রেজওয়ান আহমেদ
দোর্দণ্ড প্রতাপের গ্রীষ্মদিনগুলি দিনদিন আরো বেশি অসহ্য অলসতার জন্ম দেয়৷ শরীরে রোগের বাসা বাঁধায়৷ কয়েক হাজার কিউবিক সেন্টিমিটার স্যালাইন ওয়াটার নিয়েও নিস্তার মেলে না৷ যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ৷ ফেলে আসা ভূতেরগলির বিকেলসন্ধ্যারা আজিমপুর কবরস্থানের দিকে বাঁকা তাকিয়ে মুচকি হাসে৷ এখানে চৌরাস্তার গাড়ির বহরে জমাট কষ্ট আরো ঘনীভূত করে অস্বস্তি বাড়ায়৷ মন ফিরতে চায় চিরচেনা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মামণি ভিলার তিনতলার বামপাশের ফ্ল্যাটে৷ অথবা হাতিরপুল কাঁচাবাজার সংলগ্ন চৌরাস্তায়৷ ‘আল্লাহর বাতাস’ বহুদিন পাওয়া হয়না৷ মেকি স্যালাইন ওয়াটারের দৌরাত্ম্য আর ভাল্লাগেনা৷ কংক্রিটের খাঁচার জীবন দীর্ঘশ্বাসের অন্য নাম৷ অমনোযোগিতা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে দেয় যখন তখন৷ মনের দাবিদাওয়া সব সময় মিটবার নয়, তবুও কতো ছলাকলা! কতো যুদ্ধ মনের সাথে ট! ক্ষতবিক্ষত হয়ে টিকে থাকার লড়াই৷ ফলাফল – আদর্শগত নৈঃসঙ্গ্য, স্বপ্ন আর বাস্তবতার চিরায়ত বিরোধ, মুক্তির নিদারুণ হাতছানি, জীবন থেকে ছুটি চাওয়ার সহজাত প্রবৃত্তি৷
অতঃপর অস্তিত্ববাদের অস্তিত্ব জানান দিতে, করোটিতে মুক্তির সনদ নিয়ে চোখের তারায় শান্তির তারবার্তা ব্রাহ্মীলিপির আখরে লিখে হাজির হয় একজন। অফিস সহকারীর রুমে কম্পিউটার কিবোর্ডের খটাখটেই পরিচয় তার সাথে।
– M লিখে বসে আছেন কেন ? লেখেন SJGKF হুম হুম কুইক !
– জ্বী ?
– জ্বী ৷ আপনার নাম !
যারপরনাই বিস্মিত হয়ে পেছনে তাকায় মুক্তা। নিজেরও অজান্তে চায়ের মগটার দিকে আঙুল চলে যায়, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। কিন্তু তার তর্জনী আর মগে টলটলায়মান চা সমস্বরে বলতে চায় চা আর টাইপিং – দুটো জিনিস একসাথে হয় না। কিন্তু যে মানুষ M লিখে চায়ে মন দেয় সে মুক্তা হোক কিংবা মণি, তার ত নিজের দিকেই খেয়াল নেই। এই মানুষ কিনা হাজিরা দেবে মুক্তির মন্দিরসোপানে? আলস্যদোষের মূলোৎপাটন করবে?
একদিন পাড়ার মসজিদটার সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে সিগারেট খাচ্ছি – সেইখানে সে হাজির! মনোযোগ সিগারেটে থাকলেও চারপাশের সব কথাই কানে আসছিল- আচ্ছা, চায়ের দোকানে যে কেন এদের সিগারেট বেচতে হবে?! কেউ যেন কানে গরম সীসা ঢেলে দিল আমার। সেই সীসার বিষক্রিয়ায় মনোযোগ হারিয়ে ঘুরে তাকাতেই যেন ভূত দেখলাম। জীবনে বছরদশেক ভূতেরগলিতে থেকেও কোনোদিন ভূতের সাথে সাক্ষাৎ হলো না, আর আজ মুক্তা কোত্থেকে এসে উলুবনে মুক্তা ছড়াতে গিয়ে আমাকে ইনডিরেক্ট হ্যালো দিয়ে ফেলল? এই হলুদ-হিজাবি শুদ্ধাত্মাকে আমি কী করে হাই বলব? মুখ খুললেই ত বুঝে ফেলবে আমি একটা খারাপ (স্মোকারদের ভালো বলার গাটস অনেকেরই নাই, আর আমার গাটস নাই নিজেকে ভালো বলার) ছেলে! সৌজন্যের হাসি হেসে চুপচাপ তার থেকে নিজেকে আড়াল করার খেলায় মেতে উঠলাম। পাশের গেট গলিয়ে ওদিকটায় চলে যাই।
মিনিটকুড়ি পর মসজিদের পাশের ফার্মেসিতে আসি। হরমোনের ওষুধ লাগবে দুটো। ভুলে গিয়েছিলাম নিতে। ফার্মাসিস্ট আমাকে চেনে খুব ভালো করে। মাসের মধ্যে দুয়েকবার একই ওষুধ নিতে আসা কাস্টোমারকে না চিনলে ফার্মাসিস্ট হওয়ার কী দরকার? আমি এখানে বছর দুই যাবত আছি। কিন্তু মুক্তা আমাকে মুক্ত করতে এসেছে – দু’মাসও হয়নি। মনে মনে অন্য কাউকে নিজের ভাবতে কতো সময় লাগে, সেটা আজকের দিনে তর্কের বিষয় হতে পারে। আমার বেলায় তখন ঐ ক’দিনই যথেষ্ট ছিল। তা বোধকরি সেই ফার্মাসিস্টও বুঝে ফেলেছিল ঐ কদিনেই। মাথার ওষুধ বেচা ফার্মাসিস্ট ত, করোটি ভেদ করে একেবারে মগজে ঢুকে পড়েছিল। তার জন্য ডোপামিন, সেরোটোনিনের খবর নেয়াটা কোনো ঘটনাই না। শুধু এই ক্লাউড নাইন সিম্পটম মুক্তাকে বুঝিয়ে মুক্ত হতে পারছিলাম না।
যাক, ফার্মেসি থেকে নেমেই মসজিদের ঢাউস সাইজের দানবাক্স। সচরাচর সেদিকে চোখ যায় না যদিও যে কেউ যেকোনো সময়ই দানের টাকা ফেলে ওখানে। হলুদ-হিজাবিকে দেখে সাহস সঞ্চয় করলাম, আজ বলবই কথা। অফিসের বাইরে ত আর ও আমার কলিগ নয়! ফর্মালিটি ফর্ম ফিল আপ করে আবেদন করতে হবে না- May I therefore pray for your kind attention to have a sweet conversation face to face…
ওরে বাবা! কুড়ি মিনিট আগে আমার আর কী সৌজন্য ছিল হাসিতে? এর থেকে ত দেখি ততোধিক সৌজন্যতা উথলে পড়ছে! যাক, আমি সহজভাবেই বললাম – একি? এখানে? কী ব্যাপার? টাকাও দিলেন দেখলাম? মানত ছিল? বোধকরি একবারে এতগুলো প্রশ্ন হজম করে উঠতে পারেনি মুক্তা – না এমনি। পরে বলব। এখন আসি। স্যরি হ্যাঁ?! হ্যাঁ বা না, আমাকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে উল্টোদিকে এমন হাঁটা দিল, তীরবৎ সরলরেখাও বোধকরি এতটা ঋজু হয় না।
দুদিন পর রবিবার অফিসে গিয়ে দেখি মুক্তার চেয়ারটা ফাঁকা। অফিস খোলার ডেটে এই শহরে সকালের জ্যামের সাথে যে যুদ্ধ করতে হয় আমাদের, তার জন্য আমরা কোনো ভাতা পাই না। অথচ এটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কাজেরও চাপ আছে আজ। চা আর সিঙ্গারার কথা বলেছিলাম সার্ভিস বয়কে। এখনও ত আনল না। এত্তগুলো ফাইল ধরিয়ে দিয়ে উধাও। সেসবে সাইন করে টায়ার্ড আমি। কে এল কে গেল, কিছুই দেখিনি খেয়াল করে। কিন্তু মুক্তার চেয়ারে অন্য এক ভদ্রলোককে দেখে চমকে উঠলাম। তাহলে…
শুনেছিলাম গত সপ্তাহে – হেড অফিস থেকে কোনো একজনকে ট্রান্সফার করা হতে পারে। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালাম। আমি ত বৃহস্পতিবার ছুটিতে ছিলাম। যা কিছু হবার সেদিনই হয়ে গেছে। আমার কাছে কোনো চিঠি আসলে আজ আমি যা করতাম মুক্তা সেদিন তাই করে গেছে।
তাহলে সেদিন কীসের টাকা দিয়েছিল সে মসজিদে? জানতে ইচ্ছে করলেও আমি আর সেসব জানতে পারিনি। শুধু জেনেছি- এক বৈশাখে দমকা হাওয়া এসেছিল, জৈষ্ঠ্যজুড়ে ছিল, আষাঢ়ে মেঘ হয়ে ঝরিয়ে গেছে দুচোখ। দমকা হাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, এতে হৃদরোগ হয়।