* মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব*
অ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের দুররাজপুর ব্লকের অন্তর্গত লক্ষ্মীনারায়ণপুর পঞ্চায়েতের ভূবন বাবু; যিনি বাদাম বিক্রেতা। বাদাম বিক্রিকে ঘিরে গত বছর তাঁর সিটি গোল্ড সম্বলিত কাঁচা বাদামের গান বলতে গেলে সারাবিশ্বে ভাইরাল হয়েছিল। তখনই ভেবেছিলাম, সিটি গোল্ড নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখবো। কিন্তু নানা কারণে লেখা হয়নি। এর মধ্যে সেদিন ফার্মগেটস্থ সুপার মার্কেটের দোতলায় (যেখানে সব জুয়েলারির দোকান) যেয়ে দেখি সোনার দোকানে ভীড় নেই। অথচ সিটিগোল্ড বা ইমিটেশনের দোকানে ভীড় উপচিয়ে পড়ছে। এটি দেখে এর সম্ভাবনা ও গুরুত্ব উপলদ্ধি করে হাতে কাগজ কলম তুলে নেই। আসলে দিনে দিনে বাড়ছে সোনা-রূপার তৈরি গহনার দাম। মানুষ এসব গহনার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন সিটি গোল্ড বা ইমিটেশনের গহনা। এগুলোও দেখতে সোনার মতো, অথচ সোনা নয়। অবশ্য এসব গহনা সোনা ও রূপার মতো বিভিন্ন আকর্ষণীয় ডিজাইনে তৈরি হচ্ছে। গলা, নাক, কান, পা, কোমর, মাথার বিভিন্ন ডিজাইনের গহনা। এগুলো সস্তা ও সহজলভ্য বলে সব ধরনের কাস্টমারের কাছে আকর্ষণীয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা পেশা হিসেবে ইমিটেশনের গহনা তৈরি করেন। এক্ষেত্রে ২০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা দামের গহনাও পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, এখন বিয়ের জন্য পুরো গহনার সেটও কিনতে পাওয়া যায়। চুড়ি, সীতাহার, নুপুর, মাথার ঝাপটা, হাতের মানতাসা, খোপার কাঁটা, মাথার টায়রা, শাড়ির উপর খচিত মালা, নাকফুল, টিকলি ইত্যাদি সবই মেলে বাজারে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে যে, এই ইমিটেশনের গহনা প্রকৃত সোনা কিংবা রূপা নয়। তবে সিটি গোল্ড নাম হলো কেন? এ নামের ব্যাপারে নানা ভাবে তথ্যাদি সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়েও সত্যিকার কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। তবে যেটুকু ক্লু পেয়েছি সেই আঙ্গিকে তুলে ধরছি। বস্তুত ইমিটেশনের বাংলা অর্থ হলো নকল বা অনুকরণ বা কৃত্রিম। কিন্তু এই প্রোডাক্টের নাম যদি এই কৃত্রিম নামে অভিহিত করা হয়, তাহলে নেতিবাচক মনোভাবের আওতায় মানুষের মধ্যে তুচ্ছতা ও অবজ্ঞা জাগতে পারে এবং তেমন আগ্রহ আর নাও থাকতে পারে। তাছাড়া উল্টো ফলও দেখা দিতে পারে সাধারণ মানুষ বা খরিদ্দারের মধ্যে। কারণ নামের তাৎপর্য অনেক গভীর পর্যন্ত গ্রোথিত এবং মানুষের অন্তরে তা ঢেউ খেলে যায়। তাই সোনা তথা গোল্ড কথাটি টেনে আনা হয়। আবার শুধু গোল্ড বললে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। কেননা এটি তো আসল সোনা নয়। সেহেতু সিটি কথা সংযোজন করা হয়েছে। আবার এখানেও প্রশ্ন জাগতে পারে যে সিটি ছাড়া অন্য শব্দ হতে পারতো, কেন সিটি শব্দটি জুড়ে দেয়া হলো? এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ আমেরিকায় এল ডোরাডো নামে একটি পৌরাণিক শহর ছিল, যা নাকি সোনায় ভরা ছিল বলে এটিকে সিটি অব গোল্ড বলা হতো। তাছাড়া পৌরাণিক কাহিনীর আওতায় আরও সাতটি সিটি অব গোল্ড আছে। অবশ্য বর্তমানে হরেক রকম সোনার গহনার প্রাচুর্যতা থাকায় দুবাইকে সিটি অব গোল্ড বলা হয়। যাহোক, এই সব সিটি অব গোল্ডের কথা মাথায় রেখে আলোচ্য ইমিটেশন গহনার নামের ক্ষেত্রে সিটি শব্দটি যোগ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। মোট কথা সিটি অব গোল্ড কথাটি থেকে অব বাদ দিয়ে সিটি গোল্ড নামকরণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন যে, নামটি “কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন” এর ন্যায়। কিন্তু তাদের কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। বস্তুত নামটি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। কেননা এই ইমিটেশনের গহনা স্বর্ণ বা রূপার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একই সঙ্গে প্রকৃত স্বর্ণ ও রূপার মূল্য গণমানুষের নাগালের বাইরে। যুগপৎ চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাই হলেও অতটা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, তাহলে এই কথা উঠে আসে যে মনস্তাত্বিক দিক দিয়ে মানুষের মন সৌন্দর্যপ্রিয় ও কল্পনাপ্রবণ। তাই বিকল্প হিসেবে একদিকে উপযোগিতাসহ তৃপ্তি পাওয়া যায় এবং অন্যদিকে মোহনীয় সৌন্দর্যর দিকে দিয়েও কম নয়। কেবল সোনার স্থায়ীত্ব ও মূলমানের কথা মনে জাগলেও, অত্যাধিক দামের কারণে মনকে বুঝানোর যথেষ্ট যুক্তি আছে।
আ) ইমিটেশন বা সিটি গোল্ড গহনার ব্যাপারে আমাদের দেশের যে দুটি এলাকার কথা উঠে আসে, তার একটি হলো (ক) মহেশপুর উপজেলা [ঝিনাইদহ জেলা] এবং (খ) ভাকুর্তা জনপদ [সাভার উপজেলা]। অবশ্য তুলনামূলক কম হলেও বগুড়াতেও সিটি গোল্ডের গহনা তৈরি হয়।
(ক) মহেশপুরের পুরোনো শহর এলাকায় বেশ কয়েকটি সোনার দোকান ছিল একসময়। সেখানে দুই ভাই আবদুর রহিম আর আবদুল হামিদের একটি দোকান ছিল; নাম মুসলিম জুয়েলার্স। প্রায় ১০ জন কারিগর কাজ করতেন তাঁদের দোকানে। ২০০৩ সালের দিকের কথা। এক লাফে সোনার দাম প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়। সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের জুয়েলারি দোকানে বিক্রি কমতে থাকে। এই কারণে তাঁদের সফল ব্যবসাটা একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় এবং এক পর্যায়ে বন্ধও হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় দুই ভাই মিলে শুরু করেন সিটি গোল্ডের ব্যবসা। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, মহেশপুর ভারতের সীমান্তবর্তী উপজেলা। তখন পাশের দেশ ভারতে কিছু এলাকায় সিটি গোল্ডের প্রচলন ছিল এবং চাহিদাও ছিল উর্দ্ধমুখী। সেই সময় টিকে থাকার স্বার্থে প্রতিবেশি দেশ থেকে তথ্যাদি সংগ্রহপূর্বক, সেই ধারণা মাথায় রেখে দুই ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে ইমিটেশনের গহনা তৈরি করবেন। ঠিকই ২০০৩ সালের মাঝামাঝি দুই ভাই মিলে প্রথমে একটি ভাড়া ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন সিটি গোল্ডের কারখানা। নাম দেন মিলন সিটি গোল্ড। আর তাঁদের আগের দোকানের ৬ জন কর্মচারীর সঙ্গে আরও ৪ জন নিয়োগ দিয়ে শুরু করেন এই অলংকার তৈরির কাজ। তখন অবশ্য যন্ত্রপাতির ঘাটতির কারণে আধুনিক উপায়ে গহনা বানাতে শুরু করা সম্ভব হয়নি। সে সময় শুধু বাজার থেকে ব্রোঞ্জ কিনে তার ওপর রং লাগিয়ে বানানো অলংকার বাজারে ছাড়তে শুরু করেন। কিন্তু তাতেই বাজিমাত। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে এই অলংকারের এতটা চাহিদা বেড়ে যায় যে যোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কারখানায় উৎপাদনও বাড়তে থাকে এবং একই সঙ্গে কারখানার আয়তনও বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথমদিকে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ জোড়া কানের দুল তৈরি করা মিলন সিটি গোল্ড এখন প্রতিদিন ৫ হাজার জোড়া কানের দুল তৈরি করছে। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে যোগ হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অন্যান্য সিটি গোল্ডের গহনা। ইতিমধ্যে বড় ভাই আব্দুর রহিম মারা যায়। ছোট ভাই আব্দুল হামিদ নিজেই সব পরিচালনা করতে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো যে, ব্যবসা শুরুর সময় তাঁদের হাতে ক্যাশ ছিল মাত্র ৮০০ টাকা এবং মাঠে ছিল ৫ বিঘা চাষযোগ্য জমি। এখন ব্যবসা করেই অন্যান্য সম্পদসহ মহেশপুর শহরে ৬ তলা একটি বাড়ি করেছেন। এখানেই তাঁদের বিশাল কারখানা এবং ভবনের নিচতলায় বেশ কয়েকটি সিটি গোল্ডের দোকান রয়েছে। যাহোক, ইতিমধ্যে মিলন সিটি গোল্ডের সাফল্যের কথা মহেশপুর সহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের কারিগরদের অনেকে নিজেই উদ্যোক্তা বনে যান। গড়ে তোলেন একের পর এক কারখানা। এভাবেই বিস্তৃত হতে থাকে উপজেলা জুড়ে বহু কারখানা। এদিকে তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় একশ জন কারিগর বেড়িয়ে নিজের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেছেন। বর্তমানে জলিলপুরসহ এই উপজেলার নওদাপাড়া, রামচন্দ্রপুর, বামনগাছি, সেজিয়া এবং যাদবপুরসহ এমন আরও কয়েকটি এলাকায় বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে এসব অলংকার। উল্লেখ্য যে, মহেশপুরে তৈরির গহনা হাত বদল হয়ে সারাদেশে যাচ্ছে। অবশ্য বড় অংশ যায় ঢাকায়। সেখান থেকে অন্য এলাকার ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। এতদ্ব্যতীত অন্য শহরের ব্যবসায়ীরাও এখানে এসে সরাসরি কিনে নিয়ে যান। এদিকে মহেশপুর উপজেলায় অনিয়মিত কারিগর ছাড়াও প্রায় ৮ হাজার মানুষ নিয়মিত কাজ করছেন।
(খ) সিটি গোল্ডের ব্যাপারে মহেশপুরের পরে যে স্থানের কথা উঠে আসে, সেটা হলো ভাকুর্তা। এটি সাভার উপজেলার একটি ইউনিয়ন, যেখানে ৩৬টি গ্রাম রয়েছে। গ্রামগুলোর মধ্যে চুনারচর, ডোমরাকান্দা, সোলারমার্কেট, খাগুড়িয়া, নলাগুড়িয়া, মোগরাকান্দা, চাপরা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, বাহেরচর, মুশরিখোলা, ঝাউচর, লুটেরচর, চরতুলাতলি, চাইরা, ইত্যাদি সর্বত্রই এই অলংকার তৈরির একই দৃশ্য। গ্রামের মানুষ কৃষি কাজ ছাড়াও অলঙ্কার তৈরির কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। গেরস্ত বাড়ির পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অলঙ্কার তৈরির কাজে নিয়োজিত। ছুটির দিন ও অবসরে গহনার কাজ করে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পড়াশোনার খরচ নিজেরা বহন করে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, ভাকুর্তা ইউনিয়নের অধিকাংশ পরিবারেরই কমপক্ষে একজন করে হলেও এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। উল্লেখ্য যে ঢাকার নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, চাঁদনীচক মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সব বড় বড় শপিং মলের গহনা যায় ভাকুর্তা থেকে। শুধু দেশে নয়, দেশের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি এসব গহনা রফতানি করা হচ্ছে ইটালি, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, অন্য পেশার চেয়ে তুলনামূলক আয় বেশি বলে কারিগর, ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমিক, সবার কাছেই সমাদৃত এই কাজ। যে ভাবেই বলি না কেন, এক সময় অবহেলিত জনপদ ছিল ভাকুর্তা। শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। বেকার জীবনযাপন ছিল বেশিরভাগ মানুষের। এই জনপদে আজ আর কেউ বেকার নেই। এদিকে এই বাজারে যেটি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তা পর্যায়ক্রমে ধাপ পেরিয়ে সাধারণ ক্রেতা পর্যন্ত আসতে আসতে সেটির মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১০০০-১২০০ টাকা। যাহোক গত তিন/চার দশকে এখানে দিন দিন জমে উঠেছে গহনার বাজার। উল্লেখ্য যে, ভাকুর্তার কারখানাগুলোতে হাজারো নকশার গয়না পাওয়া যায়। চাইলে নিজের পছন্দমতো ডিজাইন দিয়েও গয়না তৈরি করানো যায়। দিনে দিনে এসব গয়নার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি ভাকুর্তায় নারী সদস্যরাও সমান তালে অলঙ্কার তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। একজন কারিগর প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করেন। তবে জানা যায় যে, মহাজনের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে নান্দনিক গহনা তৈরি করে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। এজন্য অবশ্য প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। শীতকাল ও ঈদের সময় অর্ডার বেশি হয়। তখন দিনরাত কাজ করতে হয়। গহনার ডিজাইনভেদে মজুরির পার্থক্য হয়ে থাকে। আর যেটার কারুকার্য কম, সেটার মজুরি ৪০-৪৫ টাকা। আর যেটার কাজ বেশি, সেটার মজুরি প্রতি ভরি ৮০-১০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে রাজধানীর জুয়োলারি দোকানগুলোতে ভাকুর্তায় তৈরি এই অলঙ্কারের চাহিদা স্বর্ণের চেয়েও বেশি। মূলত সিটি গোল্ড নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের একমাত্র ভরসা। এগুলোর দামও যেমন কম, আবার সৌন্দর্যও সোনার মতো।
(ই) সাধারণত তামা, পিতল, ব্রোঞ্চ, কাঁসা ইত্যাদি গলিয়ে পাথরের ছাঁচে ফেলে এসব গহনা তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে কারিগরের এক হাতে থাকে চিমটা এবং অন্য হাতে গ্যাস টর্চ। অতঃপর কেমিক্যালের আওতায় মন মতো রংয়ের লেকারে (কেমিক্যালস) ডোবানো হয়। এই সময়ে তরিৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সোনালী রং ধারণ করে। এক্ষেত্রে মেশিনের সাহায্যে গ্রহণযোগ্য আকৃতিতে নকশা কাটা হয়। আর পালিশের পর সোনার মতো জ¦ল জ¦ল করে। অপরিসীম ধৈর্য্যরে সঙ্গে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ ঘটিয়ে নান্দনিক গহনায় রূপ দেয়া হয়। প্রকাশ থাকে যে গোল্ড প্লেটেড গহনার ক্ষেত্রে স্বর্ণের ফেলনা উচ্ছিষ্ট ব্যবহার করা হয়। আর এই গহনার রং তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারত ইমিটেশনগুলোকে লালচে রং দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বাজারে এই রংয়ের ইমিটেশনের চাহিদা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক কারখানায় এই প্রযুক্তির অভাবে সেই রং দিতে পারছে না। দুঃখের বিষয় হলো যে এর অধিকাংশ কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করা হয়। অতঃপর ঢাকার তাঁতি বাজার হতে সেগুলো কিনে নিয়ে যান মহেশখালী ও ভাকুর্তাসহ অন্যান্য এলাকার ব্যবসায়ীরা। উল্লেখ্য যে, দেশে যদি কাঁচামাল তৈরি হতো, তাহলে সিটি গোল্ড ব্যবসায়ীরা আর্থিক দিকে দিয়ে আরও প্লাস পয়েন্টে থাকতেন। এদিকে ইদানিং এই ব্যবসা জমজমাট হলেও রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ব্যাংক থেকে কাম্য পরিমাণ ঋণ পাওয়া যায় না। তাই গহনা তৈরি ও ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত কম আয়ের ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের এই কর্মকান্ড বাড়াতে বার বার হোঁচট খেতে হয়। যাহোক, আমাদের দেশের সিটিগোল্ডের ইতিবাচক দিক হলো, ভারতের অটোমেশন বা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির তৈরি গহনা দেশের বাজারে এলেও, বাজার খুব একটা দখল করতে পারছে না। কেননা ভারতের একটি কানের দুল দেশে যেখানে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। সেখানে নিজেদের তৈরি একটি কানের দুল বা সমজাতীয় গহনা মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া রং চটে গেলেও পরিবর্তন করে নতুন গহনা দেয়ার সুযোগ আছে। আর আগে এসব গহনার শতভাগই ছিল আমদানি নির্ভর। চীন আর ভারতের দখলে ছিল বাজার। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি বদলে চাহিদার ২০ শতাংশ বাজার দখল করতে পেরেছে দেশীয় কারিগর ও কারখানাগুলো। এর ১০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে সাভারের ভাকুর্তা ও বগুড়া জেলাতে। বাকী ১০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুরে। এতে বছরে প্রায় শত কোটি টাকার ইমিটেশন জুয়েলারি পণ্য উৎপাদনসহ হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। কিন্তু এখনও হাজার হাজার কোটি টাকার একচেটিয়া বাজার ভারত-চীনের দখলে। তবে ভারতের বাজার কমলেও চীনের বাজার এখনো সমান তালে চলছে। একদিকে আমদানি নির্ভর এই শিল্পের কাঁচামাল এবং অন্যদিকে চীন ও ভারতে উন্নত ডিজাইন ও আকর্ষণীয় অলংকারের সঙ্গে সত্যিকারার্থে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু আমি বিশ^াস করি যে এই শিল্পের স্বীকৃতিসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি; কারিগরী ও আর্থিক সহায়তা; কাঁচামালের সহলভ্যতা ও উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে বৈচিত্র্যময় নান্দনিক মনের অধিকারী বাঙ্গালি কারিগর কর্তৃক নিজস্ব মাধুবী দিয়ে ডিজাইনের নিপুণ কারুকার্য খচিত এই সব ইমিটেশনের গহনা তৈরিপূর্বক দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। সেহেতু হেলায় উপেক্ষা না করে সরকারি ও বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিভিন্ন আঙ্গিকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সহায়ক সূত্রাদি:
০১। বাংলা পিডিয়া।
০২। রতন কুমার পাইক, দি চৈতী জুয়েলার্স।
০৩। খন্দকার জহিরুল ইসলাম, সুফিয়ান জুয়েলার্স।
০৪। মো. আইয়ুব আলী, প্রধান (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন), বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড।
০৫। দৈনিক জনকন্ঠ ১৪-০৩-২০১৭ ইং।
০৬। দৈনিক ইনকিলাব ০২-১২-২০১৭ইং।
০৭। প্রথম আলো ১৩-১০-২০১৮ইং এবং ০৬-১১-২০২২ইং।
০৮। সময়ের আলো ২৫-০৮-২০২১ ইং এবং ২৯-০৫-২০২৪ইং।
০৯। সকালের সময় ০৪-০৩-২০২৪ইং।
১০। বিডি ২৪ লাইভ ১৯-০৮-২০২৪ইং।
১১। সংশ্লিষ্ট জ্ঞানীজনের সঙ্গে আলোচনা।
১২। ইত্যাদি; ইত্যাদি।
(লেখক-বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত। )