১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, সকাল ৮:৩৯
নোটিশ :
Wellcome to our website...

।।ক্রলিং পেগ বা হামাগুড়ি সীমারেখা খোঁটা।।

রিপোর্টার
শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন

* মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব*
প্রথম পর্ব
(অ) এইতো কয়েকদিন আগে আমার সমবয়সী স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান আজিজ নামে এক স্কুল ফ্রেন্ড গ্রামের বাড়ী পাবনা থেকে ঢাকায় আসে। সে কলেজের দোর পর্যন্ত গেলেও আর সামনে এগোয়নি। তথাপিও জ্ঞানবুদ্ধির দিক দিয়ে সে যথেষ্ট পাকা এবং জেনারেল নলেজে তাকে হারানো মুশকিল। এক্ষেত্রে আমি বিশ^াস করি যে, বিদ্যা ও বুদ্ধি সবই অপরিহার্য হলেও জন্মগত বুদ্ধিই বড়। যাহোক, আজিজের নাকি প্রায় এক বছর ধরে কি যেন অসুখ হয়েছে; কোন ডাক্তার-ঔষধে কাজ হচ্ছে না। তাই সে মনস্থ করেছে যে কোলকাতায় চিকিৎসার জন্য যাবে। আর সে যাওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের জন্য ঢাকায় এসে একটি হোটেলে উঠেছে। সেখান থেকে সে আমাকে ফোন করে। তখন আমি বাসায় আসতে বললে, সে বলে যে চিকিৎসার জন্য কোলকাতায় যাওয়ার সব ঠিক ঠাক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ডলার পাচ্ছে না। পেলেও অনেক দাম। আমাকে বলল দোস্ত, তুই যদি পারিস ব্যবস্থা করে দে না? তাছাড়া আরও বলে যে, ক্রলিং পেগ নামে সরকার থেকে কি যেন জারি করা হয়েছে। তার জন্য নাকি ডলারের দাম হু হু করে বেরে গিয়েছে। আমি বললাম যে, ফার্মগেটে পরিচিত একটি মানি এক্সচেঞ্জার আছে, ওখান থেকে হয়তো ডলারের ব্যবস্থা করতে পারবো। আর তুমি ক্রলিং পেগের কথা বলছো। এটি অর্থনৈতিক তথা ব্যাংকিং টার্ম। তুমি কাল রাতে আমার বাসায় নুন ভাত (ডিনার) খাওয়ার জন্য আসলে খুব খুশি হবো। আর সেই সময় ঐ বিষয়টি বুঝিয়ে বলবো। বন্ধুত্বের গভীরতার সুবাদে আজিজ ঠিকই সন্ধ্যার দিকে আমার গ্রীণ রোডস্থ বাসায় আসে। একে অপরকে দেখে তো মহাখুশী। তৎপর ছোটবেলার নানা রকম টক-ঝাল-মিষ্টি-তিতার সারথী ধরে দু‘জন যেন ছোট কালে আবার ফিরে যাই।
যাহোক, নৈশ ভোজন শেষে ক্রলিং পেগ সম্পর্কে যতদূর সম্ভব বুঝিয়ে বলতে শুরু করি। দোস্ত আজিজ, তুমি তো ক্লাশে ভাল ছাত্র ছিলে এবং অন্যদের তুলনায় বুদ্ধি জ্ঞানও কম নয়। ইচ্ছে করেই পড়াশোনায় আগাওনি। আর তুমি তো ক্লাশে ইংরেজিতে হাইয়েস্ট মার্কস পেতে। যাহোক, তুমি যে ক্রলিং পেগের কথা বলেছিলে, সেই কথাই এখন বলছি। তুমি তো জানো আভিধানিক অর্থে ক্রলিং এর বাংলা অর্থ হলো- হামাগুড়ি। আর পেগ এর মানে হলো আটকানো পেরেক বা খোঁটা। এবার এই যে মানি মার্কেটে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে। সেটি বলার পূর্বে ডলারের দাম উঠানামা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের হার নির্ধারণ করা হতো। এতে দেখা গিয়েছে, যে হার নির্ধারণ করে দেয়া হতো, তাতে ডলারের সরবরাহ কম বলে খোলা বাজারে (কার্ভ মার্কেট) অধিক হারে ক্রয় বিক্রয় হতো এবং এই কারণে মানি মার্কেটে অনাহুত সমস্যাসহ নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হতো। তাছাড়া অধিক হার বা দর পাওয়ার আশায় প্রবাসীরা এই খোলা বাজারের দিকে ঝুঁকে পড়তো বিধায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিটেন্স তথা ডলার বেহাত হয়ে যেতো, যা সরকারের ঘরে আসতো না। এদিকে এ বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ধরে আইএমএফ বলে আসছে যে, ডলারের রেট এভাবে নির্ধারণ না করে মুদ্রা বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হোক। এক্ষেত্রে ডলারের হার চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে একটি পয়েন্টে নির্ধারণ হবে। অথচ দেশের আর্থ-সামাজিক প্যারামিটার বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ পথে আগায়নি। কিন্তু এবার আইএমএফের কথা না মেনে উপায় ছিল না। কেননা তুমি তো জানো, বাংলাদেশ অনেকাংশে বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীল। তাই শর্ত অনুযায়ী কাম্য ঋণ পাওয়ার স্বার্থে একরকম বাধ্য হয়ে এই ক্রলিং পেগ পদ্ধটি প্রবর্তন করতে হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে, ক্রলিং পেগের আওতায় মুদ্রা বাজারে ছেড়ে দেয়া হলেও সুতার গুটি কিছুটা হাতে থাকে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। মূলত অস্থিতিশীল মুদ্রা বাজারে সমতা আনতে এই আপৎকালীন ক্রলিং পেগ ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ডলারের দাম তলানিতে গিয়েও ঠেকবে না। আবার আকাশ চুম্বিও হবে না। আবার তোমার কথায় ফিরে আসি। রূপকঅর্থে যদি বলি, তাহলে বলতে হয় যে এই ক্রলিং তথা হামাগুড়ি দিয়ে ইচ্ছে করলেই বহুদুর আগানো যাবে না। এর একটি সীমারেখা অর্থাৎ একটি খোঁটা গাড়া আছে। এগুতে গেলে বড় জোর সেই সীমারেখা বা খোঁটা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। আর তাই ক্রলিং ও পেগ এর আওতায় এই পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছে ক্রলিং পেগ। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় এতদিন প্রতি ডলার ১০৯.৫০ কিনে সর্বোচ্চ ১১০.০০ টাকা বিক্রি করতে মানি মার্কেটকে বলা হতো। পূর্বেই বলেছি যে, বেশিরভাগ ব্যাংক এ হারের প্রতি অনিহা এবং বলতে গেলে তেমন মানেনি। তাই আইএমএফের শর্তসহ সবকিছু বিবেচনায় এনে এক লাফে ৭.০০ টাকা বাড়িয়ে ১১৭.০০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যদি ঘুড়িয়ে বলি, তাহলে কথাটি এই দাঁড়ায় যে, খোটা তথা পেগ সম্বলিত হার ১১৭.০০ টাকা; এর বেশি আর আগানো যাবে না।
দোস্ত আজিজ, এটি সামষ্টিক অর্থনীতির বড় জটিল বিষয় বিধায় আরও কিছু কথা আছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দু’ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় যেমন- হার্ড পেগ এবং সফট পেগ। বস্তুত হার্ড পেগ পদ্ধতি সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার হার নিজেই ঠিক করে দেয়, যা আগে করা হতো। কিন্তু সফট পেগ পদ্ধতি মুদ্রা বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলেও সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্ভাব্য হার নির্ধারণ করে দিতে পারে। আর এই সূত্র ধরে ক্রলিং পেগের কথা উঠে আসে। তাছাড়া ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে হস্তক্ষেপবিহীন ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবহার করা হয়। এতে দেশের অর্থনীতি ও মুদ্রা বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের দাম উঠা-নামা করে। আসলে দোস্ত আজিজ, এতক্ষণ যত কথাই বলি না কেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক, বলতে গেলে খুব একটা সুবিধার নয়। আর তাই হার্ড পেগ বা সফট পেগ বা ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতি যাই বলো না কেন; বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতিসহ মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করেছে বলেই ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়েছে।
আ) তখন আজিজ আমাকে বলে দোস্ত বাকী চৌধুরী, ক্রলিং পেগ তো ভালর জন্যই করা হয়েছে। তবে ডলারের দাম এতো অস্থিতিশীল কেন এবং শেষ পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া দেশের অর্থনীতিতে কতদূর পর্যন্ত গড়াবে ? আমি বললাম বন্ধু আজিজ, উদ্দেশ্য তো ভাল। আর ভালর দিকটা মাথায় রেখে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এড়ানোসহ ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা হ্রাস করার জন্যই এটি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছো। তবে এক্ষেত্রে মেক্সিকোর উদহারণ টানতে হচ্ছে। সেই দেশে নব্বই দশকে পেসোর মূল্যস্ফীতির খারাপ অবস্থা বিবেচনাপূর্বক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি প্রবর্তন করে মূল্যস্ফীতি ও অবমূল্যায়নের অস্থিরতা কমিয়ে নির্দিষ্ট বিনিময় হারে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশের ম্যাক্রো অর্থনীতির প্যারামিটারগুলো এতটাই হাইড্রাহেডেড যে, একটি টান দিলে আরেকটি আসে। তুমি তো জানো, আমাদের দেশে কৃষিখাত সহ কিছু কিছু খাত প্রভূত উন্নত হয়েছে। তাছাড়া, বিদেশে প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী লাগাতার ভাবে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। আর প্রবাসী আয়ের দিক দিয়ে বিশ্বে টপ টেনের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম একটি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কাল টাকা, ঋণ খেলাপি ও পাচার একটি স্বাভাবিক কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর ফলশ্রুতিতে কি হচ্ছে, তা হয়তো তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। যাহোক, তুমি হয়তো কিছুটা হলেও অবহিত আছো যে রিজার্ভের সঙ্গে বিনিময় হার সমান্তরালভাবে সংশ্লিষ্ট। আর বলতে গেলে এটি একদিকে অর্থনৈতিক শক্তি এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বস্তি। অথচ সেই রিজার্ভের পরিমাণ এতটাই কমে গিয়েছে যে তিন মাসের আমদানি খরচ মিটানোর ক্ষেত্রেও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তো গত ১৫/০৫/২০২৪ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রত্যক্ষ করেছি যে ডলারের সংকট না কাটায় রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। অধিকন্তু এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় মেটানের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে মোট রিজার্ভ কমে ২৩.৭৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আর আই এম এফের বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ১৮.৩২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার। তবে প্রকৃত বা দায়হীন রিজার্ভ এখন ১৩.০০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কিছুটা কম। অবশ্য প্রকৃত রিজার্ভ এটাই, যার বিপরীতে কোন দায় যে কোন সময় মিটানো বা কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেছেন যে সামনের মাসে আইএফএমের ঋণের কিস্তি আসবে। তাছাড়া জুনের মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ছাড় হবে। একইসঙ্গে চলতি মাসে প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তাঁরা। তাছাড়া প্রবাসীদের মধ্যে ডলার বন্ড বিক্রির সুযোগ আছে এবং সমাপ্তকৃত কিছু কিছু মেগা প্রকল্পের উৎপাদন ও সেবা বাজারে আসতে শুরু করেছে, যার ফলশ্রুতিতে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়বে এবং প্রকারান্তরে রিজার্ভের উপর চাপ কমে আসবে।
দ্বিতীয় পর্ব
ই) দোস্ত আজিজ, উপরোক্ত বর্ণনায় যে কথা বললাম, সেটি হলো একদিক। আরও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নানা কথা আছে। কিন্তু তোমার হাতে সময় কম। তাই বিশদভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে তুমি যে বলেছিলে হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়লো কেন ? সেই কথায় ফিরে আসছি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, চলতি বছরের বিগত সময় ধরে কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করে এখন ডলার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে, যে কথা তুমি আমাকে ফোনে বলেছিলে। দেখা যাচ্ছে যে, ভাল করতে যেয়ে উল্টো ফল। এই ক্রলিং পেগের কারণে নতুন দর নির্ধারণের পর কার্ব মার্কেট থেকে বলতে গেলে ডলার উধাও হয়ে গেছে। কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। মুদ্রা বাজারে ডলারের সংকটে বৈদেশিক বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায় পৌছে গিয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দর ১১৭ টাকা হলেও বাস্তবে ১২৪ থেকে ১২৫ টাকার নিচে কোনো ব্যাংক এলসি খুলতে চাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন যে, মুদ্রা তথা ডলার বাজারে হঠাৎ এ অস্থির পরিস্থিতির কারণে কেবল বৈদেশিক বাণিজ্যই নয়, দেশের মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলার আশংকা আছে। আর এই কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য এর মধ্যেই সে আলামতও দেখা যাচ্ছে, বলতে গেলে সব জিনিসপত্রের দাম উর্দ্ধগতি। ইতিমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। যাহোক, পূর্বেই কিছুটা আলোকপাত করেছি যে গত ০৮/০৫/২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক এক ধাপে ডলারের বিনিময় হার ৭ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তাতে ১১০ টাকার স্থলে ১১৭ টাকা আন্তঃব্যাংক দর নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আশ্চর্য বিষয় হলো যে, এ ঘোষণার পর দিন থেকেই খোলাবাজার থেকে ডলার এক প্রকার উধাও হয়ে যায়। এতে বিদেশগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। তবে অতিরিক্ত দাম দিলে কোথাও কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে। আর ব্যাংকগুলোতেও ডলার সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংক এলসি খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। আরেকটি কথা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ঘোষণার কারণে ভবিষ্যৎ মুনাফা পাওয়ার আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ডলার মজুদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বিধায় বলতে গেলে ডলার সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশে যাতায়াত ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে খোলাবাজারে ১ ডলারের জন্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত ক্রেতাদের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারে ডলার কেনার বিষয়ে সতর্ক করার পরও ব্যাংকগুলোয় ডলারের সংকট আরও গভীর হয়। এক্ষেত্রে নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ১৫ টাকা বেশিতে, অর্থাৎ প্রতি ডলার ১২৮ টাকায় বিক্রি হতে থাকে। খোলাবাজারে ডলারের এ রেকর্ড পরিমাণ দাম সম্পর্কে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উচ্চ হারে ডলারের লেনদেনের পেছনে থাকা অবৈধ ডলার ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসিও খুলতে পারছেন না, যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কমার হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌছে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে হচ্ছে তার অর্ধৈক। আর এর জের হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে; যা প্রকারান্তরে অর্থনীতির চাকা প্রায় স্থবির করে তুলছে।
এ প্রেক্ষাপটে তথ্য মতে জানা যায় যে, ডলার বাজার কিছুটা স্থিতিশীল ছিল গত কয়েক মাস। তবে ব্যাংকগুলো কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দরে এলসি খুলতে আগ্রহী ছিল না। কেননা তারা কাগজপত্রে যে দর দেখায়, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। আর ১১০ টাকার নির্ধারিত দর থাকার সময় কোনো ব্যাংক এ দরে এলসি খুলতে সম্মত হলেও অতিরিক্ত টাকা দিলেই কেবল এলসি খুলতে রাজি হতো এবং এক্ষেত্রে খোলাবাজার থেকে অতিরিক্ত ডলার কিনে দিতে হতো। তারা জানান যে, ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হওয়া; সুদহার বৃদ্ধি; ডলার সংকট ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে নৈরাজ্যর কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা; গ্যাস সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কমে যাওয়াসহ বহুমুখী সংকটে বেসরকারি খাত এখন বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। তাই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত আরও বেশি নড়বড়ে হয়ে উঠবে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগের আওতায় অনুমোদিত দর অতিক্রম করে প্রতি ডলার ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অবশ্য ঘোষিত দরে দেশের কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। এদিকে আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলার প্রতি ১২৪-১২৫ টাকাও আদায় করছে বলে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে। আর এটি যদি হিসেব করি, তাহলে দেখা যায়, এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর এই বিনিময় হার নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি বলেন, ‘বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করায় নতুন করে বিনিয়োগ বাড়বে না। একই সঙ্গে খরচ বাড়বে ব্যবসার। ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা কিছুটা লাভবান হলেও আমদানির খরচ বাড়বে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পদক্ষেপের ফলে কস্ট অব ডুয়িংস বিজনেস বা ব্যবসার খরচ বাড়বে বলে সেটা নিয়ন্ত্রনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ব্যবসার খরচ বাড়লে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। নতুন করে তো বিনিয়োগ বাড়বে না বরং উল্টো খরচ বাড়বে। ডলারের দাম যেভাবে ওঠানামা করছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও নজরদারি বাড়াতে হবে। আর ডলারের সাময়িক ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এর মধ্যে ডলার ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক মুদ্রার দর আরও বাড়ার খোঁজ পেয়ে গেছেন বিধায় তারা স্টক রাখার পরও ডলার ঘাটতির কথা বলছেন। বস্তুত খোলাবাজারে বিনিময় হার সব সময়ই ব্যাংকের চেয়ে বেশি থাকে। কখনো কখনো বাজার তদারকির অভাবে তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেরে যায়। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে যে, নগদ ডলারের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ ঠিক আছে। আর এখানে কে বিক্রি করবে বা কে করবে না, এটা তাদের নিজস্ব বিষয়। তাছাড়া আরও বলা হচ্ছে, যে মানি এক্সচেঞ্জার ডলার পাননি, তারা ব্যাংকে গেলেই ডলার কিনতে পারবেন। কেননা ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ৫ কোটি নগদ ডলার মজুত আছে। আসলে ডলারের এই অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন কর্ণার থেকে কথার শেষ নেই। এ ব্যাপারে ডলারের দামকে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন যে, সময় মতো ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না করা এবং পুরো রপ্তানি আয় দেশে না আসায় সংকট যাচ্ছে না। তাছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি কাটছে না ও আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি বাড়ছে। ফলে ডলারের সংকট কাটছে না ও রিজার্ভের পতন হচ্ছেই। ডলারের দাম নির্ধারণে যে ধরনের নীতি নেওয়া হয়েছে, তার কোনোটাই টেকসই হচ্ছে না। এখন নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিও বাজারভিত্তিক না। ডলারকে চাহিদা ও যোগানের সঙ্গে ওঠানামা করতে দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন দামের ঘোষণা দিতে হবে, এতে গ্রাহকেরা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। তাছাড়া ডলার সংকট নিরসনে একটি পথনকশা করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা মেনে নিলে সংকট নিরসন হওয়ার পথ সুগম হবে।
দোস্ত আজিজ, যত কথাই বলি না কেন, এ বিশে^ ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৯৫টি দেশ আছে। আর এমনও অনেক দেশ আছে যে, তারা পুরাপুরি পরনির্ভরশীল। কিন্তু আমরা তেমনটি নই। কেননা আমাদের অর্থনৈতিক শক্ত ভিত আছে। তাই মনে করি যে, ডলারের প্রবাহ বেরে গেলে এটি পশমিত হয়ে যাবে। আর অর্থনীতির এ ধরনের উঠানামার ঢেউ শুধু গরীব বা উন্নয়নশীল দেশ নয়, উন্নত বিশ্বেও হয়ে থাকে। আসলে আমাদের বড় অভাব হলো আন্তরিকতা ও নৈতিকতা। এক্ষেত্রে সামাজিকই বলো, আর আর্থিকই বলো, কোন কিছু ঘটলে তাই নিয়ে তিলকে তাল করার স্বভাব। আর এর সুযোগ নেয় কতিপয় সুবিধাবাদী চক্র।
পরিশেষে বলতে চাই যে, দেহ থাকলে যেমন রোগ হয়। তেমনই অর্থনৈতিক প্রপঞ্চতে মাঝে মধ্যে নেতিবাচক কিছু ঘটতে পারে; তাতে হতাশ হওয়ার কোন কারণ দেখি না। আর এতো খারাপ অবস্থা হয়নি যে বিশ্ব ব্যাংকের বাজেটরি সাপোর্ট বা আই এম এফের বেইআউট প্যাকেজের সাহায্য নিতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাই যদি সচেষ্ট ও আন্তরিক হয়, তাহলে সমস্যা কেটে যাবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার। কেননা এ সংকট কাটার মতো যথেষ্ট পজেটিভ ভ্যারিয়েবল এ দেশে আছে। বস্তুত বিগত দুই বছর ধরে ডলারের সংকট চলছে। হয়তো এখন কিছুটা বেশি হয়েছে। বর্তমানে ক্রলিং পেগ চালু হলেও এটি সাময়িক। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে ডলারের দাম পুরাপুরি মুদ্রা বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হবে বলে অবস্থা দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়। যাহোক দোস্ত আজিজ, কষ্ট করে যে আমার বাসায় এসেছো, তার জন্য আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। ও হ্যাঁ, তোমার জন্য এক হাজার ডলারের ব্যবস্থা করেছি। ফার্মগেটের মানি এক্সচেঞ্জার থেকে নিয়ে যেও। ধন্যবাদ আজিজ আবার আসবে। আশা করি কোলকাতা থেকে সুস্থ্য হয়ে ফিরবে, ইনশাআল্লাহ।

সহায়ক সূত্রাদি-
০১। উইকিপিডিয়া
০২। দৈনিক সমকাল ০৯/০৫/২০২৪ইং, ১১/০৫/২০২৪ইং এবং ১৩/০৫/২০২৪
০৩। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১২/০৫/২০২৪ইং এবং ১৩/০৫/২০২৪
০৪। প্রথম আলো ১০/০৫/২০২৪ইং এবং ১৫/০৫/২০২৪
০৫। সংবাদ প্রকাশ (অনলাইন নিউজ)
০৬। লেখকের দেশি-বিদেশি বাস্তব অভিজ্ঞতা
০৮। ইত্যাদি
বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর