হতো তাহলে তারাই চাকরি পেতো। কোটা থাকার দরকার আছে তবে তা প্রয়োজন অনুযায়ী। কোটায় যারা চাকরি পাচ্ছে দেখা গেছে তারা অন্যদের চেয়ে কম মেধাবী । তাই সেটা সংস্কার করা উচিত । মেধাবীদের সব জায়গায় সমান নিয়োগ দেওয়ার কথা তিনি বলেন । শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেছেন। মাত্র ১৩ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।মেধাবীদের স্থান দিতেই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ভর্তির ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। আবার এখানে মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। তাই মেধাবীদের প্রথম পছন্দ এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এক আধুনিক ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এর প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।
মূলত ‘উত্তরগণতন্ত্র ও লিংকনের পিপল’ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান রাজনীতি, নির্বাচন ও শিক্ষা নিয়ে সময়োপযোগী আলোচনা করেছেন।বিভিন্ন তথ্য নিয়ে পরিসংখ্যান দিয়ে সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন তাঁর নিজস্ব বক্তব্যসমূহ। সাবলীল গদ্যের জন্য আলোচ্য গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো প্রাণবন্ত । গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
(উত্তরগণতন্ত্র ও লিংকনের পিপল, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, প্রচ্ছদ : অনন্ত আকাশ, মূল্য : ২৫০ টাকা, ২০১৯)