অ) শিশুকালে পড়াশোনার ক্ষেত্রে যা নিয়ে হাতে খড়ি, তাহলো ‘অ’তে অজগর, ‘আ’তে আম……। অবশ্য অজগর শব্দটি ভীতিকর। কিন্তু “আম” শব্দটি পরম আকর্ষণীয়। কেননা ছোটবেলা থেকে কাঁচা পাকা আম খাওয়ার সেই যে গতি চলমান, যা অদ্যাবধি বিভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের ফল সংস্কৃতির আওতায় মনোদৈহিক দিক দিয়ে বিশেষ জাযগা জুড়ে আছে। সম্মানিত পাঠকবর্গ হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন যে বয়োঃবৃদ্ধির যুগপৎ যে গাছ যে ফল আমাদের জীবনকে অধিকতর সদা আলোড়িত করে, সেটা হলো এই আম। কেবল ফল বা খাদ্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক নয়। শিক্ষা জীবনেও ছড়া, কবিতা ও গল্পের ক্ষেত্রেও বিশেষ জায়গা নিয়ে আছে। বৈশাখের সেই গুটি আম থেকে শুরু করে কাঁচা মিঠা আম, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর সুখ, আম-ডাল, মামা বাড়িতে আম খাওয়ার নিমন্ত্রণ; আম-দুধ; আম-আচার, আমসত্ত¡; ইত্যাদি এখনও ভুলতে পারিনি। আসলে বিভিন্ন ধরনের পাকা আম আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আম গাছ আমাদের জাতীয় বৃক্ষ হলেও কাঁঠাল হলো জাতীয় ফল। অথচ ভারতের জাতীয় ফল আম। যতদূর তথ্যাদি নিয়েছি তাতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আমের আদি জন্মস্থান আসাম থেকে সাবেক ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার) পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল। সে অর্থে বাংলাদেশের পূর্বাংশও আমের জন্মভূমির দাবিদার। এতদ্ব্যতীত বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্য প্রায় ৬ হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে আম চাষের নজির পাওয়া যায়। যেসব জাতের আম এ দেশে দেখা যায়, তার অধিকাংশ জাতেরই সৃষ্টি এসব অঞ্চলেই। তবে কবে কখন আম গাছ বা আমের জন্ম, তা নিয়ে প্রভুত বিতর্ক রয়েছে। তবে ফলটি যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এ দেশে জন্মে আসছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এদিকে এই ফলের নাম কেন আম হলো সে ব্যাপারে শানে নুযুল হলো অতি প্রাচীনকালে আমের কদর আর গুরুত্ব বোঝাতে সংস্কৃতিতে এর নামকরণ করা হয় “আম”, যার অর্থ মজুদ খাদ্য বা রসদ। আর ইংরেজিতেই ম্যাঙ্গো বলা হয় কেন? সে ব্যাপারে অনেক কথা থাকলেও, যেটা সর্বজন স্বীকৃত, তা হলো ইংরেজ ও স্প্যানিশরা আমকে বলে ম্যাঙ্গো, পর্তুগিজরা বলে ম্যাঙ্গা। শব্দ দুটি তামিল শব্দ গধহ- শবু বা গধহ- মধু থেকে উদ্ভুত। আর একই ধারাবাহিকতায় “আম”কে ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, গ্রিক, হিব্রæ, জাপানি ভাষায় বলা হয় “ম্যাঙ্গো”। আর থাইল্যান্ডে আমকে বলা হয় “মা-মুয়াং”। অবশ্য আম নাম হিসেবে এই ফল পাক-বাংলা-ভারত উপমহাদেশে অধিক পরিচিত।
আ) আম গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত একটি ফল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আম বাংলাদেশ, আসাম (ভারত) ও মায়ানমারসহ ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় ফল। অবশ্য অন্যান্য প্রজাতির উৎপত্তি মালয় অঞ্চলে। উল্লেখ্য যে, ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ অনুষ্ঠানে ব্যবহার্য ফলাদির মধ্যে আমের ব্যবহার সর্বাধিক। এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমের মতো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক খুব কম ফলেরই রয়েছে। কথিত আছে যে, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধকে এই মর্মে একটি আম্রকানন উপহার দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি এর ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারেন। এদিকে অতি প্রাচীনকালে নির্মিত ভারতের অজন্তা ইলোবার গুহাচিত্রে রয়েছে আম গাছের অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন চিত্র। তাছাড়া খৃষ্টপূর্ব ৩২৭ মহাবীর আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় এসে সদৃশ্য আম বাগান দেখে মুগ্ধ হন। আর ভারতবর্ষে পাল রাজাদের আমলে পন্ডুবর্ধনভুক্তি ও শ্রীনগরভুক্তিতে আমের চাষ করা হতো। জানা যায় যে, বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং, যিনি ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ভারত উপমহাদেশে ভ্রমণে এসছিলেন এবং তিনিই আমকে সর্বপ্রথম বর্হির্বিশ্বে পরিচিত করান। যাহোক, মুসলিম শাসন আমলেও আম চাষ ও আম বাগান জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সম্রাট বাবর তাঁর রাজত্বকালে আমকে ভারতের শ্রেষ্ঠ ফল বলে আখ্যায়িত করেন। এদিকে মুগল সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতের লাখবাগের দারভাঙার সন্নিকটে প্রায় এক লক্ষ আম গাছ রোপন করেছিলেন। আর সেটিকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সুসংগঠিত আমবাগান বলে অভিহিত করা হয়। এক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদের নবাবদের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আনুমানিক ১৭০০ সালে ব্রাজিলে প্রথম আম গাছ রোপণের পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিম গোলার্ধে আমের চাষ শুরু হয়নি। আর সম্ভবত সেখান থেকে এ ফল ওয়েস্ট ইন্ডিজে পৌছায় ১৭৪০ সালের দিকে। যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, স্প্যানিশ, ডাচ, ফ্রেন্স ও ইংরেজদের হাত ধরে ধীরে ধীরে আমেরিকা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, সোমালিয়া, কেনিয়া ও ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। অবশ্য আমেরিকার গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে কিছু বুনো প্রজাতির আম জন্মে। বর্তমানে অনেক দেশেই আম জন্মিলেও বেশি জন্মে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, পাকিস্তান, মিশর, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইত্যাদি দেশে। আম গাছ বিভিন্ন কৃষি উপযোগী জলবায়ুতে জন্মাতে সক্ষম বলে বর্তমানে এটিকে পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এটি চিরসবুজ, কান্ড বৃহদাকার, বাকল খসখসে ও কালচে রঙের, শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত ও ঘন পাতা। বস্তুত ফাঁকে ফাঁকে আম চারা রোপন করা হলে তা বৃদ্ধি পেয়ে উপর দিকে ছাতার আকৃতি ধারণ করে এবং প্রায় ২০ মিটার উঁচু ও ৩০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত হতে পারে। আম কাঠ ধূসর বর্ণের, মোটা আশযুক্ত। যাহোক, প্রায় সব ধরনের মাটিই আম চাষের জন্য উপযোগী। তবে যেখানে মাটি স্তরের গভীরতা এক মিটারের কম এবং যেখানে মাটির নিম্ন স্তরে নুড়ি, শিলা, কাঁকর ইত্যাদি রয়েছে অথবা যে মাটি অতিরিক্ত আঠালো, সেখানে আম গাছ ভাল হয় না। পলিমাটির স্তরসমৃদ্ধ গাঙ্গেয় সমভূমি এলাকায়, যেখানে মাটিস্তর গভীর এবং আলগা নুড়ির একটা উপস্তর রয়েছে এবং মাটির পিএইচ মাত্রা ৫.৫ থেকে ৭.৫, যা এর বৃদ্ধির সহায়ক। আমের ভাল ফলনের জন্য প্রয়োজন প্রচুর বৃষ্টিপাত, যেন মাটির বেশ গভীর পর্যন্ত আর্দ্র হতে পারে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আম গাছে যখন মুকুল আসে। তখন কুয়াশা, বৃষ্টি এবং মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে ফলের গঠনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। মুকুল থেকে ফলের উন্মোষ ও বৃদ্ধির সময়ে হালকা বৃষ্টিপাত উপকারী। কিন্তু ঝড়, বিশেষত শীলাবৃষ্টিতে ফলের ক্ষতি হয় এবং অকালে ঝরে যায়। কলম পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম গাছে প্রথমবারের মতো ফল আসে গাছের বয়স যখন প্রায় চার বছর হয়। বিচি থেকে উৎপন্ন গাছে ফল আসতে আরও বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। ফল আসা একবার শুরু হলে বছরের পর বছর ফলন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কলম করা গাছে প্রায় ৪৫ বছর পর্যন্ত ফল ধরে, তারপর ফলন হ্রাস পেতে আরম্ভ করে। বীচি থেকে উৎপন্ন গাছ বাঁচে বেশি দিন এবং তাতে ফল ধরে ৬০ বছর বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত। হলদে সাদা বা বেগুণি বর্ণের ও সুগন্ধযুক্ত মুকুল পত্রগুচ্ছের মাথায় ঝুরির আকারে জন্মে। প্রতিটি মঞ্জরিতে ১০০ থেকে ২৫০টি মুকুল ধরে। মুকুল সাধারণত উভয়লিঙ্গ। আর স্ত্রীমুকুল কম থাকে। একটি আম গাছের মোট মুকুলের পরিমাণ বা সংখ্যার ওপর ফলের বিন্যাসের মাত্রা নির্ভর করে। প্রায় এক হাজার মুকুলের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ফলে রূপ নিতে পারে মাত্র দু’একটি। মজার ব্যাপার হলো যে, একটি মঞ্জরি থেকে দুই বা তিনটি ফল হলেই ফলন সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। আমের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত থাকলেও প্রবন্ধের স্বার্থে এর গঠন প্রণালী সম্পর্কে যতকিঞ্চিৎ তুলে ধরছি।
এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, আম মসৃণ, কিছুটা আঁটসাঁট, শাঁসালো, এক আঁটিযুক্ত। এই ফল গোলাকার, ডিম্বাকার, হৃৎপিন্ডাকার, বৃক্কাকার, লম্বা বা সরু, ইত্যাদি বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। কাঁচা আম সাধারণত সবুজ, পাকলে সবুজাভ হলুদ, হলুদ, কমলা, মিশ্র রঙের লাল আভাযুক্ত, এমনকি সবুজও থেকে যেতে পারে। পাকা ফল আকারে ও গুণে নানা রকমের হতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, ক্ষুদ্রতম আম আলুবোখারার ন্যায়। আর বড় প্রজাতির একেকটি আমের ওজন ৭৫০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ই) আম গাছ সারা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জন্মে এবং মূলত এর রোপণ হয় বসতবাড়ির গাছ হিসেবে। এদেশের আম প্রধানত দুটি জাতের, একটি উন্নত বা অভিজাত; (যা জোড়কলম ও অন্যান্য অঙ্গজ পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে) অন্যটি স্থানীয়; (যার বংশবিস্তার ঘটে বীজ থেকে)। এ ধরনের আম স্থানীয়ভাবে দেশি আম বা গুটি আম হিসেবে পরিচিত। এদের নির্দিষ্ট কোনও নাম নেই, স্বাদও খুব একটা নিশ্চিত নয়। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে বেশ কিছু সংখ্যক উন্নত জাতের আম রয়েছে, এগুলি অধিকাংশই জন্মে রাজশাহী, নবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর এলাকায়। বাজারে এসব আমের চাহিদাই বেশি এবং এ জাতগুলি বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের আমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফজলি, লেংড়া, গোপালভোগ, হিমসাগর, ক্ষীরসাপাতি, আশি^না, কিষানভোগ, কুয়াপাহাড়ি, লতা বোম্বাই, ফোরিয়া বোম্বাই, কোহিতুর, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, রাণীপছন্দ, ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রম উল্লেখ্য যে, আম সব সময়ই ছিল রাজ রাজাদের প্রিয় ফল, সে জন্য এর নাম নৃপপ্রিয়। ফলটি রসাল বলে এর নামের সঙ্গে বিভিন্ন নামকারক রস শব্দটা জুড়ে দিয়েছেন; যেমন- মধ্বারস, রসাল, সিধুরস, ইত্যাদি। মিষ্টি স্বাদের বলে এর নাম মধুলী। সত্যি কথা বলতে কি, আমের রয়েছে বহু প্রজাতি, আর সেসব প্রজাতির নামকরণের পেছনে রয়েছে মজার মজার ইতিকথা ও শানে নুযুল। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, মোগল বাদশাহ আকবরের দরবারে এক প্রখ্যাত বাইজি ছিলেন। নাম ছিল তাঁর ফজল বিবি। বৃদ্ধ বয়সে ফজল বিবিকে বাদশাহ তাঁর আমবাগানের এক কোণে একটা ঘর তৈরি করে থাকতে দেন। আর ফজল বিবির ঘর ছিল একটি আমগাছের তলায়। সে গাছে বড় বড় আম ধরতো। ফজল বিবি মারা যাওয়ার পর মানুষ ঐ বড় বড় আমের নাম দেয় ফজলি আম। এখন আমরা যে ফজলি আম খাই, সেটা সেই আদি গাছের আম। তবে সময়ের বিবর্তনে এর আকার ও স্বাদে বেশ বৈচিত্র্য এসেছে। এ জন্য এখন ফজলিরও অনেক উপজাত সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- সুরমাই ফজলি, মালদা ফজলি, নাক ফজলি, কাল ফজলি, ইত্যাদি। এদিকে প্রাচীন ভারতে আম্রপালি নামক খ্যাতনামা ও শ্রেষ্ঠ নর্তকী ছিলেন। তাঁর নামেও হাইব্রিড জাতের আরেকটি আমের নাম রাখা হয়েছে আম্রপালি। আমের মধ্যে আম্রপালি সবচেয়ে মিষ্টি। আর দূর অতীতে ভারতের বেনারসে একজন সৌখিন ল্যাংড়া বৃদ্ধ ছিলেন। তিনি আম গাছের প্রতি অনুরাগী ছিলেন বিধায় বেছে বেছে অপূর্ব স্বাদ ও ঘ্রাণের একটি আম গাছ লাগান। সেই ঘ্রাণসহ অপূর্ব স্বাদের আমের কথা সর্ব জায়গায় ছড়িয়ে পড়লে এই প্রজাতির আমের চাষ বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়। সেই থেকে আমটার নাম হয় যায় ল্যাংড়া। সম্রাট শাহজাহান তাঁর ছেলে আওরঙ্গজেবকে খাওয়ানোর জন্য দাক্ষিণাত্য থেকে যে আম আনিয়েছিলেন, সে আমের নামকরণ করা হয়েছিল বাদশাহপসন্দ। এভাবে দিলপসন্দ, রানিপসন্দ, জামাইপসন্দ, ইত্যাদি নামের পেছনেও জড়িয়ে রয়েছে নানা কাহিনি। অনেক আমের নামের শেষে যুক্ত হয়েছে ভোগ শব্দ; যেমন- গোপালভোগ, ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানিভোগ, ল²ণভোগ, ইত্যাদি। বস্তুত এসব জাতের দেড় হাজারের উপরে বিভিন্ন নামের আম আছে আমাদের এ উপমহাদেশে।
ঈ) আম অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। খাদ্যমানের দিক থেকে অন্যান্য দেশীয় ফলের মধ্যে বলতে গেলে আমের স্থান শীর্ষে। পাকা আমে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যারোটিন বা ভিটামিন এ থাকে। ভিটামিন এ এর বিবেচনায় আমের স্থান পৃথিবীর প্রায় সব ফলের উপরে। আমে ভিটামিন সি এর পরিমাণও সন্তোষজনক। কাঁচা ও পাকা উভয় আমে ভিটামিন সি থাকলেও কাঁচা আমে ভিটামিন সি এর পরিমাণ বেশি। গবেষণালব্দ তথ্য থেকে জানা যায় যে, কাঁচা আমে পাকা আমের চেয়ে দেড় গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। এ ছাড়া ১৬৫ গ্রাম সদ্য সংগ্রহ করা আমের পাল্পে ৯৯.০ ক্যালরি শক্তি, ১.৩৫ গ্রাম প্রোটিন, ০.৬৩ গ্রাম চর্বি, ২৪.৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২২.৫ গ্রাম সুগার ও ২.৬৪ গ্রাম আঁশ থাকে। সাধারণত পাকা আম মিষ্টি বা মিষ্টি-টক হয়ে থাকে। আমের মিষ্টতা নির্ভর করে আমে থাকা চিনির পরিমাণের ওপর; বিশেষ করে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও সুক্রোজ। টাটকা পাকা আমে প্রায় ১৫ শতাংশ সুগার বা চিনি থাকে। জাতভেদে এই পরিমাণ কমিেবশ হয়। কাঁচা আমে ফ্রুক্টোজ প্রধান মনোস্যাক্কারাইড, কিন্তু পাকা আমে প্রধান হলো সুক্রোজ। কাঁচা আমে পরিমাণের দিক থেকে স্টার্চ বেশি থাকে। অথচ পাকার প্রাক্কালে এই স্টার্চ গ্লুকোজে পরিণত হয়। এভাবে পাকার সময় আমের শাঁসে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও সক্রোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
উ) বর্তমানে বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদন প্রায় সোয়া ৩ লাখ মেট্রিক টন। রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার হেক্টর ও নওগাঁ জেলায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন ২৫ লাখ মেট্রিক টন। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস-২১ অনুসারে, এ দেশে ৯৫ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমিতে ১২ দশমিক ২২ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হচ্ছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, বিশে^ আম উৎপাদনে শীর্ষ দেশ ভারত (৩০%) অথচ বাংলাদেশের নবম অবস্থান (৩%)। এদিকে আনন্দের বিষয় হলো যে, বাংলাদেশের দুটি জাতের আম জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৯ সালে ক্ষীরশাপাতি এবং ২০২১ সালে ফজলি আম বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে জিআই সনদ লাভ করে। শুধু তাই নয়, ফজলির জিআই স্বীকৃতি মিলেছে রাজশাহীর আম হিসেবে। অন্যদিকে ক্ষীরশাপাতি জিআই সনদ পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমে। এতে প্রতীয়মান হয় যে বহির্বিশে^ অন্য কোথায় থেকে যাওয়া কোনো ফজলি বা ক্ষীরশাপাতি আমের চেয়ে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের ফজলি ও ক্ষীরশাপাতির চাহিদা ও মূল্যমান অনেক বেশি। তবে দুঃখজনক হলো যে, ফজলি আমের জি আই স্বত্ব নিয়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মধ্যে কম টানাটানি হয়নি? পরবর্তীতে অবশ্য সিদ্ধান্ত হয় যে ফজলী আমের জি আই সনদ, যৌথভাবে উভয় রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
ঊ) পরিশেষে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ মৃত্তিকা ও আবহাওয়ার সুবাদে আমের ফলনের দিক দিয়ে একটি সম্ভাবনার দেশ। যদিও এ ব্যাপারে কিছুটা অন্তরায় আছে, যেমন- উৎপাদনশীলতাহীন পুরানো গাছ; অনাগ্রহ; ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার অভাব; রোগ ব্যাধি/পোকামাকড়; বিচি থেকে গাছ উৎপাদন; উন্নত প্রযুক্তির অভাব; নানা অজুহাতে নির্বিচারে গাছ কাটা, ইত্যাদি। এ সকল নেতিবাচক অবস্থা কাটিয়ে উঠলে এই আম উৎপাদনে টপ টেন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উপরে থাকবে বলে মনে করি। আর শিশুকালে পড়াশোনার শুরুতে যেমন “আ” তে আম পড়েছিলাম, তেমন উৎকৃষ্ট আম যদি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র প্রথম চেয়ারটি পায়, তাহলে এর স্বার্থকতা আসবে বলে কায়মনবাক্যে বিশ^াস করি। এর সপক্ষে গত ২৩/০৫/২০২২ তারিখে একটি জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকায় যখন দেখলাম রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় চলতি মৌসুমে যত আম উৎপাদিত হবে, তাতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে এবং এটা নাকি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। তখন মনে হলো জীবনকালের ভোরে যে “আ” তে আম পড়েছিলাম, তার সুফল হয়তো আশা শুরু করেছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই ধান শালিকের বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় আটশত প্রকারের আমের জাত এবং এর অধিকাংশই স্থানীয়। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ৩৫০ ধরনের স্থানীয় জাতের আমের চাষ হয়। সেই কারণে যদি চাপাইনবাবগঞ্জকে বাংলাদেশের আতুড়ঘর বলি, তাহলে বোধ হয় বেশি বলা হবে না। আর হয়তো এই সুবাদে এখানে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আম গবেষণা কেন্দ্র (আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র) এটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত এই ইনস্টিটিউট আমের ৩টি হাইব্রিড জাতসহ ১৮টি সুমিষ্ট উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ১৪টি চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে এবং বাকী ৪টি রাজশাহীসহ অন্যান্য গবেষণা কেন্দ্র হতে। এদিকে আরও নতুন জাতের আম উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে ক্রসিং বা সংকরায়নের কাজ অব্যাহত আছে।