১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ৮:৪১
নোটিশ :
Wellcome to our website...

।।মুখরোচক ফল লটকন।।

রিপোর্টার
শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪১ পূর্বাহ্ন

* মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব*
(অ) এইতো কয়েকদিন আগে রাজধানীস্থ শেওড়া পাড়ায় আমার এক ছোট বেলার ঘনিষ্ট বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেলে ভাবী বললেন, চৌধুরী ভাই বসেন; আপনার বন্ধু বাজারে গিয়েছেন। অল্পক্ষনের মধ্যে চলে আসবেন। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ঠিকই সাপ্তাহিক বাজারের বিশাল বহর নিয়ে হাজির। বস্তুত বন্ধুটি বেশ অবস্থাপন্ন। মনে হলো সবমিলে প্রায় ৬/৭ হাজার টাকার বাজার করেছে। মজার ব্যাপার হলো যে আসার পরপরই ভাবীর প্রথম কথা, লটকন কোথায়? গত সপ্তাহেও তো আনোনি। ভাবী যে মুখরা তা আগেই জানতাম। তাই ভাবলাম, আজ যে কি ধরনের ঝড় উঠে, তা আল্লাহই জানেন। সত্যিকারার্থে আমার সামনেই লটকনের জন্য বন্ধুটিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো। আমি পরিবেশটি নাজুক দেখে বিশেষ একটি অজুহাত দেখিয়ে দ্রুত কেটে পড়লাম।
ফিরে আসার পথে ভাবতে লাগলাম এক কালে আমাদের দেশে এটি অপ্রচলিত ফলের তালিকায় ছিল। কিন্তু এখন আর তা নয়। বলতে গেলে সবার কাছেই প্রিয়। বর্তমানে মৌসুমী ফল সংস্কৃতির তালিকায় এটি বিশেষ অবস্থান নিয়ে আছে। আসলে ফলটি মুখরোচক এবং দেখতেও দৃষ্টিনন্দন। মূলত এটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে বাকাউরিয়া মতলিয়ানা (ইধপপধঁৎবধ সড়ঃষবুধহধ) প্রজাতির ফল। তুলনামূলকভাবে ছায়াযুক্ত স্থানে এটি ভাল জন্মে। এই বৃক্ষ দক্ষিণ এশিয়ায় বুনো গাছ হিসেবে জন্মালেও বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। আসলে আগে যাই থাকুক না কেন, অধুনা বাংলাদেশে বানিজ্যিকভাবে ব্যাপক আকারে উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে উন্নত জাতের সুমিষ্ট লটকনের চাষ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তাও বেশ বেড়েছে এবং বলতে গেলে ধনী-গরীব সব পরিবারেই সমভাবে প্রিয়। তথ্যমতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের নরসিংদীতেই লটকনের ফলন বেশি। এছাড়াও সিলেট, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুর সহ অনেক জনপদেই ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে লটকন বিদেশেও রফতানি করা শুরু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো যে, সনাতনী ধর্মের রথযাত্রার সাথে বিশেষ ফল হিসেবে লটকন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এদিকে অঞ্চল ও দেশ ভেদে মৌসুমী ফল লটকন বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন হাড়ফাটা বুগি, ডুবি, বুবি, কানাইজু, লটকা, লটকাউ, কিছুয়ান, আশফুল, ইত্যাদি।
(আ) কিছুটা ডুমুরের ন্যায় গাছের গুড়ি ও ডালে থোকায় থোকায় জন্মে থাকে। শক্ত খোসার আবরণে ঢাকা থাকে সম্পূর্ণ ফলটি। কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হলুদ হয়। এর ভেতরে রয়েছে তিন থেকে চারটি দানা। কিছুটা চারকোনা আকৃতির এই দানা বা রসালো শাঁসগুলো মূলত দুটি রঙের হয়ে থাকে; হাল্কা লাল এবং গোলাপি মিশ্রণ। সাধারণত এই ফলের আকার ২ থেকে ৫ সেমি হয়ে থাকে এবং স্বাদ টকমিষ্টি হলেও বেশ সুস্বাসদু মুখে নিলে এতটাই তুলতুলে মনে হয় যে এখনই গিলে ফেলি। মূলত এই ফলটি জুন এবং জুলাই মাস ধরেই পাওয়া যায়। আর এর বংশবিস্তার দু’ভাবে হয়ে থাকে। বীজ ও অঙ্গজ (কলম) পদ্ধতিতে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে লটকনের পুরুষ ও স্ত্রী-গাছ পৃথক হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো যে বীজ দ্বারা বংশবিস্তার করলে স্ত্রী গাছের চেয়ে পুরুষ গাছের সংখ্যা বেশি হয় এবং ফল পেতে প্রায় পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু কলম পদ্ধতি ব্যবহারে তিন বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া এই গাছ খাটো হয় বলে ফল তোলা সহজ হয়ে থাকে। সাধারণত একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে গড়ে ১০০-১৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। বস্তুত এই বৃক্ষ ৯-১২ মিটার লম্বা হয়। এর কা- বেটে এবং উপরাংশ ঝোপালো এবং পূর্বেই বলেছি যে পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদা। শুধু তাই নয়, আলাদা ধরনের হলুদ ফুল হয় এবং উভয় রকম ফুলই সুগন্ধিপূর্ণ।
(ই) সত্যি কথা বলতে কি, এই দৃষ্টিনন্দন হলুদ বর্ণের ফল দেখলেই সহজেই জিহ্বায় পানি আসে। কিছুটা মরিচ ও লবণ মিশ্রিত করে খেলে এই স্বাদ বলতে গেলে সারা শরীরে জানান দেয়। অনেকে আবার লবণ, লেবুর রস আর সঙ্গে মরিচ ও চিনি মাখিয়ে লটকনের ভর্তা তৈরি করে খেয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জ্যামও তৈরী করা হয়। যেহেতু এই মৌসুমে আদ্রতা সহ বেশ গরম থাকে। সেহেতু এর স্বাদ আবহাওয়া গত কারণে আরো বৈচিত্র করে তুলে। এদিকে কাঁচা আর পাকা লটকন চেনার ব্যাপারে পূর্বেই কিছুটা আলোকপাত করেছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, যখন ফলগুলো দেখতে তুলনামূলক সবুজ। তখন খাবারের যোগ্য হয়নি বলে মনে করতে হবে। আর যখন ফলগুলো হালকা সবুজ কিংবা হলুদ রং ধারণ করে। তখন খাওয়ার জন্য লুফে নেয়ার প্রকৃত সময়। আর এই ফলটি পাকলে, এর হাল্কা মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারিদিক। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, এটি কেবল মুখরোচকই নয়। এতে আছে নানা ভিটামিন। তাই বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে, এটি শরীরে যেমন ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করতে পারে; তেমনি পারে আমাদের মুখের স্বাদের পরিবর্তন আনতে। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-১, বি-২ ও ভিটামিন সি। এছাড়াও আছে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম। বেশিরভাগ লটকন ফল অ্যাস্করবিক এসিড, অ্যানজাইম, বায়োফ্ল্যাভনয়েডসমৃদ্ধ। লটকনে এসব কিছুর পাশাপাশি আছে ফ্যাট আর প্রোটিন, যা আর্থাইটিস রোগের জন্য উপকারী। এদিকে ফোঁড়া এবং অন্যান্য ত্বকের রোগ সারাতেও এর জুড়ি নেই। এতদ্ব্যতীত পাকস্থলীর ব্যথা এবং খাবার হজমে সাহায্য করে এই লটকন। শুধু যে এই ফল সুস্বাদু ও উপকারী, তাই নয়। এর পাতাতেও আছে নানা ধরনের গুণাবলী। লটকন গাছের পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে খেলে ডায়রিয়া থেকে উপশম পাওয়া যায়। আর গাছের ডাল ও বাকল চর্মোরোগের ক্ষেত্রে বেশ উপকারী। এতদ্ব্যতীত এর ছাল থেকে রং তৈরী করা হয়, যা রেশমী সুতা রাঙ্গাতে ব্যবহৃত হয়। এই টক মিষ্টি আমেজের সহজলভ্য ফল খাবার টেবিল থেকে শুরু করে আড্ডার স্থলসহ সব জায়গায় খেতে দেখা যায়। আরেকটি কথা, লটকন পুরুষ ও মহিলা উভয়ই পছন্দ করলেও মেয়েরাই একধাপ এগিয়ে।
পরিশেষে এই কথা বলে শেষ করছি যে, যেহেতু আমাদের দেশের মৃত্তিকা ও আবহাওয়া উপযোগী; সেহেতু বিভিন্ন আঙ্গিকে এর চাষের উপর গুরুত্ব দিলে অর্থনৈতিকভাবে আরও উপকৃত হওয়ার বিষয়টি খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

সহায়ক সূত্রাদি:
০১। উইকিপিডিয়া।
০২। দৈনিক যুগান্তর ০৪-০৭-২০১৭ইং।
০৩। অন্যান্য বিভিন্ন উৎস।
(বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর