২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, রাত ৯:৫৬
নোটিশ :
Wellcome to our website...

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালায় বাঙলা

রিপোর্টার
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন

রেজওয়ান আহমেদ

সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস – এস. আই. এল.। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০০৯ সালে এই সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বে ৬,৯০৯ টি ভাষা প্রচলিত আছে। ভাষা একটি গতিশীল মাধ্যম। সে কারণে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ভাষাসংক্রান্ত পরিসংখ্যানও। এ তথ্যের সত্যতা নিরূপণ করে ২০১৮ সালের হিসাব। ২০০৯ থেকে ২০১৮ – এই নয় বছরে বিশ্বের ভাষার তালিকায় যোগ হয়েছে আরো প্রায় ২০০ টি নতুন ভাষা। ফলে চলতি হিসাবে বিশ্বে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০৯৭ টিতে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষার দেশ বলা হয় পাপুয়া নিউগিনিকে। ঔপনিবেশিকতাবাদ, ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসার প্রভৃতি নানা কারণে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে সেদেশে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৮৫৬ টি। তবে এর মধ্যে তিনটি ভাষাকে সমধিক প্রচলিত বলা যায় – টোক পিসিন, ইংরেজি এবং হিরি মোতু বা হিরি।

প্রশ্ন হচ্ছে ভাষার সংখ্যা কি শুধু বেড়েই যায় দিন দিন? নাকি কমতেও পারে? প্রসঙ্গত পেরুর অধিবাসী আমেদেওঁ এবং নেপালের অধিবাসী জ্ঞানীমায়া সেনের নাম উল্লেখ করা যায়। এঁরা যার যার মাতৃভাষার সর্বশেষ ভাষাভাষী। এঁদের ভাষা যথাক্রমে ‘তাসিরো’ এবং ‘কুসুন্দা’। এই দুই ভাষার দুই ভাষীর মৃত্যুতে ভাষা দুটিরও মৃত্যু ঘটবে। তবে আশার কথা ভাষা দুটির সংরক্ষণে দুই দেশের সরকারই উদ্যোগী। জানা গেছে দুটি ভাষারই আলাদা অভিধান তৈরি করা হয়েছে প্রচলিত শব্দভাণ্ডার নিয়ে। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রচলিত গানের রেকর্ড, কিছু লোককথা, গল্পও এরূপ সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার আওতাধীন।

এবার ফিরি ৭০৯৭ ভাষার কথায়। এত এত ভাষা, জানা যায় সাড়ে তিন হাজারের মতো ভাষার রয়েছে লিখিত রূপ। বাকিগুলো শুধু মুখে মুখেই প্রচলিত। যেসব ভাষায় লিখিত রূপ পাওয়া যায়, সেসবে রয়েছে ৪৬ ধরণের বর্ণমালার চল। তবে লিখিত হোক বা মৌখিক, সব ভাষা কিন্তু সমানভাবে প্রচলিত নয়। ভাষাভাষী জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাষার গুরুত্ব নিরূপিত হয়। অবশ্য আগের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ‘কুসুন্দা’ ভাষা মৃতপ্রায় হলেও তার কিন্তু ভালোই গুরুত্ব আছে বলে জানা যায়! পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি ভাষাভাষী মানুষের ব্যবহৃত ভাষা ২৩ টি। প্রশ্ন হচ্ছে, একটা মানুষের পক্ষে ২৩ ভাষা জানা কতটা বাস্তবসম্মত? বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানতেন ১৮ টি ভাষা। সবার পক্ষে এরকম প্রসঙ্গব্যক্তিত্ব হওয়া সম্ভব নয়।

আমরা যদি একজন ইংরেজ, একজন আরবীয় আর একজন বাঙালিকে এক টেবিলে বসিয়ে একটি বাক্য উচ্চারণ করতে বলি – কলমটার দাম ত্রিশ টাকা – তাহলে যে ঘটনাটি ঘটবে তা হলো – বাঙালি ঠিকঠাকই উচ্চারণ করে দেবে। বিপত্তি ঘটবে ইংরেজ আর আরবীয়কে নিয়ে। একদিকে ইংরেজ বলবে – কলমটার ডাম ট্রিশ টাকা, অন্যদিকে আরব লোকটি তার আরবি উচ্চারণে বলবে কলমতার দাম ত্রিশ তাকা। এর কারণ হচ্ছে, বাঙলায় /ত/, /ট/ – দুটি ধ্বনি থাকলেও ইংরেজিতে /ত/ নেই, তাই ইংরেজ T দিয়ে /ত/ – এর কাজ সেরে নেবে। অনুরূপে আরবি বর্ণমালায় /ট/ না থাকায় \ت\ অথবা \ط\ দিয়ে /ট/ – প্রয়োজন মেটাবে। এতে আপাতদৃষ্টিতে দোষের কিছু নেই। সমস্যাটা হচ্ছে অন্য ভাষার সকল বর্ণের সঠিক প্রতিস্থাপক বর্ণ সকল ভাষায় নেই। ফলে অর্থগত বিভ্রান্তির মুখেও পড়তে হয় সচরাচর। উদাহরণস্বরূপ পাশ্চাত্যের কাপড়ের বাজারে গিয়ে আমরা Zipper এর বদলে Jipper চেয়ে বসলে প্রথমে বিপাকে পড়বে দোকানি, পরবর্তীতে অপদস্থ হবো আমরা। এই অম্লমধুর সমস্যা থেকে দূরে থাকতে ধ্বনিতত্ত্বের জ্ঞান থাকা খুব প্রয়োজন। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এই সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা (International Phonetic Alphabet বা IPA) । এ বর্ণমালার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সব মানবীয় ভাষার ধ্বনিসমূহকে নিজের আওতায় নিয়ে আসা। IPA তে মোট ১০৭ টি বর্ণ, ৫২ টি অনুচিহ্ন এবং ৪ টি ছান্দিক চিহ্নের উল্লেখ পাওয়া যায়।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় বাচ্চারা সাধারণত বাঙলা, ইংরেজি এবং আরবি পড়ে ছোটবেলা থেকে। আরবির চর্চাটা শুধু কোরআনশিক্ষায় সীমাবদ্ধ এদেশে। দৈনন্দিন কাজে আরবির ব্যবহার যতটুকুই আমরা করি, জেনে না জেনে বিক্ষিপ্তভাবে শব্দের ব্যবহারে সীমাবদ্ধ তা। বাকি থাকে বাঙলা আর ইংরেজি। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নম্বর পাওয়ার জন্য বাঙলা পড়ে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী। এরপর চাকরির বাজারে ইংরেজির অতিচাহিদায় বাঙলা শুধু মাতৃভাষা হিসেবেই থেকে যায়। সবাই হয়ে যায় ইংরেজির পূজারি। বাঙলা এক্ষেত্রে অবহেলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ নবম-দশম শ্রেণীর বাঙলা ব্যাকরণ নিয়ে অনেকেরই অনেক ধরণের মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ধ্বনিতত্ত্ব অংশটিকে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কঠিন ভাবে। এর কারণ হিসেবে বোধহয় এটাই যথেষ্ট যে, ধ্বনিতত্ত্বের পরিধি ব্যাপক। শিক্ষকদের বেশিরভাগের মধ্যেও ধ্বনিতত্ত্বকে কঠিন বা জটিল বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচয় করানোর প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে সে বিষয়কে সহজীকরণের পথে হাঁটার লক্ষণ কম।

শুদ্ধ উচ্চারণে বাঙলা পড়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষেরই আছে। এই শুদ্ধতা কেবল শুদ্ধ চলিত বাঙলার পঠনপাঠনে সীমাবদ্ধ – এমন নয়। যেহেতু ধ্বনি ভাষার মূল একক, আমরা যদি বাঙলা ধ্বনিগুলোর প্রতিটির শুদ্ধ উচ্চারণ জানি, তাহলে আপনিতেই তথাকথিত শুদ্ধ চলিত ভাষা বেরোবে আমাদের মুখ থেকে। এজন্য আমাদের জানতে হবে IPA এর মাত্র ছাব্বিশটি প্রতীকের সঠিক ব্যবহার। এগুলোর মধ্যে বাঙলা স্বরধ্বনি নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ৬ টি। বাকি ২০ টির কাজ যৌগিক স্বর এবং ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিস্থাপন।

IPA অনুযায়ী বাঙলা স্বরধ্বনি (উচ্চারণের সময় ঠোঁটের অবস্থা বিবেচনায় ক্রম করা):

ই = i

এ = e

অ্যা = æ

আ = a

অ = ɔ

ও = o

উ = u

IPA অনুয়ায়ী যৌগিক স্বরের প্রতিস্থাপন:

ঐ = oi̯

ঔ = ‌ou̯

IPA অনুযায়ী ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিস্থাপন:

ক্ = k

খ্ = kʰ

গ্ = ɡ

ঘ্ = ɡʰ

ঙ্ = ং = ŋ

চ্ = c

ছ্ = cʰ

*জ্ = য্ = ɟ

ঝ্ = ɟʰ

ট্ = t

ঠ্ = tʰ

ড্ = d

ঢ্ = dʰ

ত্ = ৎ = t̪

থ্ = t̪ʰ

দ্ = d̪

ধ্ = d̪ʰ

ন্ = ণ্ = ঞ্ = n

প্ = p

ফ্ = pʰ

ব্ = b

ভ্ = bʰ

ম্ = m

র্ = r

ল্ = l

শ্ = ষ্ = ʃ

স্ = s

হ্ = h

ড়্ = ɽ

ঢ়়্ = ɽʰ

ঁ =   ̃

দ্রষ্টব্য – (ঙ্,ং), (জ্, য্), (ত্, ৎ), (ন্, ণ্, ঞ্), (শ্, ষ্) সেটসমূহের সংশ্লিষ্ট প্রতিস্থাপক একই। কারণ, বাঙলায় বিশেষ ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবেশ ছাড়া এদের উচ্চারণ প্রায় অভিন্ন।

আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার গুরুত্ব:

১. প্রমিত উচ্চারণ শিক্ষায় আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা প্রয়োজন। যেমন – অকূল শব্দটির প্রমিত উচ্চারণ ওকুল (okul) কিন্তু অপারগ শব্দটির প্রমিত উচ্চারণ অপারোগ (ɔparog)। কেবল বাঙলা অথবা ইংরেজি বর্ণে এরূপ প্রমিতি প্রতিবর্ণীকরণযোগ্য নয়। কারণ, ধ্বনিগত বিচারে স্বয়ংসম্পূর্ণ বর্ণমালা পাওয়া যায় না বললেই চলে।

২. আঞ্চলিক ভাষার রূপমূল নির্দেশে প্রত্যক্ষ ব্যবহার রয়েছে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার। যেমন – মেয়ে শব্দটি প্রমিত উচ্চারণে দ্বিস্বর (mee) /ee/ অথচ উপভাষা অঞ্চলের প্রভাবে ত্রিস্বর হয়ে যেতে পারে – মাইয়া (maia) /aia/‌ আবার, তার শব্দটি t̪ar থেকে hær অর্থাৎ হ্যার হয়ে যায় কোনো কোনো উপভাষায়। এরকম রূপমূল নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট ভাষায় পুরোপুরি সম্ভব নয়। কারণ সব ধ্বনির সংশ্লিষ্ট বর্ণ বর্ণমালায় নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে যেমন /æ/ ধ্বনির জন্য বর্ণ বাঙলা বর্ণমালায় নেই।

৩. প্রায় সমোচ্চারিত শব্দজোটের সকলের সঠিক উচ্চারণ জানাটা দরকার। অন্যথায় অর্থবিভ্রাট ঘটতে পারে। যেমন – taste শব্দের সঠিক উচ্চারণ /teist/, verb হিসেবে যার অর্থ স্বাদ গ্রহণ করা। আবার test শব্দের সঠিক উচ্চারণ /test/, verb হিসেবে পরীক্ষা করা অর্থে ব্যবহৃত। সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার অনুসৃতি জরুরি। টয়লেটের ফ্লাশে লেখা থাকতে পারে properly tested. যদি কেউ বলে the flush is properly tasted, সেক্ষেত্রে অর্থবিভ্রাট কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, ভাবা যায়?

৪. আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজিভীতি প্রকট। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ভাষাশিক্ষার দুর্বল ভিত। কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থা বিশেষত ইংরেজিতে জোর দিলেও‍, অভিভাবকসহ সকলে এ ব্যবস্থার সুবিধা নিতে প্রস্তুত নন এখনো। এর বাইরে কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার বিপক্ষে কিছু যুক্তিযুক্ত সমালোচনা রয়েছে। এরকম অনেক শিক্ষার্থী দেখা যায়, যারা ইংরেজির সকল বর্ণ চিনলেও একটা বাক্য, কোনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটা শব্দ ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেনা। এ সমস্যা দূর করতে হলে কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালার শিক্ষা জরুরি। এতে ভাষার ভিত মজবুত হবে সকল শিশুর।

৫. বিশ্বায়নের এই যুগে বিদেশি ভাষার শিক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বৈশ্বিক মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাই বিদেশি ভাষা বোঝার উপযোগী শিক্ষার্থী গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা পাঠক্রমভুক্ত করা।

[* জ্ = য্ = ɟ তর্কাতীত নয়। জ্ এবং য্ বাস্তবে উচ্চারণগতভাবে আলাদা। ]

  লেখক : স্নাতক(সম্মান) শিক্ষার্থী, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর