রেজওয়ান আহমেদ
“না, তুমি আমারে ভুলতে পারবা না। কারণ, আমি তোমারে এ্যান্ড্রু কিশোর, কিশোর কুমার, কুমার শানু – একসাথে বাইট্টা এ্যান্ড্রু কিশোর কুমার শানু বানামু।”
১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আনন্দ অশ্রু’ সিনেমার একটি সংলাপ এমনই ছিল। সিনেমার ভেতর ব্র্যান্ডিংয়ের সংস্কৃতি অনেকদিনের। এখানে কিশোর কুমার এবং কুমার শানুর সাথে সমান্তরালে উচ্চারিত নামটি যাঁর, তাঁকে বাঙলা সিনেমায় প্লেব্যাক ইতিহাসের প্রবাদ পুরুষ বলা যায়।
নায়করাজ রাজ্জাক থেকে শুরু করে শাকিব খান পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্যই তিনি গেয়েছেন। রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, সালমান শাহ, রিয়াজ, মান্না, রুবেল, শাকিব খান – এঁরা প্রত্যেকেই একা সিনেমার কাহিনী টেনে নিতে পারদর্শী। কিন্তু সিনেমার গানের বেলায় দু-তিন প্রজন্ম ধরে ইন্ডাস্ট্রি টেনে নিয়ে গেছেন এ্যান্ড্রু কিশোর। বলা যায় আশি এবং নব্বই দশকের বাঙলা সিনেমাগুলোর সত্তর ভাগেরও বেশি গান তাঁর গাওয়া। সেগুলোর বেশিরভাগই মানুষের মুখে মুখে এখনও ফিরছে।
তাঁর গাওয়া গানগুলোতে রোমান্স, বিরহ, জীবন, মৃত্যু, আধ্যাত্মিকতা, লৌকিকতা – সবই উঠে এসেছে। ‘কণ্ঠের জাদুকর’ হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা হামিং, দীর্ঘস্বরের টানে শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রাখতে এ্যান্ড্রু কিশোরের বিকল্প কেউ ছিল না, হয়তো আসবেও না কেউ। অডিও ইন্ডাস্ট্রি এখন ভার্চুয়াল হয়ে গেছে। আর তাতে কণ্ঠনৈপুণ্য অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে যন্ত্রের যন্ত্রণার আড়ালে। এরকম একটা সময়েই চলে গেলেন আমাদের কণ্ঠশ্রমিক (প্রথম আলোকে দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে নিজেকে কণ্ঠশ্রমিকই দাবি করেছিলেন তিনি)। অবলীলায় স্বীকার করেছিলেন – তিনি শুধু গায়কীটাই বোঝেন, কথা আর সুরের বিষয়ে অজ্ঞ।
এ্যান্ড্রু কিশোরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে – আমার সারা দেহ খেও গো মাটি, ডাক দিয়াছেন দয়াল, আমার বুকের মধ্যিখানে, আমার বাবার মুখে, আমার গোরুর গাড়িতে, ভেঙেছে পিঞ্জর, প্রেমের সমাধি ভেঙে, বেদের মেয়ে জোছনা, এখানে দুজনে নির্জনে, ভালো আছি ভালো থেকো, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, সব সখিরে পার করিতে, গান আমি গেয়ে যাব এই আসরে, জীবনের গল্প, তুমি আমার কত চেনা, হায়রে মানুষ, পড়ে না চোখের পলক, ঐ চাঁদ মুখে যেন, তুমি আমার জীবন, আমি পাথরে ফুল ফোটাব, কারে দেখাব মনের দুঃখ ইত্যাদি। আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রমুখ গুণী সুর-সঙ্গীতকারের সাথে নিয়মিত কাজ করতেন তিনি।
সব ধরণের গানের কাজ করলেও তাঁর কণ্ঠের মায়া বিশেষ করে ফোক গানের জন্য উপযোগী ছিল বলে মনে হয়। সম্ভবত সে কারণেই ফোক ফ্যান্টাসি এবং গ্রামীণ সাহিত্যনির্ভর ছবির জিংগেলধর্মী আধ্যাত্মিক গানেও তিনি ছিলেন অটোমেটিক চয়েজ। কাকতালীয়ভাবেই হয়তো ‘হাজার বছর ধরে’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় ‘এই দুনিয়া দুইদিনেরই মুসাফিরখানা’ জিংগেলে তাঁর বিকল্প কাউকে খুঁজে পাওয়াটা খুবই কঠিন।
শেষভাগে এসে আবার শুরুতে ফিরে যেতে হয় – সেই কিশোর কুমার প্রসঙ্গে। এ্যান্ড্রু কিশোরের মা নিজের প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের নামে ছেলের নাম রেখেছিলেন। একজন কিশোরের এ্যান্ড্রু কিশোর হয়ে ওঠার গল্পে জীবনসঙ্গী হিসেবে সবচে বড় অবদান যার, সেই লিপিকা এ্যান্ড্রুকে শেষের দিকে বলেছিলেন – পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয়ো না।
আমাদেরও আবার মনে পড়ে, পড়বে পুরানো কথা। মনে পড়বে প্রথম শোনা এ্যান্ড্রু কিশোরের গান – পদ্মপাতার পানি নয়/দিনযাপনের গ্লানি নয়…।
ভোলা যায় না। কারণ – নিজেকে সবাই ভুলতে পারে, কাউকে কাউকে ভোলা যায় না। আমরা আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখেই যাই, লিখেই যাব। কখনো উত্তর না পেলেও।
(লেখক – তরুণ কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।)