* মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব।।
প্রথম পর্ব
(অ) কাওরান বাজারে -সোহাগের চায়ের দোকান” নামে একটি চায়ের দোকান আছে। এর পাশের্^ই ইত্তেফাক ও মানব জমিনের অফিস। তাছাড়া এর অনতিদূরে ভোরের পাতা ও এটিএন বাংলার কার্যালয়। সত্যি কথা বলতে কি, এই চায়ের দোকানে এই সকল সংগঠন বা অফিসের লোক ভীড় করেন। তাছাড়া বড় মনের ব্যক্তিত্ব লেখক মুকুল ভাই খুলনা থেকে ব্যবসার কাজে ঢাকায় আসলে এই চায়ের দোকানে আড্ডায় শরীক হন। এখানেই শেষ নয়, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলার বিভাগীয় প্রধান ড. মিল্টন বিশ^াস খুব কম আসলেও, যখন আসেন তখন আড্ডায় অংশ গ্রহণ করতে এতটুকু কার্পণ্য করেন না। আর আমার অফিসটিও কাওরান বাজারের কাব্যকস বিল্ডিংয়ে। যেহেতু সোহাগের চায়ের দোকানে আমার সমমনা ও পূর্ব পরিচিত ঐ সকল লোক আসেন। তাই সেখানে চা খেতে যাই। চা খাওয়া বললে ভুল হবে। সত্যিকারার্থে ওদের সঙ্গে গল্পগুজব তথা আড্ডা দিতে যাই। একদা চা খাওয়া সহ গল্পগুজবের সময় ইত্তেফাকের সহ সম্পাদক সৌরভ জাহাঙ্গীর তার সেলফোন তথা মোবাইলে, কি ভেবে যেন হঠাৎ একটি গান শুনালো। গানটি হলো স্বয়ং মান্নাদের কন্ঠে “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…। তখন ভোরের পাতার সহ সম্পাদক আলমগীর রেজা বলল যে এই গানের একটি মধুময় ইতিহাস আছে; তোমরা কি জানো ? আমি বললাম, জানিনা। ভালই হলো, তোমার মুখে এই গানের শানেনুযুল জানতে পারবো। আলমগীর রেজা সদ্য পরিবেশিত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল। আসলে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজের আড্ডাকে উপজীব্য করে রচিত এ গানটি। দুই বাংলার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। গানটি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। উল্লেখ্য যে, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও নচিকেতা ঘোষ দুজনে ছিলেন পরম বন্ধু। কেবল বন্ধু বললে কম বলা হবে, তাঁরা ছিলেন একে অন্যর আত্মা। আর কলেজ জীবন থেকেই বন্ধুত্ব তাঁদের। জীবনভর বন্ধুত্বের ভার বহন করেছেন দুজনেই। শুধু দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বলতে গেলে দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বের পরিসর বিস্তৃত। বস্তুত দুজনই ছিলেন গানপাগল মানুষ। একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং আরেকজন গীতিকার। ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের সুবাদে নচিকেতার মতো তাঁর পরিবারের সকলেই উচ্চ মাত্রায় ভালোবাসতেন গৌরীপ্রসন্নকে। এদিকে গৌরীপ্রসন্ন গান তৈরীর কাজে তো যেতেনই; তাছাড়া অবসরের প্রায় অনেকটা সময় কাটাতেন নচিকেতার শামবাজারের বাসায়। মজার ব্যাপার হলো যে গৌরীপ্রসন্ন বন্ধু নাচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তিকে নিজ পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। সময়ের পরিক্রমায় সুপর্নকান্তি বড় হয়ে উঠে। তখন চারদিকে বাবা নচিকেতা ঘোষের জয়জয়কার। আর সুপর্ণকান্তিও বাবার পথে হাঁটেন। শুরু হয় তাঁর সুর সাধনার কাজ। তখন মাত্র তিনি কয়েকটি গানের সুর করেছেন। এদিকে একদা গান তৈরির কাজে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার নচিকেতার বাসায় ছিলেন। সেদিন সুপর্ণকান্তি দেরিতে বাসায় ফিরেন। তিনি বাসায় ঢুকতে গৌরীপ্রসন্নর মুখোমুখী হন। তখন তিনি পিতৃত্বের আমেজে জোর দিয়ে প্রশ্ন করলেন যে, কি বাবা তুমি বাইরে আড্ডা মেরে কাটাচ্ছ ? এতে মিষ্টি সুরে কথা কাটাকাটি হয় এবং এক পর্যায়ে সুপর্নকান্তি কফি হাউজের আড্ডা নিয়ে গান লেখার ব্যাপারে গৌরীপ্রসন্নকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনিও হাসিমুখে চ্যালেঞ্জ গ্রহণপূর্বক তখনই সেখানে এক বৈঠকে লিখে ফেললেন এই কালজয়ী গান। আলী রেজার কথার অব্যবহিত পর এই গানটির পূর্বাপর আলোচনা হলো এবং গল্প গুজবের মূখ্য বিষয় হয়ে উঠলো নানামুখী বিষয়াদি। এ নিয়ে ছোট বেলার আড্ডা থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবন, চাকুরীকাল, সামাজিক এবং পরিবারের কে কোথায় কি করে, বলতে গেলে কিছুই বাদ যায় না। আড্ডা কথাটির সূত্র ধরে মানব জমিনের সহ সম্পাদক বলে উঠলেন যে সারা পৃথিবীই আড্ডাখানা। আর আড্ডার বড় জায়গা হলো প্রত্যেক দেশের পার্লামেন্ট বা সংসদ। তখন মনের সায়েরে আড্ডা কথাটি একশো মাইল স্পিডে টেউ খেলে গেলো এবং ভাবতে লাগলাম, এ নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। তৎপর মনটা গুছিয়ে নিয়ে ১২৩ বি, গ্রীণ রোডস্থ নিজ বাড়ীর ছাদের উপরে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে সচেষ্ট হই।
(আ) মূলত আড্ডার শাখা প্রশাখা এত বিস্তৃত, তা বলে শেষ করা যাবে না। আর আড্ডার শুরু নিয়ে বিভিন্ন মনীষীরা নানা কথা বলে থাকেন। তবে যতদূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, আদিমযুগে টোটেম গ্রুপের আওতায় মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হতে আরম্ভ করে, তখন এটি ধীরে ধীরে কৃষ্টির ধারায় প্রবর্তিত হয়। তাই বলতে দ্বিধা নেই যে, আড্ডার ইতিহাস মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের ইতিহাসের সম-সাময়িক। মূলত আড্ডা হিন্দি শব্দ, যা বাংলা ভাষায় এসে সমহিমান অবস্থান নিয়ে আছে। এর বুৎপত্তি শব্দের মূল অর্থ খুজে পাওয়া যায় পাখির জন্য তৈরী পার্চিং স্পটে এবং শব্দের নাম মাত্র রুপ হিসেবে একটি গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের অবস্থান বা নীড়ের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু ইংরেজিতে এর সমান্তরাল কোন শব্দ নেই। তবে ২০০৪ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এদিকে ভাষা বিশারদগণ Gossiping বা Chatting বলে অভিহিত করে থাকেন। ÒDefacto, it is informal discussion without definite object, may be taken place any where, between two persons or more.” মোটামুটি এর অর্থ হলো গল্পগুজব, গল্পস্বল্প, কথাবার্তা, খোশগল্প ইত্যাদি।
বস্তুত আড্ডা নির্মল ও নির্ভেজাল আনন্দের বিষয়। আড্ডা দিয়ে শুধু সময়ই কাটানো হয় না, যুগপৎ এ থেকে অনেক সময় অনেক কিছু জানা বা শেখাও যায়। আড্ডা সরাসরি কারো বিরুদ্ধে হয় না এবং আপাত: দৃষ্টিতে এতে কারো কোনো ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা থেকে শুরু করে ভ্রমণবর্ণনা, রোমাঞ্চ, প্রেম, দেশ, ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, চলচ্চিত্র, সমসাময়িক প্রসঙ্গ, সমাজ, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, ইত্যাদি যে কোনো কিছুই হতে পারে আড্ডার মাল-মসলা। গুরুত্বপূর্ণ বা হালকা সব বিষয়েই আলোচিত হয় আড্ডার আসরে। কেউ কেউ আবার গুরুত্বপূর্ণ কথাকে হালকাভাবে রসিয়ে রসিয়ে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেন। এমনও লোক আছেন, যাঁরা কৌতুক এবং চুটকি বলে আড্ডাকে জমিয়ে রাখেন। আবার কারো কারো স্বাভাবিক কথায় অন্যরা আড্ডায় আমোদিত হন। আড্ডার ধরন অনুযায়ী বহু প্রকারের হতে পারে। তবে মোটামুটি যে সকলগুলো সচরাচর চোখে পড়ে, তা হলো: সাহিত্যের আড্ডা, স্মৃতিরমন্থনের আড্ডা, নির্মল খুনসুটির আড্ডা, রাজনীতির আড্ডা, পেশাগত আড্ডা, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আড্ডা; ইত্যাদি; ইত্যাদি। আড্ডায় মানুষের জ্ঞানভান্ডার বৃদ্ধি পায়। ভালো আড্ডা, ভালো কাজের সূচনা করে। আবার মন্দ আড্ডা সমাজের ক্ষতি সাধন করে। পাড়া বা মহল্লার কিশোর-তরুণ-যুবকদের ‘আড্ডা’ অভিভাবকদের জন্য অনেক সময় আতংকের কারন হয়ে উঠে। তাছাড়া মদের আড্ডা, জুয়ার আড্ডা ও অশ্লীল আড্ডার ন্যায় অন্যান্য আড্ডা সমাজের জন্য ভয়ংকর। আবার আড্ডা থেকে মহৎ কাজেরও সূচনা হয়, যার ভূড়ি ভূড়ি উদাহরন আছে।
(ই) যে ভাবেই বলি না কেন, আড্ডা নিয়ে কিছু বলতে গেলে সক্রেটিসের কথা উঠে আসে। প্রাচীন গ্রীসের এই মহান দার্শনিক সক্রেটিস তাঁর শিষ্যদের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রদান করতেন না। তিনি আড্ডার ছলে নিজের দর্শন ও চিন্তা ছড়িয়ে দিতেন। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারই ছিল তার শিক্ষায়তন। তিনি যেখানেই যাকে পেতেন, তাঁর সাথেই আড্ডায় মেতে উঠতেন। তিনি মৌলিক কিছু প্রশ্ন করে আড্ডার সূচনা করতেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের উত্তর শুনে তাঁর মতো করে স্বীকার করে নিতেন। কিন্তু এর পর যুক্তির মাধ্যমে সেই মতকে খ-ন করতেন। এই ভাবে সক্রেটিস প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই দার্শনিক আড্ডা চালিয়ে যেতেন, যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলতো। সেই কালে গ্রীসের যেখানেই লোকজনের ভিড়, সেখানেই খুঁজে পাওয়া যেত সক্রেটিসকে। তিনি লোকের কাছ থেকে জানার জন্য প্রশ্ন করতেন। প্রথমে প্রতিপক্ষের জন্য যুক্তির ফাঁদ পাততেন এবং একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকতেন। যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়, ততক্ষণ প্রশ্ন চলতেই থাকতো। এইভাবে সক্রেটিসের সাথে আড্ডার কথোপকথনই দার্শনিক প্লেটো লিখে গেছেন। আড্ডার মধ্য দিয়ে তর্ক বিচারের পদ্ধতিকে দার্শনিকরা আস্তি-নাস্তিমূলক পদ্ধতি নাম দিয়েছেন। মূলত সক্রেটিস এই পদ্ধতির সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্য প্লেটো এবং প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল সেইধারাকে পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করেন।
দ্বিতীয় পর্ব
(ঈ) বাঙ্গালীরা আড্ডা প্রিয়। কাছের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বাঙ্গালীদের ক্লান্তি নেই। কাজে একঘেয়ামি হলেও, আড্ডাতে তার এতটুকু নেই। বলতে গেলে বাঙ্গালীদের আড্ডা না দিলে ভাত হজম হয় না। বাঙালির সত্ত্বাকে আড্ডা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। অবশ্য এর পেছনে যৌথ পরিবারের দর্শন বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। যাহোক, দেশে হোক বা বিদেশে হোক বা বিয়ে বাড়িতে হোক, এমনকি মৃতের বাড়িতেই হোক, কোন না কোন ভাবে বাঙালিরা আড্ডা দিয়ে থাকে। বাঙালিরা সুখে আড্ডা দেয়। আবার অসুখেও আড্ডা দেয়। তাই বাঙালি রোগীকে দেখতে যেয়ে তাকে ঘিরে হাসপাতালেও আড্ডাবাজ হতে দ্বিধাবোধ করে না। মূলত আড্ডা দিতে প্রয়োজন হয় একমনের একাধিক মানুষের। স্বার্থপরতার কালো ছায়া থাকলে আড্ডা দীর্ঘস্থায়ী ও প্রাণবন্ত হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য আড্ডায় কেউ অংশ নিলে এর মূল বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়। বস্তুত আড্ডায় সবার কথা বলার সুযোগ থাকতে হয়। ছোট-বড় সকল সদস্যের পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আড্ডার প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার কেউ এককভাবে আড্ডার কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করলে আড্ডা ক্রমান্বয়ে নির্জীব হয়ে পড়ে। আসলে বাঙালির আড্ডায় ঘুরে ফিরে যে বিষয়টি অধিক আলোচিত হয়- তা হলো রাজনীতি বা সমসাময়িক ইস্যূ। গ্রাম বাংলার হাট-বাজারে আড্ডা বা শহরে অফিসার্স মেসের আড্ডা বা প্রবাসীর আড্ডাই হোক না কেন, সর্বত্র একটা বিষয় ঘুরেফিরে আলোচিত হয়, যা হলো-চলতি পরিস্থিতিসহ দেশের রাজনীতির নানা রকম কথা। এদিকে শিক্ষিত-রুচিবান বাঙালির আড্ডা ও অশিক্ষিত-রুচিহীন বাঙ্গালির আড্ডার নরমে (ঘড়ৎস) ভিন্নতা থাকে। আর বাঙালি পুরুষের আড্ডা এবং বাঙালি নারীর আড্ডায়ও আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। পুরুষের আড্ডায় সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতো বাড়তি চমক সৃষ্টি করে। তবে নারীর আড্ডায় একক পুরুষকে কেমন যেন বেমানান ও অসস্তিকর করে তুলে। আর শিক্ষিতের আড্ডায় মূর্খরা বুঝে না বুঝে হাসে। কিশোরীদের আড্ডায় কথার চেয়ে রোমান্টিক হাসি হয় বেশী। আবহমান বাঙালি জীবন চক্রে শিশুদের আড্ডা হয় সন্ধ্যা রাতে বা বর্ষনমূখর সময়ে, সে আড্ডায় ঠাকুমার ঝুলি, আরব্য রজনী ও ভুত-পেতœীর গল্প শোনাতে হয় দাদি-নানীকে। পেশাজীবীদের মধ্যে আইনজীবী, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত বিষয় অধিক গুরুত্ব পায়। চাকরিজীবী বাঙ্গালির আড্ডায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা ‘বস’কে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। মজার ব্যাপার হলো যে, গৃহিণীদের আড্ডায় ঘুরেফিরে আসে বাড়ীর কাজের বুয়া ও নিজ ছেলে-মেয়েদের প্রসঙ্গে। পুরুষের আড্ডা চলাকালীন সময়ে এক পর্যায়ে সুন্দরী নারীর কথা উঠে আসে; তরুণীদের আড্ডায় ‘ফ্যাশন’ এবং হুজুরদের আড্ডায় থাকে ‘বেপর্দা নারী’সহ ধর্মীয় নীতিবাক্যর কথা। আড্ডা নিয়ে কথা বলতে গেলে বিভিন্ন ফর্মের আদলে চাপামারা, গুলতানি, গ্যাঁজানো, প্যাঁচালপাড়া, বকবক, ইত্যাদি সমার্থক শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে। অবশ্য এ শব্দগুলো আড্ডাকে বিরক্তিকর ও বিব্রতকর করে তুলে। বাঙালির আড্ডায় অনেক সময় সবকিছুকে অক্রিম করে পরচর্চা, পরনিন্দার দিকে যায়। যে ভাবেই বলি না কেন, পরচর্চা ও পরনিন্দা ব্যতীত বাঙালির আড্ডা যেন অপূর্ণ থাকে। এদিকে দলীয় কার্যালয়ে রাজনীতিবিদদের আড্ডা বসে, সেখানে নিজ দল সহ অন্য দলের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়। বিত্তবানদের আড্ডাখানায় অধিক অর্থপ্রাপ্তির কর্মকান্ড ঘুরপাক খায় এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আড্ডাখানা ক্যান্টিনে। এখানে উদহারন হিসেবে মধুর ক্যান্টিনের কথা উঠে আসে। এদিকে বাঙালি কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জন্য আড্ডা হলো অমৃত সুধা। বলতে গেলে, একুশের বই মেলা দেশের কবি-সাহিত্যিকদের সবচেয়ে কাঙ্খিত আড্ডাস্থল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে কবি গুরু রবী ঠাকুরের জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ী আড্ডার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সাহিত্যের আড্ডার দিক দিয়ে সারা ভারতবর্ষের চোখ ছিল এই ঠাকুরের বাড়ীর দিকে।
তৃতীয় পর্ব
(উ) আড্ডা নিয়ে কথা বলতে গেলে, যে আড্ডা সর্বাগ্রে আসে, সেটি হলো শিল্প-সাহিত্য। সঙ্গত কারনেই আমি সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গের ৫০ দশকের গোড়ার দিকের কথা বলছি। সে সময়ে সাহিত্যের আড্ডা বলতে যা বোঝায়, সেই আমেজ ও বৈশিষ্ট্যর আড্ডা তেমন ছিল না। উল্লেখ্য যে, সে কালের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সমকাল’-এর সম্পাদক কবি ও নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফরের কথা না বললে কমতি থেকে যাবে। তখন সমকাল পত্রিকাটির অফিস ছিল মতিঝিলের ডিআইটি রোডে। উক্ত সমকালের অফিসে বসতো ৬০ দশকের কবিদের প্রাণবন্ত আড্ডা। এতে মধ্যমণি হিসেবে সিকান্দার আবু জাফর থাকলেও, সেই আড্ডার অন্যান্য কলাকুশলীরা ছিলেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আবু হেনা মুস্তফা কামাল, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, জিয়া হায়দার, প্রজেশ রায়, কায়সুল হক, ফজল শাহাবউদ্দিন, কাইয়ুম চৌধুরী, প্রমুখ। আর কবি-শিল্পী ছাড়াও আসতেন মজার গল্পকারেরা। এদিকে সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, জহির রায়হান এবং জনাকয়েক সাংবাদিকদের শিল্প সাহিত্যের আড্ডা বসতো পুরান ঢাকার প্রহলাল সাহার বিখ্যাত ‘বিউটি বোডিংয়ে। সেই আড্ডার মধ্যমণি থাকতেন কখনও সৈয়দ হক, কখনওবা মৃদুভাষী সবার প্রিয় বাচ্চু ভাই, বা কবি শামসুর রাহমান। আর আড্ডার সঙ্গদাতারা অনেকেই পরবর্তীতে কেউবা হয়েছেন বিশিষ্ট কবি এবং সংবাদ পাঠক। সে ক্ষেত্রে সংবাদ পাঠক কবি ইমরুল চৌধুরী এর কথা প্রণিধানযোগ্য।
এদিকে গুলিস্তান সিনেমা হলের উত্তর দিকের রেক্স নামের একটি রেস্টুরেন্টে ছিল; সেখানের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল বিদেশি কবি সাহিত্যিকদের গল্প-কবিতা। তবে সেখানে কবিতাকেই অধিক প্রাধান্য দেয়া হতো। আর সেখানে সচরাচর যাতায়াত করতেন প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান; গল্পকার বুলবুল চৌধুরী; ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হরিপদ দত্ত; কবি আবুল হাসান ও শহীদ কাদরী। সময় তো আর বসে থাকে না। এখন সঙ্গতকারনেই ষাটের মাঝামাঝি সময়ের আড্ডার ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করছি। এই মধ্যষাটে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতো মাসিক পরিক্রমা নামের একটি পত্রিকা। আর এ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। পত্রিকাটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল বাংলা একাডেমির অভ্যর্থনা কক্ষে। তৎকালীন করোগেটেড টিনের একটি দোচালা কামরার অভ্যর্থনা কক্ষে অনুষ্ঠিত এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শামসুর রাহমান, মুনীর চৌধুরী, শিল্পী কামরুল হাসান ও ঔপন্যাসিক সরদার জয়েনউদ্দিন। আর পরিক্রমা পত্রিকাটির সহযোগী সম্পাদক ছিলেন রশীদ হায়দার। সেই পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করেই মাসে একবার করে আড্ডা বসতো বাংলা একাডেমিতে। দুঃখের বিষয় হলো যে, সে পত্রিকার আয়ুস্কাল দীর্ঘ হয়নি। অবশ্য স্বল্প সময়েই পরিক্রমায় সমৃদ্ধ লেখা ছাপা হতো। আর তৎকালীন সময়ে গল্পকারদের ভেতরে শওকত আলী, আবু রুশদ, রশীদ করিম, সৈয়দ শামসুল হক, প্রমূখরাই ছিলেন অগ্রগণ্য। অবশ্য তাঁরাও নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে সাহিত্যের আসরে আড্ডা দিতেন সেকালের দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক কবি শামসুর রাহমানের কক্ষে। আর এখানে মাঝে মধ্যে আসতেন কবি আহসান হাবীব, ফজল শাহাবউদ্দিন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সহ অনেকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লার সম্পাদনায় সেই মধ্যষাটে পুরান ঢাকার ৬৮ নম্বর বেচারাম দেউরী থেকে বেড় হতো মাসিক পূর্বাণী। পরবর্তীতে এই মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক পাকিস্তানে। যাহোক, এঁদের অধিকাংশেরই জমজমাট আড্ডা বসতো সমকালের অফিসে।
(ঊ) এদিকে আড্ডার সবচেয়ে উপযোগী জায়গা হিসেবে গদ্য, পদ্য ও উপন্যাস লেখার জন্য ছিল নিরিবিলি বিউটি বোর্ডিং। কবি শামসুর রাহমান একাধিকবার লিখেছেন তাঁর প্রিয় বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডার মুখরোচকবিষয় সহ কবিতা লেখার কথা। এমনকি সৈয়দ শামসুল হক স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছে যে, তার বিখ্যাত উপন্যাস, গল্প, কবিতা সবই লিখেছিলেন ঐ বিউটি বোর্ডিংয়ে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের সেই ঐতিহ্যময় আড্ডা ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। সত্যি কথা বলতে কি, ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী সময়ে তারুণ্যে উদ্দীপ্ত সৃষ্টিধর্মী গুনীমানুষের আড্ডার স্থল ছিল নিউমার্কেটের মনিকো রেস্টুরেন্ট। উঠতি কবি, গল্পকার ও নাট্য অভিনেতাদের প্রায় প্রতিদিন বসতো শিল্প-সহিত্যের আড্ডা এই মনিকায়। তাছাড়া নিউমার্কেটের প্রগতি প্রকাশনীতে প্রায়শই যেতেন কবি আবু হেনা মুস্তফা কামাল, কবি হুমায়ুন আজাদ, কবি আব্দুল সাত্তার ও কবি আবু কায়সার। ড. আবু হেনা মুস্তফা কামাল যেদিন উপস্থিত থাকতেন, সেদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনদিক দিয়ে যে সময় পেরিয়ে যেতো, তা বুঝা যেতো না। মজার ব্যাপার হলো যে মনিকো রেষ্টুরেন্টে প্রতি রবিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর অবধি কবিদের আনাগোনায় সরগরম হয়ে উঠতো। আর সেখানে হাজির হতেন প্রথিতযশা কবিরা, যেমন- রফিক আজাদ; আব্দুল মান্নান সৈয়দ; অরুনাভ সরকার; মোহাম্মদ রফিক; নির্মলেন্দু গুন; আবুল হাসান; মহাদেব সাহা; রাজীব আহসান চৌধুরী; সানাউল হক খান; হাবীবুল্লাহ সিরাজী; মুহম্মদ নূরুল হুদা; জাহিদুল হক; অসীম সাহা; মাশুক চৌধুরী; আবিদ আজাদ; শিহাব সরকার; জাহাঙ্গীরুল ইসলাম; আবু করীম; মোস্তফা মীর; সরদার সিদ্দীকি; হাফিজুর রহমান; মোস্তফা মহীউদ্দিন ও হাসান হাফিজ সহ আরও অনেকে। অনেক সুধীজন বলে থাকেন যে, সাহিত্যের আড্ডা বলতে যা বুঝায়, তা হতো এই মনিকো রেষ্টেুরেন্টে।
তৎপর আড্ডার কথা বলতে গেলে বাংলা একাডেমির কথা চলে আসে। উল্লেখ্য যে, শিল্প-সাহিত্যের প্রাণবন্ত আড্ডা বসতো বাংলা এ্যাকাডেমিতে। বিশেষ করে কবি রফিক আজাদ ও রশীদ হায়দারের কক্ষে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই শিল্প সাহিত্যের আড্ডায় মাঝখানেই প্রতিমাসেই মাসিক উত্তরাধিকার এবং মাসিক ধানশালিকের দেশ বেড় হতো। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, যা হলো বাংলা একাডেমির প্রথম মহাপরিচালক ড. মাজহারুল ইসলাম। যিনি এ একাডেমিতে বেশ কজন যোগ্য লেখক ও কবিদের ডেকে নিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে ছিলেন সেলিনা হোসেন, আসাদ চৌধুরী, সুব্রত বড়ুয়া, রফিক আজাদ ও রশীদ হায়দারসহ আরও অনেকেই। মজার ব্যাপার হলো যে, বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার এবং ধান শালিকের দেশে যাঁরা লেখা দিতেন। তাঁরা আগে গিয়ে দেখতেন রফিক ভাই আছেন কিনা, থাকলে বসতো নবীনদের নিয়ে প্রাণবন্তু আড্ডা। অথচ দুঃখের বিষয়, শিল্প-সাহিত্যের সেই আড্ডা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই কালের গহব্বরে।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। এ ব্যাপারে উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের আড্ডাকে প্রাধান্য দিতেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর বিখ্যাত ‘দেশে বিদেশে আত্মজীবনীতে লিখেছেন বাঙালির আড্ডা প্রসঙ্গে। ঢাকা শহরে বইপাড়া নামে খ্যাত আজিজ মার্কেটে একসময় আড্ডা হতো। আর এই আজিজ মার্কেটের উত্তর দিকেই ছিল রেখায়ন নামের একটি ছবি আঁকার স্টুডিও। মালিক ছিলেন রাগীব আহসান। সেই রেখায়নের আড্ডা শুরু হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই। আর এখানে আসতেন আহমদ ছফা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, শাহনূর খান, রবিউল হুসাইন, মুহম্মদ নুরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ সিরাজী ও অসীম সাহাসহ অনেকে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আড্ডা বসতো নির্দলীয়ভাবে। ছফা ভাই যেদিন আসতেন, সেদিন তিনিই থাকতেন আড্ডার প্রধান ব্যক্তি। আর এই আড্ডায় আর্ট কলেজের নবীন শিল্পীদের মধ্য থেকে অনেকে যোগ দিতেন। যাহোক, রেখায়ন তখন ছিল শাহবাগের একমাত্র তরুণদের শিল্প-সাহিত্যের আড্ডার স্থল। শুধু আড্ডার স্থুল বললে কম বলা হবে, প্রেমিক-প্রেমিকাদের আনাগোনা কম হতো না ? কেননা, শিল্পী রাগীব আহসান ছিলেন উদারমনা ও মিষ্টি ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। তাই তিনি চা-মুড়ি ও কলা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করতেন, যা ছিল আড্ডার বাড়তি নিয়ামক। আসলে আড্ডাতে কোন রিফ্রেসমেন্ট না থাকলে, শুকনো হয়ে দাঁড়ায়। তাই বোধ হয় আড্ডাতে বাড়তি নিয়ামক হিসেবে চা, কফি, হালকা খাবার, মৌসুমী ফলফলাদি, ইত্যাদি যোগ হতে দেখা যায়। তাছাড়া আড্ডা যে কোন সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে মোক্ষম সময় হলো, বিকেল বা সন্ধ্যাবেলা। অবশ্য অনেকে ছুটির দিন বা অবসর সময় বেছে নেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, একটি লিটল ম্যাগাজিন ঘিরে যে লেখকগোষ্টি সৃষ্টি হয়। তখন এদের মধ্যে আড্ডা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এটি সাহিত্যের জন্য যে উপকারী, তা বলাই বাহুল্য।
চতুর্থ পর্ব
(ঋ) এ প্রবন্ধের স্বার্থে আড্ডা নিয়ে অতীতের কিছু কথায় আবার ফিরে যাই। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, নাটরের মহারাজা জগদানন্দ রায়ের তত্ত্বাবধানেও আড্ডার আয়োজন হতো। সেই আড্ডায় অংশ নিতেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ। রাখালদাস ছিলেন সুরসিক মানুষ। স্বল্পভাষী হওয়া সত্ত্বেও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ আড্ডায় একাকার হয়ে যেতে সময় নিতেন না মোটেও। এদিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয়, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা এবং পাশাপাশি প্রগতি, কালিকলম ও পূর্বাশা, ইত্যাদি পত্রিকাগুলো ঘিরে ভিন্ন ভিন্নভাবে আড্ডা হতো। এসব আড্ডা রবীন্দ্রবৃত্তের বাইরে এসে আধুনিক কবিতার জগৎ তৈরির ক্ষেত্রে রাখতো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। আর এর কা-ারিরা হলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চত্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রমুখ।
আরও এক আড্ডার খবর জানা যায় কলকাতার কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে, যা পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি। সেখানে নিয়মিত উপস্থিত হতেন প্রবোধকুমার স্যান্নাল, প্রমথনাথ বিশী, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত। এ আড্ডায় আরও উপস্থিত হতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সংস্কৃতি কলেজ থেকে সুশীলকুমার দে। এর অনেক পরে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে কৃত্তিবাস-এর আড্ডাটিও বেশ আলোচিত হয়। বস্তুত কৃত্তিবাস নিয়ে উন্মাতাল হয়ে উঠেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, তারাপদ রায়, প্রমুখ। উল্লেখ্য যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাস ১৯৫৩ সাল থেকে শুরু করে ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা পত্রিকা হিসাবে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেই সোনালী দিন আর নেই। এখন আর কাউকেই মিষ্টি কথার আদলে টেবিল চাপড়িয়ে আড্ডা দিতে খুব একটা দেখা যায় না। মানুষ সত্যই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এ প্রবণতা দিন দিন মানুষকে সঙ্গীহীন এবং একা করে দিচ্ছে। অথচ সৃষ্টিশীল যে-কোনো কাজের জন্য আড্ডা অপরিহার্য। শিল্প-সাহিত্য তো বটেই, সাধারণ জ্ঞান বিনিময়ের জন্যও দরকার হয় আড্ডার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্যাফেটেরিয়াভিত্তিক আড্ডা হয়। এর মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টের বিশ্বখ্যাত ক্যাফেটেরিয়া হল নিউইয়র্ক ক্যাফে। এখানে ১২০ বছর ধরে সগৌরবে চালু রয়েছে আড্ডা। সেখানকার প্রখ্যাত সব কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-ভাস্কর এ ক্যাফেটেরিয়ায় এসে আড্ডা দেন এবং তাঁদের এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি নেই। এ রকম আরও একটি আড্ডা হয় মিসরের রাজধানী কায়রোয়। স্থানীয় এ ক্যাফেতে উক্ত দেশের তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে থাকেন।
(এ) পূর্বেই বলেছি, আড্ডা সম্পর্কে যদি বলি, তাহলে একটি মোটা বই হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু প্রবন্ধের কলেবরের স্বার্থে তা সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ মাত্রই কম বেশি সমস্যায় থাকে। সাধারনত সেই সমস্যা মানুষকে অস্থির করে তুলে। কিন্তু আড্ডা চলার প্রাক্কালে কিছুটা সময় হলেও কথা বার্তার সারথী ধরে নিজকে হারিয়ে ফেলে বিধায় শূন্য বিন্দুতে অবস্থা নেয় বলে স্বস্থি ফিরে আসে। আর এই মহতী সময় কোন কিছু সৃষ্টির পথ উন্মোচিত করে থাকে। তাছাড়া জীবন চলার পথে কাজে বা কথাবার্তায় যেমন বিধি-নিষেধ মেনে আগাতে হয়। কিন্তু আড্ডায় তেমনটি নয় বলে খোলামেলা আলোচনার সূত্র ধরে নতুন কিছু জন্মানোর প্রয়াস পেয়ে থাকে। বস্তুত মানুষ সামাজিক জীব। তাই শাশ^ত ধারার একে অন্যের সাথে সঙ্গ ছাড়া চলা কঠিন। আর আড্ডার কোন বয়স নেই এবং জীবনের সেরা সময়গুলো মানুষ আড্ডার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে থাকে। মূলত মানুষ কিছু না কিছু স্মৃতি সারাজীবন ধরে বহন করে চললেও আড্ডার স্মৃতি অধিক দাগ কেটে থাকে। কোন গঠনমূলক সিদ্ধান্তে আসতে আড্ডার কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া অনেক তত্ত্ব ও আবিস্কার আড্ডার মাধ্যমে উঠে এসেছে। এদিকে ইদানিং মুখোমুখি আড্ডার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ভার্চুয়াল আড্ডা। ল্যাপটপ বা স্মার্ট মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে দূর-দূরান্তে থেকেও অনায়াসে এই মজার কাজটি করা যায়। দুঃখের বিষয় হলো যে ইদানিং আধুনিকতা ও এককেন্দ্রিকতার কারনে পারিবারিক আড্ডা আমরা ভুলতে বসেছি। ছোট বড় সবাই ফেসবুক ও ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত। তাই আমাদের ভালমন্দ কথা বলার ফুরসুৎ নেই। পরিশেষে এই বলে সমাপ্তি টানছি যে, প্রকারান্তরে আড্ডা হলো সঞ্জীবনী সুধা। হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা দূর করার ক্ষেত্রে মহৌষধ। সর্বোপরি জ্ঞান বিনিময়সহ সুস্থ্যতা ও মানসিক প্রশান্তির ক্ষেত্রে আড্ডা অসামান্য ভূমিকা রাখে।
সহায়ক সূত্রাদি:
১। উইকিপিডিয়া।
২। অনলাইন নিউজ:
(ক) দৈনিক প্রথম আলো
(খ) দৈনিক সরোবর
(গ) দৈনিক যুগান্তর
(ঘ) বাংলা নিউজ ২৪ ডট কম
(ঙ) সময়ের আলো
(চ) সিলেট টুডে ২৪
(ছ) কালের কন্ঠ
৩। লেখকের দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতা
৪। ইত্যাদি।
লেখক- বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।